কে বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না? বাংলাদেশে হয়। গত দেড় বছরে করোনাকালে বাংলাদেশে লকডাউন ইতিহাস রচনা করেছে। ৮ মার্চ, ২০২০ দেশে করোনা শনাক্তের পর প্রথম সাধারণ ছুটি বা করোনায় পরিচিত শব্দ ‘লকডাউন’ ঘোষিত হয় ২৬ মার্চ। কিন্তু ঘোষণা আসে দুইদিন হাতে রেখে এবং এই সুযোগে লাখ লাখ মানুষ ভিড় করে ফেরিঘাটে, সড়কের মোড়ে মোড়ে।

সাধারণ ছুটি বলা হলেও এই সময়ে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মানুষজন যেন যাতায়াত করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সাধারণ ছুটি বেড়েছে বারবার, কিন্তু মানুষের চলাচল আর বন্ধ করা যায়নি। ঈদ কিংবা যেকোনো উৎসবে তথাকথিত ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ উপেক্ষা করে মানুষ প্রচণ্ড ভিড় করে বাড়ি গেছে। এক সময় সব খুলে দেওয়া হলো, একটা আত্মপ্রসাদ আসলো আমাদের রাজনৈতিক নেতা ও নীতিনির্ধারকদের আচরণে, যেন আমরা সত্যি সত্যি করোনাকে জয় করেছি।

করোনাভাইরাস আবার তার লাল চোখ দেখাচ্ছে এবং এবারের সংক্রমণ ঢাকার বাইরে। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের পরিস্থিতি বলতে গেলে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ বছর রোজার ঈদে লকডাউনের নির্দেশ ব্যর্থ করে মানুষ ঠিকই গাদাগাদি করে, স্বাস্থ্যবিধিকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে গেছে। 

মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। বহু মানুষ একাধিকবার করোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছে। এমনকি দুই ডোজ টিকা নিয়েও সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পারছে না অনেকে।

প্রতিবারই কঠোর লকডাউনের ঘোষণাটা এমনভাবে দেওয়া হয় যেন মানুষ করোনাকে স্বাগত জানিয়ে ভিড় করে বাড়ি ছুটতে পারে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। গত শুক্রবার জানিয়ে দেওয়া হলো সোমবার থেকে কঠোর লকডাউন। এরপর জানানো হলো, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, বৃহস্পতিবার থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’। ব্যস, আর যায় কোথায়, দলে দলে মানুষ ছুটল বাড়ির পানে।

কেন বারবার একই ভুল করা হয় সেটা কর্তা ব্যক্তিরাই জানেন। আমরা শুধু বুঝতে পারি সরকারের এই অবৈজ্ঞানিক পন্থায় সাত দিন, সাত দিন করে লকডাউন মহড়া প্রকারান্তরে করোনাভাইরাসের জন্য সহায়ক হয়ে উঠছে। করোনার সৌজন্যে দেড় বছর ধরে আতঙ্ক দেশবাসীর পিছু নিয়েছে। এখন চলছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব। এর মধ্যেই সবচেয়ে বিপজ্জনক ভারতীয় ডেল্টা স্ট্রেইনের হাত ধরে দেশের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। কয়েক মাস আগেও ধারণা ছিল যে, করোনা দরিদ্র মানুষের হয় না বা গ্রামে করোনা নেই—তাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে অতিমারি প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে অতি দরিদ্র মানুষের, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে-গঞ্জে। এখন দেশের প্রতিটি মানুষ করোনায় প্রাণ চলে যাওয়ার নানা খবরে আশঙ্কিত।

মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। বহু মানুষ একাধিকবার করোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছে। এমনকি দুই ডোজ টিকা নিয়েও সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পারছে না অনেকে। এমন পরিবার আছে যেখানে একাধিক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের কর্মক্ষম একমাত্র সদস্যকে হারিয়ে বহু পরিবার অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছে। প্রথম দিকে আক্রান্ত ও মৃতদের বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ ছিল। এখন যুবক-যুবতী, এমনকি কিশোর-কিশোরীও আক্রান্ত হচ্ছে। তাদেরও মৃত্যু হচ্ছে।

ভারতের অবস্থা আমরা দেখেছি। বিপদটা আমাদের জন্য অনিবার্যই ছিল। সতর্কও করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু পাত্তা দেইনি। না মানুষ, না প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি। প্রতিবার ঈদের সময় ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। সামনে আরেক ঈদ। মানুষের আচরণে শোরগোল দেখছি।

একটা কথা অজানাই থেকে যাচ্ছে। বিশ্বের বহু দেশে করোনা মহামারি আমাদের চেয়েও আরও বড় আকারে দেখা দিয়েছে। কিন্তু সেসব দেশে এভাবে রাস্তায় মানুষের ঢল নামার খবর আমরা পাইনি। আমরা কিসে আলাদা, যে হঠাৎ এতগুলো মানুষকে এই শহর ছেড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি হাতে নিয়ে বাড়ি যেতে হয়?

বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন লকডাউনের উপর নির্ভর করেছিল, তখন আমরা লকডাউন করতে চাইনি। এখন সবাই যখন লকডাউনকে ঝেড়ে ফেলে টিকা নির্ভর হয়ে মানুষকে মুক্ত করে দিচ্ছে তখন আমরা লকডাউন না শাটডাউন হবে সেই তর্ক করছি। করোনা-সংক্রমণ রুখতে দেশজুড়ে লকডাউনই যদি একমাত্র পথ হয়, তবু তার পরিকল্পনা তৈরির সময়ে কি যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছিল সরকার?
আগেভাগে ভাবা হয়েছিল দরিদ্র মানুষের কথা? হঠাৎ পরিবহন পুরো স্তব্ধ হয়ে গেলে, মানুষজন কি করে বাড়ি যাবে সেই ভাবনা ভাবা হয়েছিল?

সরকার হয়তো বলবে, মানুষ কেন বাড়ি যাবে? বারবার প্রমাণ হয়েছে মানুষকে আটকে রাখা যায় না। প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও ঢাকা বা বড় জেলা থেকে নিজেদের বাড়ি ফিরতে মরিয়া সাধারণ মানুষ। বাস না পেয়ে ছোট ছোট গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে যাওয়া, ফেরিতে ভিড় আর রাস্তা ধরে শ’য়ে শ’য়ে কিলোমিটার হাঁটার মর্মান্তিক ছবি আমরা দেখেও কেন এমন করে লকডাউনের ঘোষণা দেই বারবার?

বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন লকডাউনের উপর নির্ভর করেছিল, তখন আমরা লকডাউন করতে চাইনি। এখন সবাই যখন লকডাউনকে ঝেড়ে ফেলে টিকা নির্ভর হয়ে মানুষকে মুক্ত করে দিচ্ছে তখন আমরা লকডাউন না শাটডাউন হবে সেই তর্ক করছি।

একথা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, লকডাউনের মতো এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং কার্যকর করার সক্ষমতার অভাব রয়েছে। কার্যত কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই এগুলো করা হয়। যাদের দিন এনে দিন খাই দশা, তারা শহরে থাকবে না। যারা অস্থায়ী কাজ করে তারাও থাকবে না। গ্রামে গেলে অন্তত খাওয়াটা পাবে। আর আছে সরকারি কর্মচারী, যারা বেতন, বোনাস আর উপরি আয়টা আমোদে ভোগ করতে গ্রামে যাচ্ছে। 

বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় কত শত মানুষের মাথায় ছাদ নেই, রোজগার বন্ধ, তারাও যাচ্ছে। করোনার জেরে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। আগের দুই কোটিতো ছিলই। করোনা ঠেকাতে লকডাউনের কারণে অর্থনীতির যা অবস্থা তাতে মধ্যবিত্তও গরিব হতে চলেছে। আর এতে করেই লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। লকডাউন অথবা শাটডাউন যেহেতু সফল হয় না, এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় খুঁজতে হবে।

অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। দেড় বছরে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি সচেতন করতে না পারা বড় ব্যর্থতা। রাস্তায় বের হলে বেশিরভাগ মানুষের মুখে মাস্ক চোখে পড়ে না। ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি আরও খারাপ।

তাই বিকল্প ভাবতে হবে। যেখানে প্রয়োজন সেখানে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন করলেও করা যেতে পারে, কিন্তু সারাদেশ একযোগে বন্ধ করে দেওয়ার যুক্তি নেই। বরং সরকার ও প্রশাসন কঠোর হোক মানুষকে ঠিকমতো মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করতে। এতেই করোনার ঝুঁকি বড়ভাবে মোকাবিলা করা যাবে। আর সাথে চেষ্টা নেওয়া হোক দ্রুত টিকাকরণের। আমরা যে ধরনের লকডাউন দেখি এটি শুধুমাত্র সরকারি কর্মজীবীদের আনন্দ উপভোগ ছাড়া আর কিছু নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বারবার আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছেন। তাদের ক্ষতি পোষাবে কে?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি