আমরা এবছর এমন এক সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করছি যখন আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সর্বশেষ যে সমীক্ষাটি ২০১৮ সালে হয়েছিল সেখানে আমরা দেখেছি যে, দেশের প্রায় ১৬ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ও প্রায় ১৮ ভাগ অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত।

কিন্তু আমরা করোনা মহামারির পর বেশকিছু গবেষণায় উল্লেখ পাচ্ছি যে, এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এসব গবেষণায় এই সংখ্যা ২৫ থেকে ৩৪ ভাগ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে। এসব মানসিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ, বিষণ্নতা, মানসিক চাপ, হতাশা ইত্যাদি। এমতাবস্থায়, প্রশ্ন আসতেই পারে যে, কেন মানসিক সমস্যার হার সম্প্রতি সময়ে বাড়ছে?

কারণ হিসেবে প্রথমেই যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করতে চাই সেটা হলো করোনা মহামারি। একথা অনস্বীকার্য যে, করোনা আমাদের সবার জীবনযাত্রাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো একটি অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যবিধি আমাদের দীর্ঘদিন মেনে চলতে হয়েছে। যার ফলে আমাদের সামাজিক সংযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এর সাথে সাথে করোনা আমাদের প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য করেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চিত ও দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ জোরালোভাবেই দায়ী।

এই যে অতিমাত্রায় প্রযুক্তি নির্ভরতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, প্রতিনিয়ত নিজের এবং আপন মানুষগুলোর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আমাদের মধ্যে মারাত্মক উদ্বেগ ও ভয়ের জন্ম দিয়েছে। এর সাথে সাথে ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। এর সাথে সাথে করোনার ফলে আমাদের প্রত্যেককেই প্রতিনিয়ত অনেক রকমের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

মিটিং করেছি অনলাইনে, ক্লাস করেছি অনলাইনে, ডাক্তার দেখিয়েছি অনলাইনে এমনকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানও করেছি অনলাইনে। এর সাথে সাথে বাজার করা, সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করা ইত্যাদি সবকিছুই করতে হয়েছে অনলাইনে। এগুলো কিন্তু আমাদের জন্য সহজ ছিল না। এর জন্য প্রতিনিয়ত আমাদের নতুন কিছু শিখতে হয়েছে এবং নতুন কিছুর সাথে খাপ খাওয়াতে হয়েছে।

এই নতুন শেখা এবং খাপ খাওয়ানো আমাদের সম্মুখীন করেছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের। যারা এই চ্যালেঞ্জের সাথে খাপ খাওয়াতে পেরেছি তারা এ যাত্রায় উতরে গিয়েছি। যারা পারিনি তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনার ফলে আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের উপরও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কমিয়ে দিয়েছে।

মানুষ তাদের জমানো টাকা খরচ করে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গিয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা হুমকির মুখে পড়েছি। আর যেকোনো প্রকার অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আমাদের জীবনের অন্যান্য দিকগুলোর সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্যকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। সাম্প্রতিক সময়ে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চিত ও দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ জোরালোভাবেই দায়ী।

আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় ভূমিকা রেখেছে সুস্থ বিনোদনের অভাব।

আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় ভূমিকা রেখেছে সুস্থ বিনোদনের অভাব। আমরা বিগত দুই দশক ধরেই লক্ষ্য করছি যে, আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণেরা বিনোদনের জন্য ভার্চুয়াল মাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

খেলার মাঠের অভাব, সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ কমে যাওয়া, স্কুলের পড়ার চাপ ইত্যাদি আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণদের করেছে বাক্সবন্দী। এর ফলে তাদের বিনোদন প্রায়শই হয়েছে একমুখী ও নিষ্ক্রিয়। সক্রিয় ও দ্বিমুখী বিনোদন থেকে বঞ্চিত হয়ে আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণেরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার মধ্যে পর্যবসিত হচ্ছে।

এমতাবস্থায় প্রশ্ন আসতেই পারে যে, মানসিক সমস্যা প্রতিরোধে আমরা কী করতে পারি? অনেকেই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ব্যক্তি পর্যায়ের বিভিন্ন প্রচেষ্টার কথা বলবেন। লাইফ স্টাইল পরিবর্তন, নিরাপদ সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো, সুস্থ বিনোদন, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ়করণ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করবেন। কিন্তু এধরনের ব্যক্তি নির্ভর সমাধান প্রস্তাব করে আমরা আসলে এই মানসিক সমস্যার দায় ব্যক্তির উপরেই চাপিয়ে দিচ্ছি। রাষ্ট্র হিসেবে, সমাজ হিসেবে এবং কমিউনিটি হিসেবে আমরা আমাদের দায় এড়িয়ে যাচ্ছি।

মানসিক স্বাস্থ্যকে শুধুমাত্র মাইক্রো লেভেল থেকে দেখলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। মানসিক স্বাস্থ্যকে ম্যাক্রো লেভেল থেকে দেখতে হবে। আমার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বিনোদনের দায় রাষ্ট্রকে, সমাজকে ও কমিউনিটিকে নিতে হবে। তাহলেই এই সমস্যা থেকে আমরা দীর্ঘমেয়াদে বের হয়ে আসতে পারব। 

সেলিম হোসেন ।। সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়