আজ ২৫ নভেম্বর International day for the elimination of violence against women বা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় অনুষ্ঠিত নারীদের এক সম্মেলনে দিনটি আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলন দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ দিবসটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে অবশ্য ১৯৯৭ সাল থেকেই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

গত বছরের মতো এ বছরও দিবসটি পালিত হচ্ছে করোনা মহামারির সময়ে। ইউরোপসহ বিশ্বের নানা দেশে আবারও করোনার ভয়াবহতা বাড়তে শুরু করেছে। ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সাথে মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টিও সামনে চলে আসছে।

করোনা মহামারির সময়ে বিভিন্ন মেয়াদের লকডাউনে নারীদের নানামাত্রিক পারিবারিক সহিংসতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, সহিংসতা প্রতিকারে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, সুরক্ষা এবং সামাজিক সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও নানারকম সংকট তৈরি হয়েছে।

এই ঘটনার সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হচ্ছে, গত ১১ নভেম্বর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ মামলায় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের একটি অযৌক্তিক ও আইন বহির্ভূত আদেশ।

৭০ শতাংশের বেশি বিবাহিত নারী তাদের সঙ্গীদের দ্বারা নানামাত্রায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বলছেন যে, তাদের সঙ্গীরা তাদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে...

যদিও এই মামলার লিখিত রায়ে আদেশটি নেই, কিন্তু রায়ের পর কৌঁসুলিদের উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকেই জানা যায়— ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা না নেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন বিচারক।

এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ বিচারকের ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন; তবুও এমন একটি মৌখিক আদেশ থেকেই বোঝা যায়, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলো প্রসঙ্গে খোদ বিচার বিভাগেরও সংবেদনশীলতার অভাব রয়েছে।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (Bangladesh Bureau of Statistics) সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি বিবাহিত নারী তাদের সঙ্গীদের দ্বারা নানামাত্রায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বলছেন যে, তাদের সঙ্গীরা তাদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে, যদিও লোকলজ্জা ও সামাজিকতার ভয়ে নির্যাতিতদের অধিকাংশই কাউকে কিছু বলেননি। এর মধ্যে তিন শতাংশেরও কম ভুক্তভোগী আইনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে কমপক্ষে ২৩৫ জন নারীকে তাদের স্বামী বা স্বামীর পরিবার হত্যা করেছে।

অথচ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশে দুটো কার্যকর আইন রয়েছে। একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এবং অন্যটি পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০। প্রশ্ন হচ্ছে, এই আইনের অধীনে অর্থবহ আইনি সমাধান কি নির্যাতিতরা পান?

নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মাল্টি-সেক্টরাল প্রোগ্রামের গত বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকারের নয়টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের মধ্যে কেবল একটি সেন্টারের মাধ্যমেই মামলা দায়ের করা হয়েছে ১১,০০০ এরও বেশি। এখনো পর্যন্ত মাত্র ১৬০টি ঘটনার দণ্ডাদেশ হয়েছে, অর্থাৎ ১ শতাংশের সামান্য বেশি। এ তো গেল ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কথা।

সারাদেশের বিচারালয়ের অবস্থা আরও হতাশাজনক। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পাওয়া হিসেবে সারাদেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৩৭ লক্ষ। বিপুলসংখ্যক মামলার জটে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার মামলাগুলো একসময় হারিয়ে যায়।

তথ্য প্রযুক্তির এই সময়ে নারীর বিরুদ্ধে শারীরিক সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাইবার বুলিংয়ের মতো অপরাধ। কিন্তু এই অপরাধ দমন বা বিচারের জন্য না আছে প্রশাসনিক তৎপরতা, না আছে বিচারিক উদ্যোগ।

এক্ষেত্রে প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গিও প্রশ্নাতীত নয়। অধিকাংশ সময়েই আমরা দেখি, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রশ্নে নানা ধরনের প্রশাসনিক টালবাহানা তৈরি হয়। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগে নির্যাতনকারীদের ভয়ভীতি ও নানাবিধ হুমকি নির্যাতনের শিকার নারীকে আর্থিক ও মানসিক চাপে ফেলে দেয়। ফলে অনেক ঘটনাতেই আদালতের বাইরে এক ধরনের আপস মীমাংসা করা হয়, যা ভবিষ্যৎ অপরাধগুলোকে আরও উসকে দেয়।

এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যে কার্যকর আইন থাকলেও তার সুবিধা সহিংসতার শিকার নারী পান না। ফলে আইনের কার্যকারিতাও অপ্রতুল ঠেকে। এতে সরকারও নারী ও শিশু নির্যাতনহীন একটি সমাজ গঠনের যে জাতীয় লক্ষ্য তা থেকে পিছিয়ে পড়ছে।

২০১৩ সালে সরকার কর্তৃক ঘোষিত National Action Plan to Prevent Violence Against Women and Children 2013-2025 জাতীয় লক্ষ্যের আওতায় নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গঠনের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তা এখন কেবল অনিশ্চিতই নয়, প্রায় অসম্ভব ঠেকছে। কারণ, সহিংসতার ধরন ও প্রকৃতি যেমন বদলেছে, তেমনি সহিংসতার মাত্রাও দিনকে দিন বাড়ছে।

তথ্য প্রযুক্তির এই সময়ে নারীর বিরুদ্ধে শারীরিক সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাইবার বুলিংয়ের মতো অপরাধ। কিন্তু এই অপরাধ দমন বা বিচারের জন্য না আছে প্রশাসনিক তৎপরতা, না আছে বিচারিক উদ্যোগ। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

আজকের এই দিনটিকে সামনে রেখে নানা ধরনের আয়োজন প্রতি বছরের মতোই অনুষ্ঠিত হবে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে নাগরিকরা হয়তো এক ধরনের প্রতিবাদ জারি রাখতে পারেন, কিন্তু অপরাধ নির্মূলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। তাই নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে বিচারিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার আশু পদক্ষেপ জরুরি।

সঙ্গীতা ইমাম ।। শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী