নাড়ির টান পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে। জন্মভূমিতে ফেরার আকুলতা প্রবাসীদের সবসময় উদগ্রীব করে রাখে। তাদের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে বাংলাদেশের প্রতি।

তবে প্রবাসীদের জন্য একটু ভিন্ন রকম হয় কেননা একদিকে যেমন নাড়ির টান অপরদিকে পরিবার-আত্মীয়স্বজন ফেলে একাকী জীবন বা পরিবার সাথে থাকলেও আত্মীয়স্বজদের সাথে মেলামেশা বা আতিথেয়তার অভাব অনেক বেশি অনুভূত হয়।

যখনই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমায়, অনুভূতি প্রবল হতে থাকে। যেমন কাছের মানুষ থেকে দূরে গেলে যেরকম একটা টান অনুভূত হয় প্রবাসীদের ক্ষেত্রেও মাতৃভূমির প্রতি তেমন‌ই অনুভূতি হয় যা দেশে বসবাসের সময় সেই উপলব্ধি আসে না।

আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, জন্মের পর বেড়ে ওঠা একটা পরিবেশ আমাদের মনের মধ্যে জায়গা করে নেয় যা ভিন্ন দেশে মনের সাজানো সেই পরিবেশের সাথে খাপ খায় না, তাছাড়া প্রবাসীদের অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা হলো, তাদের মনের অভিব্যক্তিগুলো প্রকাশ করার সুযোগও কম থাকে।

তাদের মনের কথাগুলো জানতে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি প্রশ্ন করা হয়, তারা কেন দেশকে এত ভালোবাসেন? উত্তরে তারা চমৎকার সব অনুভূতি জানিয়েছেন নাম প্রকাশ না করে। তাদের মতামতগুলো তুলে ধরা হলো—‘প্রতিটা মানুষ যখন তার মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকে তখন প্রতিটা মুহূর্ত সে তার মাকে মিস করে, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি আমাদের কাছে ঠিক মায়ের মতোই। তাই প্রবাসীরা দেশমাতৃকার ধূলিকণা, আলো-বাতাস সবুজের সমারোহের কথা মনে করে নিজের অজান্তেই দেশকে কখন যে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ফেলে তা জানে না। তাই তো দেশ এবং দেশের মানুষ ভালো থাকলে প্রবাসীদের মন খুশিতে ভরে ওঠে’।

‘জন্মগতভাবেই মাতৃভূমির সাথে হৃদয়ের একটা সম্পর্ক তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে মাতৃভূমি থেকে দূরে অবস্থান করার কারণে ভালোবাসাটা আরও বেশি প্রকট হয় তাছাড়া বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অপরূপ নয়নাভিরাম দৃশ্য বিশ্বের কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

‘একজন প্রবাসী দেশ ছাড়ার পরপরই তিনি দেশের প্রতি আবেগী হয়ে ওঠেন এবং সে কারণেই তিনি দেশকে অতিমাত্রায় ভালোবাসতে থাকেন’।

‘আমারা বাংলাদেশকে ভালোবাসি কারণ, বাংলাদেশ আমাদের মা’।

‘মা, বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং জীবনের অমূল্য স্মৃতি, আবেগ, অনুভূতি সবই বাংলাদেশে। তাই শুধু বাংলাদেশেকে ভালোবাসলে এক সাথে সব ভালোবাসা হয়ে যায়।’

‘বিদেশিদের নিজ দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা দেখে এবং দেশে থাকাকালীন অবস্থায় মাতৃভূমির প্রতি অবজ্ঞার কথা মনে পড়ে আমাদের বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা অনেকাংশে বেড়ে যায়’।

প্রায় ৭০ শতাংশ প্রবাসীর অভিমত, শুরুতে জন্মভূমি ও পরিবার-পরিজনের প্রতি যতটা আবেগ-অনুভূতি ছিল এখন তা প্রবল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণকালে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, যখনই একজন প্রবাসী বাংলাদেশির সাথে প্রথম পরিচয় হয় তখন তিনি এতটাই আনন্দিত এবং পুলকিত থাকেন যে, মনে হয় তিনি যেন তার পরমাত্মীয় খুঁজে পেয়েছেন। এই সম্পর্কের ভিত্তি শুধুমাত্র মাতৃভূমি বাংলাদেশ। মূলত বাংলাদেশকে ভালোবাসেন বিধায় তিনি অচেনা মানুষকেও আপন করে নিয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তও প্রবাসে অবস্থানকালে মাতৃভূমির প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্নভাবে, তার ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার কয়েকটি লাইন একইভাবে প্রবাসীদের মনের ভাষা প্রকাশ করে—

‘...বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে

দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।’

 

ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী ।। পর্তুগাল প্রবাসী সাংবাদিক