আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। আজ যারা মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠছে, অদূরে তারাই নেতৃত্ব দেবে। সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তারা বিশ্বকে শাসন করবে। আর তাই আজকের শিশুদের আগামী বিশ্বের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন তাদের জন্য সঠিক মঞ্চ তৈরি করে দেওয়া, যেখানে তারা নিজেদেরকে বিকশিত করার সুযোগ পাবে। 

যে সমাজ তাদের এই মঞ্চ যত সুচিন্তিতভাবে প্রস্তুত করবে, সে সমাজের শিশু সমাজকে তত সুশৃঙ্খলভাবে নেতৃত্ব দেবে। সমাজের নাগরিক হিসেবে আপনি তখনই একটি ভালো নেতৃত্ব বা সমাজ পরিচালনা আশা করতে পারবেন যখন আপনি আপনার সমাজের শিশুদের সুষ্ঠুভাবে শারীরিক, মানসিক ও ভাষিক বিকাশের সুযোগ করে দিবেন।

শারীরিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য একটি শিশুর যেমন খাদ্য প্রয়োজন, একইভাবে প্রয়োজন সঠিক শরীরচর্চা। শিশুদের এই শরীরচর্চার সবচেয়ে অভিনব পন্থা হলো খেলাধুলা। অপরপক্ষে আত্মিক বা মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা, খেলা ও বিনোদন।

শিশুদের যত বেশি সুষ্ঠু শিক্ষা, খেলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা যাবে, তাদের আত্মিক বিকাশ তত সুন্দর হবে। শৈশবে শিশু বেড়ে উঠবে দৌড়, লাফ-ঝাপ, খেলাধুলার মধ্য দিয়ে। যেখানে তারা নিজেদেরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পাবে পাশাপাশি এসবের মধ্যে দিয়েই তাদের শিক্ষার হাতেখড়ি হবে।

খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর চিন্তা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে, নেতৃত্বের দক্ষতা অর্জিত হয়, জয়-পরাজয় মেনে নেওয়ার সাহস বাড়ে, দেশপ্রেম জাগ্রত হয় এবং নৈতিক চরিত্রের বিকাশ ঘটে।

গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ঠিক একথাই বলেছেন, ‘শৈশবকালীন খেলা হচ্ছে পরবর্তী জীবনের জ্ঞানের ভিত্তি’। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর চিন্তা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে, নেতৃত্বের দক্ষতা অর্জিত হয়, জয়-পরাজয় মেনে নেওয়ার সাহস বাড়ে, দেশপ্রেম জাগ্রত হয় এবং নৈতিক চরিত্রের বিকাশ ঘটে। শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমে যায়। পাশাপাশি প্রতিদিন খেলাধুলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে শিশুর শরীর, হাড় ও পেশি শক্তিশালী হয়। তারা দ্রুত বেড়ে ওঠে। নিয়মিত মাঠে খেলাধুলা শিশুদের উদ্দীপনা, কর্মক্ষমতা ও সহনশীলতাও বৃদ্ধি করে।  

এক সময় আমাদের শৈশবের বিকেল বেলাটা শিশুর খেলাধুলার জন্য বরাদ্দ থাকলেও, এখন পড়াশোনার চাপ সামলাতে পড়ন্ত বিকেল বেলায়ও শিশুকে বই-খাতায় ডুবে থাকতে হয়। অন্যদিকে যখন সময় পায় তখনো মাঠ কিংবা খোলা জায়গার অভাবে শিশুরা খেলাধুলা করতে পারে না।

মাত্র কয়েক দশক আগেও মাঠ ছাড়া স্কুল-কলেজ কল্পনা করা না গেলেও এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রাণ খুলে দৌড়ানোর, খেলাধুলা করার জায়গার বড় অভাব। সে সঙ্গে সভ্যতার ক্রমবিকাশ আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে এক সময়কার গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো। নাগরিক জীবনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার পাশাপাশি আমরা আমাদের অনেক নির্মল আনন্দ বিসর্জন দিয়ে এখন একেবারেই যান্ত্রিক হয়ে উঠেছি। 

উন্নত বিশ্বের তথা ইউরোপ বা আমেরিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে তাদের পরিকল্পনার একটা বড় অংশ থাকে শিশুদের শিক্ষা, বিনোদন, খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে। সে তুলনায় শিশুদের নিয়ে আমরা অনেক উদাসীন। আমাদের উচিৎ ছিল শিশুদের খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ দেওয়া।

পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গা থেকে শিশুর জন্য সুন্দর শৈশবের উপযোগী পরিবেশ দিতে হবে। আমরা যদি তা করতে ব্যর্থ হই তাহলে শিশুর শৈশব অনলাইনের বিমূর্ত জগতে বন্দি হয়ে থাকবে। শিশুরা হারিয়ে ফেলবে নিজেদের আবিষ্কার করার যোগ্যতা।

করোনা মহামারি আমাদের শিশুদের আরও বেশি অনলাইনে নির্ভর করে দিয়ে গেছে। শারীরিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে আমাদের শিশুরা একা হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি বর্তমানে শিশুদের নিয়ে আমাদের অন্যতম উদ্বেগের কারণ। তাই এ থেকে উত্তরণের উপায় আমাদের ভাবতে হবে। যেখানে আমাদের শিশুর বিকাশের জন্য তাদের খেলাধুলাময় শৈশব ফিরিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, সেখানে আমারা নিজেরাই মেতেছি তাদের খেলাধুলার জায়গা, পার্ক, মাঠ দখল করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার এক জঘন্য ও আত্মঘাতী খেলায়। অথচ সমাজের উচিৎ ছিল শিশুদের জন্য আধুনিক খেলার মাঠ দিয়ে শরীরচর্চার ব্যবস্থা করা, পার্ক ও থিয়েটার নির্মাণ করে তাদের সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করা এবং গ্রন্থাগারের মাধ্যমে তাদের জ্ঞানচর্চা ও নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ দেওয়া সেখানে সমাজের তথাকথিত কিছু ক্ষমতাসীন এসবের পরিবর্তে শিশুদের অধিকার খর্ব করছে।

শিশুর বিকাশের জন্য তাদের খেলাধুলাময় শৈশব ফিরিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, সেখানে আমারা নিজেরাই মেতেছি তাদের খেলাধুলার জায়গা, পার্ক, মাঠ দখল করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার এক জঘন্য ও আত্মঘাতী খেলায়।

আমাদের শিশুদের সুন্দর সম্ভাবনাগুলোকে গলাটিপে হত্যা করছে। তাদের মধুর শৈশবকে কেড়ে নিচ্ছে। একটু ভাবুন তো, আমরাই তো শিশুর জন্য কোনো মঞ্চ প্রস্তুত করে দিচ্ছি না, বিপরীতে তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছি মোবাইল ফোনের বিমূর্ত জগতে। তাহলে কীভাবে আশা করতে পারি আমাদের এই শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হয়ে গড়ে উঠবে? এভাবে চলতে থাকলে শিশুরা কখনোই সমাজের, রাষ্ট্রের বা বিশ্বের কল্যাণে আসতে পারবে না। তাই আমাদের উচিত এই ভয়ানক চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে শিশুদের কাঙ্ক্ষিত শৈশব ফিরিয়ে দিয়ে তাদের শারীরিক, মানসিক, ভাষিক ও চেতনাগত বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া। এর জন্য চাই রাষ্ট্রের সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন।

শিশুদের মাঠ দখলদার দস্যুদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে উচিত শাস্তির ব্যবস্থা করা। পার্ক দখল করে কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের অসুস্থ চর্চাকে শক্তভাবে প্রতিহত করতে হবে। দখল হওয়া সমস্ত মাঠ পুনরুদ্ধার করে সেখানে খেলাধুলা বিনোদনের জন্য সবুজ মাঠ নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে।

সংস্কৃতিচর্চার জন্য আধুনিক থিয়েটার নির্মাণের পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতিচর্চায় তাদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। শিশুর বিকাশের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত জায়গায় প্রশিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। উন্নত গ্রন্থাগার ও পাঠাগার নির্মাণে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহিত করতে হবে এবং সুযোগ দিতে হবে।

শিশুদের একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যোগ্য ও আধুনিক করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই শিশুরা আমাদের একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাতে পারবে।

শান্তা তাওহিদা ।। চেয়ারপার্সন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়