দালাল ও সিন্ডিকেট জটিলতায় তিন বছর ধরে বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও গত এক বছরে ২১ হাজার আনডকুমেন্টেড (কাগজপত্রহীন) বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে দেশটি। এরই মধ্যে সুসংবাদ পাওয়া গেল, বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ফের চালু হচ্ছে মালয়েশিয়ার বন্ধ দুয়ার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে কুয়ালালামপুরে আনুষ্ঠানিক মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করা হবে।

এমন এক আশা জাগানিয়া খবরের মধ্যে এসেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য-‘শতবর্ষে জাতির পিতা, সুবর্ণে স্বাধীনতা/অভিবাসনে আনবো-মর্যাদা ও নৈতিকতা’।

বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। দালাল ও সিন্ডিকেট জটিলতায় দীর্ঘ তিন বছর বন্ধ থাকার পর গত ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে অনুমোদন দেয় মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ থেকে সব পেশার শ্রমিক নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে দেশটি। বিশেষ করে গৃহকর্মী, বাগান, কৃষি, উৎপাদন, পরিষেবা, খনি ও খনন এবং নির্মাণ খাতে বাংলাদেশি কর্মী নেবে দেশটি। মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে কোনো সিন্ডিকেট থাকবে না এবং সকল এজেন্সির জন্য মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো উন্মুক্ত থাকবে বলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, এমপি হুশিয়ারি করেছেন। এবার সরকার চাইছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর খরচ যত কম রাখা যায়। দুই কিংবা দেড় লাখ টাকার নিচে নিয়ে আসতে চায় অভিবাসন খরচ।

স্বচ্ছ পন্থায় পরিচ্ছন্ন কাজে কর্মী পাঠাতে ঢাকা-কুয়ালালামপুর দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করার লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ আজ (শনিবার) রাতেই মালয়েশিয়ার উদ্দেশে উড়াল দেওয়ার কথা রয়েছে। কোনো ব্যত্যয় না ঘটলে আগামীকাল স্থানীয় সময় সকালে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে উক্ত এমওইউ স্বাক্ষর হবে।

গণমাধ্যমের খবর, আগের চেয়ে এবারের সমঝোতা স্মারকে কিছু বিষয় পরিবর্তন আসছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—জিটুজি (সরকার-সরকার) প্লাস পদ্ধতি উল্লেখ থাকছে না। যুক্ত হচ্ছে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সি। কর্মীদের বাধ্যতামূলক বীমা থাকছে। কর্মীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা ও খরচ বহন করবে নিয়োগদাতা। চুক্তি মেয়াদে কর্মীদের দায়িত্ব নিতে হবে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সিকেও। বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত।

বৈধ কাগজপত্র না থাকায় গত এক বছরে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন ২১ হাজার ৬৮ জন বাংলাদেশি। তারা সেখানে অবৈধভাবে অবস্থান করছিলেন বলে জানিয়েছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ। ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট দেড় লাখ বিদেশিকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া। দেশটির অভিবাসন বিভাগ রিক্যালিব্রেশন (রিটার্ন) কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের ফেরত পাঠায় এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে আনডকুমেন্টেড বাংলাদেশি কর্মীদের পুনর্বাসন নিয়েও আলোচনা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সকল সদস্যভুক্ত দেশে পালিত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৪ ডিসেম্বর, ২০০০ সালে দিনটি বিশ্বব্যাপী উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ব্যাপক হারে অভিবাসন ও বিপুলসংখ্যক অভিবাসীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে ঘিরেই এ দিবসের উৎপত্তি। ১৯৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অভিবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং তাদের পরিবারের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক চুক্তি ৪৫/১৫৮ প্রস্তাব আকারে গ্রহণ করে।

১৯৯৭ সাল থেকে ফিলিপিনো এবং অন্যান্য এশীয় অভিবাসী সংগঠনগুলো দিবসটি পালন করতে শুরু করে। শুরুর দিকে তারা ১৮ ডিসেম্বরকে নির্ধারণ করে এবং অভিবাসীদেরকে ঘিরে ‘আন্তর্জাতিক ঐক্য দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ অভিবাসী শ্রমিক ও দেশে রেখে আসা তাদের পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছিল।

এর প্রেক্ষাপটে ১৮ ডিসেম্বর দিনটিকে লক্ষ্য করে মাইগ্রেন্ট রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন মাইগ্রেন্টস রাইটসসহ বিশ্বের অনেক সংগঠন অভিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার্থে বৈশ্বিকভাবে প্রচারণা চালায়। অবশেষে ১৯৯৯ সালের শেষার্ধে অনলাইনে ব্যাপক প্রচারণার ফলে জাতিসংঘের মুখপাত্র এ দিবসটিকে ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হন।

আমাদের অভিবাসন খাতটি এখনো নানা কারণে ভঙ্গুর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর সমস্যাগুলো সংশ্লিষ্ট সবারই জানা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা সমাধানে অধিকাংশই ঠোঁট কিংবা কাগুজে বক্তব্য থেকে যাচ্ছে। এর মধ্যে—

১. দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ : সারাদেশে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) পরিচালিত সরকারি অর্ধশতাধিক কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরে নির্মিত টিটিসিগুলো অবকাঠামোগত ভাবে মজবুত ও বহুবিধ কাজের উপযোগী হলেও পুরনো টিটিসিগুলোর অবস্থা উল্টো। বিশেষ করে করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মীর দিকে নজর সবার। গন্তব্য দেশগুলোর অনেকেরই অর্থনৈতিক দুরবস্থা বিরাজমান। এ পরিস্থিতিতে তারা নিজ দেশের কর্মীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বিদেশি কর্মী নিয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। যেসব দেশ ভিনদেশি কর্মী নিচ্ছে বা নিয়োগ দিচ্ছে তারা শুধু দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও ভাষা জানা লোকদের বেলায় ‘হ্যাঁ’ বলছে। অন্যথায় ‘না’ বলছে। বাংলাদেশি কর্মীরা এ তিন সীমাবদ্ধতার কারণে বিদেশ যেতে পারছে না কিংবা গেলেও অধিক শ্রমে কম মজুরি পাচ্ছে। টিটিসিগুলোর কারিকুলামও অনেকটা সেকেলে। গন্তব্য দেশের চাহিদা পূরণে সক্ষম হচ্ছে না। আরবিসহ বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার পদ্ধতিও যুগোপযোগী না হওয়ায় অনেক গমনেচ্ছু বিদেশ যেতে পারছে না বা গেলেও উপযুক্ত কাজ ও বেতন থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। 

২. অভিবাসন ব্যয় : এ খাতের বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, বিশ্বের অন্য সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যয় সবচেয়ে বেশি। সরকারও তা খুব জোর গলায় অস্বীকার করতে পারে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটা দাবি বেশ জোরালো হয়েছে, সরকারি পর্যায়ে আলোচনা ও দর কষাকষির মাধ্যমে শূন্য অভিবাসন ব্যয় করতে হবে এবং অভিবাসন ব্যয় মালিককে (চাকরিদাতা) নির্বাহ করতে হবে।

৩. অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা ও মর্যাদা : এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী কর্মী ও সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলোর দাবি হলো, নারী-পুরুষ সকল অভিবাসী শ্রমিকের মর্যাদা মানুষ ও শ্রমিক হিসেবে সর্বাবস্থায়, সবখানে দেশে ও বিদেশে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অভিবাসী গৃহ শ্রমিকের কাজকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেনশন ১৮৯ অনুযায়ী কর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নারী অভিবাসী শ্রমিকের কর্মঘণ্টা প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা হতে হবে। দৈনিক নির্ধারিত কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত সময়ের কাজের মজুরি দ্বিগুণ করাসহ দেশে-বিদেশে সকল নারী শ্রমিকের নির্ধারিত শ্রমঘণ্টার মজুরি আইএলও কনভেনশন অনুসারে দিতে হবে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে নারী কর্মী না পাঠানোর দাবিও উঠেছে। শুধু কর্মস্থলে নয়, নিজ দেশেও অনেক সময় মর্যাদাহানি হচ্ছে তাদের। হালের বলদ কিংবা ভিটেমাটি বিক্রি করে প্রিয়জনদের ফেলে দূরদেশে গিয়ে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ডলার উপার্জন করে। তা দিয়ে তাদের পরিবারের সচ্ছলতার সাথে সাথে দেশের অর্থনীতির চাকাও ক্রমশ গতিশীল হচ্ছে, রেকর্ড রিজার্ভ অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এসব রেমিট্যান্স সৈনিকরা যখন বাংলাদেশে আসে, তখন তাদের লাগেজ বহন করার মতো একটা ট্রলিও বিমানবন্দরে পাওয়া যায় না- এমন কষ্টের কথা প্রবাস ফেরতরা প্রায়ই উচ্চারণ করে থাকে। তাদের সম্পর্কে নীতি নির্ধারকদেরও বিরূপ মন্তব্য করার নজির রয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি হয়ে পড়েছে। 

৪. ডাটাব্যাংক : বলা হয়ে থাকে, বর্তমানে বিশ্বের ১৬২টি দেশে প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি বাস করছেন। এর মধ্যে বড় অংশই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত। কিন্তু তার কোনো ডাটাব্যাংক নেই। দেশে এবং বিদেশে সমূহ বিপদ থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে গুচ্ছ তথ্য-উপাত্ত সময়ের দাবি। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে অনেকটা সহজেই জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ডাটাব্যাংক তৈরি করতে পারে। এতে করে বিদেশগামী, প্রবাসী ও রেমিট্যান্স আহরণের একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যেতে পারে। বিএমইটি’র সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যায়, করোনা দুর্যোগে সামান্য ভাটার টান লাগায় বিদেশে লোক যাতায়াত বেড়েছে। শুধু নভেম্বরে মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৩ জন কর্মী। যা চলতি বছরে মাস হিসেবে বিদেশে কর্মী যাওয়ার রেকর্ড গড়েছে। কিন্তু এর মধ্যে আগামীতে কেউ ফিরে আসলেও তার কোনো তথ্য বিএমইটির ভাণ্ডারে কেবল সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ৫ হাজার ৩৩১ জন মৃত প্রবাসী কর্মীর প্রতি পরিবারকে ৩ লাখ টাকা করে মোট ১৫৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮৮ হাজার ৭৮২ টাকা আর্থিক অনুদান দিয়েছে বলে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারা পেল? কীভাবে পেল? প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, ঢাকা এয়ারপোর্টের ওয়েবপেইজে আপলোডকৃত উক্ত পরিসংখ্যান শিটে সুবিধাভোগীদের নাম-ঠিকানা নেই। এতে অনিয়মের গন্ধ পাওয়া যায়। সুবিধাভোগী পুরো নাম-ঠিকানাসহ হতভাগ্য মৃত প্রবাসী কর্মীদের পাসপোর্ট নম্বর দিতে বাধা কোথায়?

৫. দিবস পালনে কম গুরুত্ব : প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স জাতীয় অর্থনীতির বুনিয়াদ হিসেবে গণ্য হলেও আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস হলো ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত দিবস। সর্বশেষ সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত বিশেষ বিশেষ খাতের দিবসগুলো প্রতীকীভাবে পালন করা হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা এতে উপস্থিত থাকবেন কিন্তু এর জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। যদিও এবার আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উদযাপনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয় থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মোট ৩২ লাখ ২৮ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অবশ্য ঢাকায় কেন্দ্রীয় আয়োজনের কোনো বাজেটের তথ্য জানা না গেলেও কেবল আমন্ত্রণপত্র ছাপা ও বিতরণ বাবদ ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দের কথা জানা যায়। অভিবাসনের সাথে মানবপাচারের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হলেও তা কমই গুরুত্ব পায়। নিরাপদ অভিবাসন, বৈধ পথে বিদেশ গমন ও রেমিট্যান্স প্রেরণ ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা অপরিহার্য হলেও তা বৃহৎ পরিসরে হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে এসব বিষয়ে বহুমাত্রিক ও ব্যাপক প্রচারের সুযোগ থাকলেও তা কাজে লাগানো হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

৬. বিমান ভাড়া বৃদ্ধি : অভিবাসন ব্যয়ের সাথে সাথে বিমান ভাড়া বিদেশ গমনেচ্ছু বিশেষ করে কর্মীদের জন্য ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’। করোনা মহামারির মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ফ্লাইটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিমানসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্স দুই থেকে তিন গুণ ভাড়া বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ করছেন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকরা। এর প্রতিবাদে তারা ইতিমধ্যে রাস্তায়ও নেমেছেন। সম্প্রতি মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ৩০-৪০ হাজার টাকার উড়োজাহাজের টিকিটের মূল্য ৭০-৯৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। অথচ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা হতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে উড়োজাহাজের টিকেটের মূল্য ২০-৩০ হাজার টাকা।

বিমানের টিকিটের দাম এভাবে বাড়াতে মধ্যপ্রাচ্যগামী রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আর্থিকভাবে চরম বিপাকে পড়েছেন। হাজার হাজার মধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মীর ভিসা ও ছুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিমানসহ মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানো না গেলে হাজার হাজার নতুন ভিসাপ্রাপ্ত এবং ছুটিতে দেশে আসা রেমিট্যান্স যোদ্ধারা চাকরি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

৭. নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি : যেকোনো সময় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হবে-সেটা আশা করা যায়। সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে পেশাজীবী নিতে আগ্রহী। জার্মানিতে বাংলাদেশি নার্সদের বিপুল সুযোগ রয়েছে। জর্ডানের গার্মেন্টস শিল্পে তো বাংলাদেশি কর্মীদের প্রচুর চাহিদা ও কদর। বাংলাদেশি নারী কর্মীরা পরিশ্রমী হওয়ায় এ চাহিদা ও কদর। ইউরোপের দেশ গ্রিসও বাংলাদেশ থেকে মেডিকেল টেকনিশিয়ান, কেয়াগিভার, নার্সসহ বিভিন্ন খাতে কর্মী নেবে বলে ইতিমধ্যে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এ বিষয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রিসের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হওয়ার কথা রয়েছে। ইউরোপের কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এমওইউ নেই। গ্রিসের সাথে এমওইউ হলে সেটা বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই ইউরোপের বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।

৮. গবেষণা ও প্রচারণার অভাব : প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা বিভাগ ও প্রচারণা বাবদ বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও তা পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে খুব একটা কাজে আসছে না। গবেষণা বিভাগে জনবল সংকটের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ না থাকায় গতানুগতিক পদ্ধতিতে নতুন নতুন শ্রমবাজার আবিষ্কার করা হলেও সেখানে প্রবেশাধিকারের উপায় সম্পর্কে পথরেখা পাওয়া যায় না। বিদেশগামীদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা প্রসেসিং, কাজ বাছাই, মধ্যস্বত্ত্বভোগী বা দালালদের দৌরাত্ম্য থেকে শুরু করে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক ও টিটিসি সম্পর্কে মানুষকে জানানো ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে যথেষ্ট প্রচারণার অভাব রয়েছে।

আলোচ্য সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে। কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। অভিবাসীরা প্রবাসে বাংলাদেশের ভ্রাম্যমাণ দূত। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অভিবাসী কর্মীদের প্রতি সংবেদনশীল ও সন্তোষজনক আচরণ করা হয় সবসময়ই। বর্তমান সরকার জাতীয় অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত্তি ব্যক্তি হিসেবে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মানে ও সমীহ করে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পীড়াদায়ক আচরণ রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোর বিরুদ্ধেও অভিবাসী-প্রবাসীদের অসহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, পাকিস্তানিদের শোষণ-বঞ্চনার শিকল ছিন্ন করা স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরে যা কিছু অর্জন তাতে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের রক্ত-ঘামও রয়েছে। তাদের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার বদৌলতেই ভয়ংকর করোনা দুর্যোগের পরও রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। অভিবাসন খাতের বিদ্যমান সমস্যার পর্যায়ক্রমিক টেকসই সমাধান এবং সকল রেমিট্যান্স যোদ্ধা নারী-পুরুষের অবদানের কথা স্বীকার করা ও তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হোক - এটাই আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ২০২১ এর প্রত্যাশা।

সাদেকুর রহমান ।। গবেষক