ছবি : সংগৃহীত

মানুষকে বলা হয়ে থাকে সৃষ্টির সেরা জীব। একথা বলার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানুষ সৃষ্টিশীল। সৃজনশীলতাই মূলত মানুষকে অন্যান্যদের থেকে আলাদা করেছে। জন্মগতভাবেই মানুষ তাই সৃজনশীল এবং এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সাধারণত লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে মানুষের সহজাত এই সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। তবে শর্ত হলো, উক্ত লেখাপড়া হতে হবে আনন্দপূর্ণ, সৃজনশীল তথা শিক্ষার্থীবান্ধব।

যদি এর ব্যতিক্রম ঘটে, তাহলে শিশুর সৃজনশীলতার যথেষ্ট বিকাশ সাধন হবে না অথবা সার্বিক বিকাশে ঘাটতি পরিলক্ষিত হবে। সুতরাং একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশে আনন্দপূর্ণ ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণই নয়, এটি নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। 

বাংলাদেশের দিকে যদি দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তাহলে স্পষ্টতই দেখতে পাই যে, এখানে শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে যেভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে তার মধ্য দিয়ে শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

বর্তমানে প্রচলিত পঠন—পাঠন ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা হিসেবে যে পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেটাকে আর যাই হোক শিক্ষার্থীবান্ধব বা শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা কোনোভাবেই সম্ভবপর হচ্ছে না।

যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণা না করে, কোনো ব্যক্তি বিশেষের ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন যে সুফল বয়ে আনে না, বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের চাহিদাকে প্রাধান্য না দিয়ে, আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে, শিক্ষকদের বিদ্যমান জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় না নিয়ে, দেশ-বিদেশ থেকে একধরনের আমদানিকৃত ধারণাকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। আর সেই কারণেই ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। আজ একরকম পদ্ধতি, কিছুদিন পর অন্যরকম, এভাবেই দিনের পর দিন চলছে। যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণা না করে, কোনো ব্যক্তি বিশেষের ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন যে সুফল বয়ে আনে না, বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষাক্রমকে বলা হয়ে থাকে যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা তাদের নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো পুরোপুরি অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের আমরা শুধুমাত্র পরীক্ষার্থী হিসেবে তৈরি করছি, শিক্ষার্থী হিসেবে নয়। এর মূল কারণ যদি আমরা অনুসন্ধান করি তাহলে দেখতে পাই যে, প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থা তথা পরীক্ষা পদ্ধতিতে গলদ রয়েছে।

শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন যাই করা হোক না কেন, মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সেই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার ধারা তথা মাইন্ডসেট থেকে আমরা এখনো বের হতে পারছি না। যতই যোগ্যতা ভিত্তিক কিংবা সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্তির কথা বলি না কেন পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগের ধারারই পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদেরকে তোতাপাখির ন্যায় সেই মুখস্থ বিদ্যা, সগৌরবে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বানানো, রোল নম্বর প্রথা বলবৎ রাখা, বাজারে সৃজনশীল গাইড বইয়ের সন্ধান পাওয়া প্রভৃতি চালু রেখে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা কেবলই খাতা—কলমেই সম্ভব, বাস্তবে নয়।

বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের মধ্যে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি সেখানে মূল টার্গেটই হচ্ছে, পরীক্ষায় ভালো নম্বর অর্জন করা এবং পাস করার পর ভালো চাকরি পাওয়া। এখানে আনন্দের তেমন কোনো স্থান নেই অথচ নতুন কিছু জানা বা শেখা যে কত আনন্দের বিষয় সেটা ন্যূনতম কয়জন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে তা বুঝতে খুব বেগ পেতে হয় না। 

বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের মধ্যে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি সেখানে মূল টার্গেটই হচ্ছে, পরীক্ষায় ভালো নম্বর অর্জন করা এবং পাস করার পর ভালো চাকরি পাওয়া। এখানে আনন্দের তেমন কোনো স্থান নেই।

একটি শিশুর সুন্দর শৈশবকে, নির্মল আনন্দ ও বিনোদনকে সক্রিয় বিবেচনায় না নিয়ে তাদেরকে আমরা শুধুমাত্র বইয়ের ব্যাগের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি এবং পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করছি।

পরীক্ষায় ভালো ফল করলে বাহবা, আর খারাপ করলে বকা দিচ্ছি। এমনি করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সুন্দর ও অমিত সম্ভাবনাময় একটি জীবনকে ভালো ফলাফল করা তথা শিক্ষা দেওয়ার অজুহাতে বরং বিষিয়ে তুলছি এবং অনেক ক্ষেত্রেই ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছি। এতে করে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে অকালে ঝরে পড়ছে, অনেকেই আবার সমাজ তথা অভিভাবকদের চাপে একটি আনন্দহীন জীবনের ঘানি টানছে। আর এভাবেই তাদের জন্মগত তথা সহজাত সৃজনশীলতার বিকাশ সাধনে ব্যাঘাত ঘটছে এবং তাদের সুপ্ত প্রতিভা তথা আনন্দময় শৈশবের অকাল মৃত্যু ঘটছে। 

পক্ষান্তরে, আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই আনন্দময়, সৃজনশীল এবং শিক্ষার্থীবান্ধব একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে পারতাম, তাহলে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া যেমন অনেকাংশেই দূর করা সম্ভব হতো, সেই সাথে সাথে আনন্দের মাধ্যমে নতুন কিছু শেখার এবং সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগের মধ্য দিয়ে তাদেরকে একটি বর্ণাঢ্য ও আনন্দপূর্ণ জীবনের পথে ধাবিত করার সুযোগ সৃষ্টি হতো।
আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নতুন প্রজন্মকে সুন্দর, সৃষ্টিশীল, আনন্দপূর্ণ এবং শিক্ষার্থীবান্ধব একটি শিক্ষাব্যবস্থা উপহার তথা নিশ্চিত করতে পারলে, পরবর্তীতে এরাই আমাদেরকে সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তথা সোনার বাংলা উপহার দেবে এ বিষয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। 

ড. তাপস কুমার বিশ্বাস ।। অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়