ছবি : সংগৃহীত

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আইনের আলোকে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে যাচ্ছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও এতদিন কোনো সরকারই আইনটি প্রণয়ন করেনি। এতদিন আইনটি প্রণয়ন না করার দায় বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা সবগুলো দলকেই নিতে হবে।

টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় আছে বলে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন না করার জন্য আওয়ামী লীগকেই বেশি কথা শুনতে হচ্ছিল। তবে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বর্তমানে সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং মাঠের বিরোধী দল বিএনপিও বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তারাও অতি জরুরি এই আইনটি করেনি। তাই আইনটি না করার দায় সবার।

গত কয়েক দশক ধরে, নির্বাচন কমিশন গঠনের ঠিক আগে আগে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন নিয়ে আলোচনা হয়। সবার অবস্থানই থাকে আইনের পক্ষে। এমনকি ক্ষমতাসীনরাও কখনো আইনটি করার বিরোধিতা করেননি। কিন্তু তারপরও আইনটি হচ্ছিল না। ক্ষমতাসীনরা আইনটির পক্ষে থাকলেও শেষ মুহূর্তে সময়ের স্বল্পতার কথা বলে এড়িয়ে যেতেন। এবারও এড়িয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিই তৈরি হচ্ছিল।

নির্বাচন কমিশনকে সামনে রেখে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করেন। সেই সংলাপে অধিকাংশ দলই নির্বাচন কমিশন গঠনে আইনের কথা বলেছিলেন। তবে আইনমন্ত্রী একাধিকার বলেছিলেন, সময়ের স্বল্পতায় এবারও আইনটি করা সম্ভব নয়। আগামীবার আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে শেষ মুহূর্তে হুট করেই সরকার আইন করার উদ্যোগ নেয়। এবং অকল্পনীয় দ্রুততায় আইনটি পাস হয়ে যায়।

গত ২৭ জানুয়ারি সংসদে আইনটি পাস হওয়ার ১০ দিনের মাথায় আইন অনুযায়ী বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে প্রধান করে ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি প্রতিটি পদের বিপরীতে ২ জন করে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে। প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন।

এতদিন সবার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে একমাত্র বাধা নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো আইন না থাকা। আইন হলেই যেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

এতদিন সবার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে একমাত্র বাধা নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো আইন না থাকা। আইন হলেই যেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু আইনটি হওয়ার উদ্যোগের শুরু থেকেই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো এ আইনের বিরোধিতা করতে থাকে।

আইন করলেও সমস্যা, না করলেও সমস্যা। এক লোক ভুল করে আরেকজনের ফসলি জমির ওপর দিয়ে হেঁটে মাঝ বরাবর চলে গিয়েছিলেন। এমন সময় জমির মালিক দেখে তেড়ে আসেন। লোকটি ভয়ে জমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, আমি কি বাকি পথটুকু পেরিয়ে যাব? মালিক বললেন, না। লোকটি বললেন, তাহলে কি আমি যে পথে এসেছি সে পথে ফিরে যাব? মালিক বললেন, না। লোকটি বললেন, তাহলে আমি কী করব? জমির মালিক রেগে গিয়ে বললেন, আপনি কীও করতে পারবেন না। সরকার অবস্থাও হয়েছে তাই।

বিএনপি আইনের বিরোধিতা করলেও কীভাবে আইনটি করা উচিত ছিল তারও কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দেয়নি। বিএনপি এখন নির্বাচন কমিশনের চেয়ে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বেশি চিন্তিত। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু তার জন্য তো নির্বাচন কমিশন আটকে থাকতে পারে না।

আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় অনেক সমস্যা আছে। একটা একটা করে সবগুলোরই সমাধান করতে হবে। রাতারাতি সবকিছু বদলে যাবে, এমনটা আশা করা বাস্তবতা নয়।

আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় অনেক সমস্যা আছে। একটা একটা করে সবগুলোরই সমাধান করতে হবে। রাতারাতি সবকিছু বদলে যাবে, এমনটা আশা করা বাস্তবতা নয়।

তবে এটা ঠিক, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আইনটির ব্যাপারে সরকার কিছু কাজ করেছে। প্রথম কথা হলো, তাড়াহুড়ো। ৫০ বছর প্রতীক্ষার পর আইনটি করা হলো, কিন্তু সংশ্লিষ্ট সবার সাথে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই। আইন পাসের আগে সংসদে আলোচনা হয়েছে, বিরোধী দলের আনা দুয়েকটি সংশোধনী গ্রহণও করা হয়েছে। তবে তাতে আইনটির মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি।

সরকার যেভাবে চেয়েছিল, প্রায় সেভাবেই আইনটি পাস ও কার্যকর হয়েছে। এটা ঠিক, ৫০ বছর প্রতীক্ষার পর পাওয়া আইনটি পূর্ণাঙ্গ নয়। স্রেফ নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢালা হয়েছে। আগের দুটি নির্বাচন কমিশন যেভাবে গঠিত হয়েছিল, এবারও তাই হতে যাচ্ছে। খালি আগের দু’বার সার্চ কমিটি গঠনের কোনো আইন ছিল না। এবার সেটি আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

নতুন আইনে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান তো রাখা হয়েছেই, পাশাপাশি আগের দুটি সার্চ কমিটিকেও বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এটা ঠিক, আগে রাষ্ট্রপতি তার এখতিয়ার অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন করতেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান প্রথম সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেন।

বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদও তার পূর্বসূরির পথ অনুসরণ করেন। রাষ্ট্রপতি সরাসরি নিয়োগ করার চেয়ে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারত। কিন্তু সমস্যা হলো, সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত হওয়া দুটি নির্বাচন কমিশনের অধীনেই ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দুটি অতি বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে। তাই সার্চ কমিটিকে বড় অগ্রগতি হিসেবে কেউ আমলে নেয়নি।

এবারও সেই সার্চ কমিটির আলোকেই নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে যাচ্ছে। তবে এবার আইনের আলোকে। গতবারও সার্চ কমিটির প্রধান ছিলেন আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। এছাড়া পদাধিকারবলে ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং পিএসসির চেয়ারম্যান। আর বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে ছিলেন দুজন শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও শিরিন আক্তার। এবারও সার্চ কমিটির প্রথম চারটি নাম এসেছে পদাধিকারবলে। আর দুই বিশিষ্ট নাগরিক হলেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন এবং কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। এদের মধ্যে ছহুল হোসাইন ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন।

এই কমিটি ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে নামের তালিকা দেবে। তাতে তারা ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় পাবেন। অবশ্য বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি। সার্চ কমিটি তাদের জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ সময় নিলে অন্তত ১০ দিন নির্বাচন কমিশন খালি থাকবে। অবশ্য চাইলে সার্চ কমিটি আগেও তাদের নামের তালিকা জমা দিতে পারে।

সার্চ কমিটি আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তাদের প্রস্তাবনা চেয়েছে। চাইলে যে কেউ নিজেদের প্রস্তাব দিতে পারবে সার্চ কমিটির কাছে। কমিটি সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠক করবেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকের কোনো পরিকল্পনা নেই সার্চ কমিটির।

বর্তমান বাস্তবতায় ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপেও অংশ নেয়নি। এরই মধ্যে তারা জানিয়ে দিয়েছে, সার্চ কমিটির কাছে নামের তালিকা দেওয়ার কোনো ইচ্ছাও তাদের নেই। তার মানে আইনের আওতায় হলেও পরবর্তী কমিশন হতে যাচ্ছে একতরফা, কোনোরকম সমঝোতা ছাড়াই। আগের সার্চ কমিটিতে বিএনপি অংশ নিয়েছিল বলেই বিদায়ী কমিশনে একজন ‘মাহবুব তালুকদার’ ছিলেন। নতুন কমিশনে তেমন কারো থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। 

নির্বাচন কমিশনের হাতে এমনিতেই যে ক্ষমতা, চাইলেই তারা সরকারের সব চাওয়া উপেক্ষা করে ভালো নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনাররা তাদের সে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন না...

বিএনপির অনড় অবস্থানে একটা বিষয় পরিষ্কার, নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো সমঝোতা হচ্ছে না, তাই রাজনৈতিক জটিলতাও মিটছে না। এখনই এই জটিলতাটুকু মিটিয়ে রাখতে পারলে আগামী ২০২৩ বা ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের সময়কার সম্ভাব্য জটিলতা অনেক কমে যেতে পারত। এখন মনে হচ্ছে, অচলাবস্থা নিয়েই আমরা পরবর্তী নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইন থাকা দরকার ছিল। যেমনই হোক বর্তমান সরকার একটি আইন করেছে, সে জন্য অবশ্যই তারা ধন্যবাদ পাবেন। আইনটা অবশ্যই জরুরি। তবে আইনের চেয়ে আস্থা জরুরি। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবগুলো দল মিলে সবকিছু ঠিক করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো।

ধরুন, এবারও আইনটি হয়নি। আগের দু’বারের মতো এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। তাতেও কিন্তু কোনো উনিশ-বিশ হবে না। আইন করা না করায় আসলে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসছে না। সার্চ কমিটি খুঁজে পেতে তো কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ আর কে এম নুরুল হুদাদেরই বের করেছিল। এবারকার সার্চ কমিটি আইনের আওতায় গঠিত হয়েছে। কিন্তু তারা তো মঙ্গল গ্রহ থেকে লোক খুঁজেছ আনবেন না। এই বাংলাদেশ থেকে এই রকিব, হুদাদের হাতেই দিতে হবে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।

নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের শুরুটা হয়েছিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে, শেষটা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ দিয়ে। এতে প্রমাণিত হয়েছে কমিশন চাইলে ভালো এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু মাঝখানের সময়টায় তারা বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকেই কলঙ্কিত করেছে।

নির্বাচন কমিশনের হাতে এমনিতেই যে ক্ষমতা, চাইলেই তারা সরকারের সব চাওয়া উপেক্ষা করে ভালো নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনাররা তাদের সে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন না বা আদৌ তাদের হাতে যে অঢেল ক্ষমতা আছে সেটা তারা জানেনও না।

এখন সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশনের জন্য নতুন যাদের খুঁজে আনবেন, তারা যদি দৃঢ় চরিত্রের হন, তারা যদি কে ক্ষমতায় আছেন না আছেন, সেটা বিবেচনা না করে আইনের আওতায় নিজেদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের বিপথে যাওয়া গণতন্ত্র আবার ট্র্যাকে ফিরতে পারে। সার্চ কমিটি সার্চ করে তেমন মেরুদণ্ডওয়ালা মানুষ খুঁজে পান কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ