ছবি : সংগৃহীত

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে!’—মধ্যযুগে দেবী দুর্গার কাছে বর চেয়েছিলেন ঈশ্বরী পাটনী। ‘দুধ-ভাত’ এখানে ভালো থাকার রূপক। একটি জাতির ‘ভালো থাকা’ মানে তার টেকসই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আত্মিক উন্নতি হওয়া। এই উন্নতির সঙ্গে ভাষার স্বীকৃতির প্রশ্ন জড়িত।

একটি ভাষার কমপক্ষে চার ধরনের স্বীকৃতি থাকতে পারে—সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক। ইংরেজি বা ফরাসি ভাষার চার ধরনের গ্রহণযোগ্যতাই আছে। চট্টগ্রামের ভাষার গ্রহণযোগ্যতাও নেই। বাংলা ভাষার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জিত হয়েছিল মধ্যযুগে, বাংলা যখন রাজদরবারে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।

বাংলাদেশের শিশুরা কেউ লেখাপড়া করে ইংরেজিতে, কেউ উর্দু-আরবিতে, কেউ বাংলায়। এর মানে হচ্ছে, বাংলা ভাষা শিক্ষার সর্বজনীন মাধ্যম নয়।

একটি ভাষা রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে, ভাষাটি যখন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। কাগজে-কলমে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল ১৯৪৮-১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!’ হায়! যে ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, তাকে আমরা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বানিয়ে আহ্লাদে অষ্টখণ্ড হচ্ছি, যখন কি না কাজে-কর্মে বা ডি ফ্যাক্টো বাংলা এখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠেনি। ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি!’

বাংলাদেশের শিশুরা কেউ লেখাপড়া করে ইংরেজিতে, কেউ উর্দু-আরবিতে, কেউ বাংলায়। এর মানে হচ্ছে, বাংলা ভাষা শিক্ষার সর্বজনীন মাধ্যম নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা যদি ডি ফ্যাক্টো রাষ্ট্রভাষা না হয়, তবে জাতিগঠন শুরুই হয় না। বাংলা এখনো আদালতের ভাষা নয়, যদিও ধীরে ধীরে প্রশাসনের ভাষা হয়ে উঠছে বটে। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় বিসিএস পরীক্ষা নেওয়া হলে প্রশাসনে বাংলা আবারও পিছিয়ে পড়বে।

‘ব্যবহারবিধি বাংলায় লেখা না থাকলে কোনো পণ্য বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে না’ কিংবা ‘দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায় লিখিত হতেই হবে’—এমন ধারাসহ একটি আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ হবে বাংলা ভাষাকে অর্থনৈতিক স্বীকৃতির প্রদানের পথে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদক্ষেপ।

বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীর অন্য জাতি বাংলা শিখবে, ঠিক যেভাবে লোকজন উর্দু, ফরাসি বা ইংরেজি শিখে। এর জন্য বিদেশিদের বাংলা শেখানোর জন্য পারঙ্গম শিক্ষক তৈরি করতে হবে, তৈরি করতে হবে উপযুক্ত কারিকুলাম।

পৃথিবীর বড় শহরগুলোতে শান্তি নিকেতনের বাংলাদেশ ভবনের আদলে প্রতিষ্ঠা করতে হবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রচার কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে বাংলা শিখে বিদেশিরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে জানবে, কেউ কেউ হয়তো বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সৃষ্টিগুলোকে অনুবাদ করবে তাদের মাতৃভাষায়।

কানাডার কুইবেকের ফরাসি ভাষা আইনের আদলে একটি বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই আইনে একটি বাংলা ভাষা প্রচলন কমিশন গঠনের ব্যবস্থা থাকবে। (অনেকটা নির্বাচন কমিশনের মতো) এই ভাষা কমিশন সরকারের অধীন হবে না, রাষ্ট্রপতির অধীন হবে। প্রতি পাঁচ বছরের জন্য যোগ্য কোনো নাগরিককে ভাষা কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত করবেন রাষ্ট্রপতি। ভাষা বিষয়ে আগ্রহী, অভিজ্ঞ, সম্মানিত নাগরিকেরা হবেন ভাষা কমিশনের সদস্য।

দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে বাংলা ভাষা কমিশনের অফিস থাকবে। ভাষা কমিশনের মূল দায়িত্ব হবে বিচার, শাসন, দেশরক্ষা, শিক্ষা, ব্যবসাসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার উপযুক্ত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও নিশ্চিত করা।

পাঠ্যবই ও আইনের অনুবাদ করা, প্রতিশব্দ তৈরি করা থেকে শুরু করে বাংলা প্রচলনে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করা ইত্যাদি হবে বাংলা ভাষা কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা কমিশনের অগ্রগতির প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির নিকট এবং জনসমক্ষে পেশ করতে হবে।

বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে আরও দুটি সংগঠন সৃষ্টির ব্যবস্থা থাকবে, ১. বাংলা প্রচলন (অধি/পরি) দপ্তর এবং ২. বাংলা প্রচলন উপদেষ্টা পরিষদ। বাংলা প্রচলন আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকবে বাংলা প্রচলন দপ্তর। এই দপ্তর প্রতি বছর বাংলা প্রচলনের অগ্রগতি কিংবা বাংলা প্রচলন করতে গিয়ে উদ্ভূত কোনো সমস্যার ব্যাপারে কমিশনকে অবহিত করবে।

পেশাদার, ডিগ্রিধারী এবং স্বনামধন্য ভাষাবিজ্ঞানীরা হবেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। বাংলা প্রচলনে যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে তারা ভাষা কমিশনের সভাপতিকে পরামর্শ দেবেন।

বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীর অন্য জাতি বাংলা শিখবে, ঠিক যেভাবে লোকজন উর্দু, ফরাসি বা ইংরেজি শিখে। এর জন্য বিদেশিদের বাংলা শেখানোর জন্য পারঙ্গম শিক্ষক তৈরি করতে হবে, তৈরি করতে হবে উপযুক্ত কারিকুলাম।

টোফেল বা আইইএলটিএসের আদলে পেশাদার ভাষাবিজ্ঞানীদের দিয়ে বাংলা ভাষাজ্ঞান পরীক্ষার জন্য একাধিক ধাপবিশিষ্ট পরীক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে। শাসনবিভাগে এমন কোনো আমলা, বিচার বিভাগে এমন কোনো বিচারক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না, যিনি ঐ বাংলা পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল লাভ করবেন না।

ইতিমধ্যে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদেরও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হলে ঐ পরীক্ষায় পাস করতে হবে। নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাজ্ঞানের আবশ্যিকতাকে যদি প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেরি হবে না।

বাংলা ভাষা আইনে পরিষ্কার বলা থাকবে, এই আইনের কোনো ধারা ভঙ্গ করার জন্য কী দণ্ড হবে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় রাখা না হলে কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা না হলে কিংবা ইংরেজি অক্ষরের তুলনায় বাংলা অক্ষর যথেষ্ট বড় না হলেও জরিমানার ব্যবস্থা থাকবে।

সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয়... রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান জরিমানার আওতাভুক্ত হবে। কোনো আমলা, বিচারক, শিক্ষকের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার প্রমাণ যদি পাওয়া যায়, তবে ধরা যাক, তাকে হাজার বিশেক টাকা জরিমানা করতে হবে (কুইবেকের ভাষা আইনে এটা ৫০০ ডলার)। একই ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে জরিমানার পরিমাণ দ্বিগুণ বা তিনগুণ হবে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই জরিমানার হার কয়েকগুণ বেশি হতে পারে।

প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করার চাইতে এর প্রকৃত অসুখগুলো বরং খুঁজে বের করে ঠিকঠাক মতো ওষুধ সেবনের ব্যবস্থা করা গেলে ভাষা ও জাতি উভয়েই উপকৃত হবে। সময় থাকতে বাংলা ভাষাকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার অধিকারী করা গেলে ত্বরান্বিত হবে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন।

বাঙালি যদি সচেতন উদ্যোগ নিয়ে কিছু নাও করে, প্রাকৃতিক নিয়মেই বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠবে একদিন, ঠিক যেভাবে মধ্যযুগের ইউরোপে ল্যাটিনকে হটিয়ে ইংরেজি-ফরাসি-জার্মান রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠেছিল। তবে নিজেরা না করে ভাষার উপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিলে, অনেকগুলো প্রজন্ম ও সময় নষ্ট হবে—এই যা তফাৎ।

শিশির ভট্টাচার্য্য ।। অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়