ছবি : সংগৃহীত

ইতিহাসের জাদুঘর থেকে তুলে আনা কিছু কিছু কথা প্রায় আপ্তবাক্যের মতো; যেমন, বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি, বাঙালি লড়াই করা জাতি, একমাত্র বাঙালিই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে ইত্যাদি। শুনতে অতি মধুর লাগলেও, আদতে সারবত্তাহীন। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাইরে জাতিগতভাবে বাঙালি এই আবেগ দিয়ে গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন খুব বেশি ঘটাতে পারেনি।

আপ্তবাক্যে আবেগ থাকলেও, বাঙালির আবেগ মূলত সাংবাৎসরিক; বাংলা ভাষা বিষয়ক কাঁদো কাঁদো ভাব ফেব্রুয়ারি মাস কেন্দ্রিক। তবু ভালো; কিছু না কিছু তো আছে। এই আবেগের বশেই আমরা ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডকে ‘ভাষার মাসে’ বাংলায় লিখতে বলি। পণ্যের মোড়কে আরবি লেখা দেখে আঁতকে উঠি। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা পড়ানো হচ্ছে কি না, কড়ায় গণ্ডায় তার হিসেব বুঝে নিতে আরম্ভ করি।

আবেগের বশেই আমরা ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডকে ‘ভাষার মাসে’ বাংলায় লিখতে বলি। পণ্যের মোড়কে আরবি লেখা দেখে আঁতকে উঠি। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা পড়ানো হচ্ছে কি না, কড়ায় গণ্ডায় তার হিসেব বুঝে নিতে আরম্ভ করি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা পড়ানো হয় কি না, সে ব্যাপারে দেখা দেয় আমাদের নিশিজাগর দুশ্চিন্তা। সর্বস্তরে বাংলা প্রসারের জন্য আকুল হয়ে ওঠে আমাদের প্রাণ। অথচ আমরা তো জানিই না সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের রূপরেখা কী হবে! 

বছরের সবচেয়ে ছোট মাসটি ফুরিয়ে গেলে আমাদের আবেগ ধাবিত হয় পয়লা বৈশাখের দিকে। বাদ বাকি মাসগুলোতে বাংলা ভাষা বিষয়ক কোনো কাতরতা কিংবা আবেগ থরথর উচ্চারণ দেখা যায় না। বাঙালি তাহলে বছর জুড়ে কী করে? যা-ই করুক না কেন, ভাষা নিয়ে গভীরতর কোনো বাতচিত চোখে পড়ে না। তার জন্য অন্য একটি ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। 

সাইনবোর্ড টাঙানোর সময় বাঙালি ইংরেজিতে অক্ষর সাজায়; প্রতিষ্ঠানের নামটিকে আটকে ফেলে ইংরেজির বন্ধনে। কথা বলতে গিয়ে বাঙালি একটি বাংলা বাক্যের সঙ্গে জুড়ে দেয় পাঁচ-ছয়টা ইংরেজি শব্দ। ছেলেমেয়েদের পড়াতে গিয়ে বাঙালি আভিজাত্যের সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যম বেছে নেয়। বাঙালির আবেগ তখন কোন দেশে থাকে, কে জানে। নাকি আবেগ চলে যায় শীতনিদ্রায়? তখন কাজ করে সামাজিক যুক্তি, বৈষয়িক জ্ঞান। সমাজ পরিচালনার অর্থনৈতিক ভিত্তিমূল বাঙালিকে নির্দেশ দেয় ইংরেজি পড়াও, ইংরেজিতে কথা বলো, ইংরেজিতে লেখো, ইংরেজিতে ভাবো। 

বাঙালি জানে পেশা, ব্যবসা, চাকরির জন্য বাংলা গুরুত্বপূর্ণ ভাষা নয়। হিসাবের খাতাটা ইংরেজিতে লেখা। দোকানের রশিদ ইংরেজিতে লেখা। বিজ্ঞাপনের ভাষা ইংরেজি। প্রযুক্তির গায়ে ইংরেজি। বাংলা তার সামাজিক সম্মানের ভাষাও নয়।

উপরি-কাঠামোর দিকে তাকিয়েও বাঙালি দেখে বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য কম। বাঙালি জানে পেশা, ব্যবসা, চাকরির জন্য বাংলা গুরুত্বপূর্ণ ভাষা নয়। হিসাবের খাতাটা ইংরেজিতে লেখা। দোকানের রশিদ ইংরেজিতে লেখা। বিজ্ঞাপনের ভাষা ইংরেজি। প্রযুক্তির গায়ে ইংরেজি। বাংলা তার সামাজিক সম্মানের ভাষাও নয়।

ইংরেজি কেন্দ্রিক মনস্তত্ত্ব প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্য কোনো ভাষা সেই জায়গায় দাঁত বসাতে পারে না। যদিও সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশে কোরিয়ান পপ সংগীত, চলচ্চিত্র, তুর্কি বা চীনা সিরিজের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু ওই সব ভাষাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণের মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়নি। তাই বলে এটা বলা যাচ্ছে না যে, বাঙালি ইংরেজিতে দারুণ দক্ষ হয়ে উঠেছে।

বিপরীত দৃশ্যই বরং দেখা যায়। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি শব্দ মেশাবার দক্ষতা অর্জিত হলেও ভাষা হিসেবে ইংরেজি অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশের ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য ইংরেজি একটি ভারী বোঝা। আর তাই, বাংলা ও ইংরেজি—দুটি ভাষার ঘাটতি নিয়েই সমাপ্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন।

আসল কথা হলো, বাংলা ভাষা বিষয়ে পরিকল্পিত কোনো রূপরেখা নেই। ভাষানীতি ও ভাষা পরিকল্পনা নেই। ভাষা বিষয়ক আলাপ আলোচনা মানেই বড়জোর প্রমিত বাংলা, বানান, বাংলা একাডেমি প্রসঙ্গ; মাঝে মাঝে মান বাংলাকে ধরে আচ্ছা মতো ধোলাই দেওয়া। আর আছে মান বাংলাবাদীদের নাসিকা-কুঞ্চন।
জাতীয়তাবাদী ঝোঁক যাদের খানিকটা বেশি, এসব বিষয়ের সঙ্গে তারা যুক্ত করে নেন ইংরেজি ভাষার প্রভাব। ব্যস, হয়ে গেল বাঙালির ভাষাভাবনা। কিন্তু ভাবনার জগতে একথা নেই যে, প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত বাংলা শিখেও বাঙালি কেন ঠিকভাবে বাংলা লিখতে পারে না? তাহলে কি বাংলা শিখন-শেখানো কার্যক্রমেই সমস্যা? 

ধরেই নেওয়া হয়েছে, বাংলা পড়ানোর মানে, বাছাই করা সাহিত্য পড়ানো আর ব্যাকরণ শেখানো। মূলত ভাষা শিখনের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ধারণার ব্যবহার ঘটে না বাংলা অধ্যয়নে। শিক্ষার্থীর জীবনে তার প্রভাব হয় দীর্ঘমেয়াদি। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় যতটুকু বাংলা শেখা হয়, সেটুকুই শেষ অবলম্বন হিসেবে থেকে যায়। যতটুকু বাংলা না জানলে মধ্যবিত্তের চলে না, বাঙালির বাংলা অর্জন ঠিক ততটুকুই।

আমরা বাংলা ভাষার প্রসার চাই, অথচ বিভাষীদের জন্য বাংলা শেখানোর জন্য কোনো বন্দোবস্ত করিনি। বাংলাদেশে ভালো মানের অডিও-ভিজুয়াল উপকরণ পাওয়া যাবে না, যা দিয়ে একজন বিদেশি বাংলা শিখতে পারেন। অথচ এমন অনেক বিদেশির দেখা পেয়েছি, যারা বাংলা শিখতে চান, উপকরণের অভাবে তা শেখা হয়ে ওঠেনি।

আদতে বাংলাদেশি শিশুর জন্যও ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে মানসম্মত উপকরণ পাওয়া কঠিন। ছড়া, কমিক বুক, লোকগল্প, শব্দ শেখার বই দিয়ে শিশুর ভাষা শেখার জগতকে আমরা প্রসারিত করিনি। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর পেছনে বাংলা শেখানোর জন্য অর্থ ব্যয় করার চেয়ে সেই অর্থে একজন শিশুর জন্য বাংলা শেখার পথ প্রশস্ত করা বেশি জরুরি। 

আসল কথা হলো, বাংলা ভাষা বিষয়ে পরিকল্পিত কোনো রূপরেখা নেই। ভাষানীতি ও ভাষা পরিকল্পনা নেই। ভাষা বিষয়ক আলাপ আলোচনা মানেই বড়জোর প্রমিত বাংলা, বানান, বাংলা একাডেমি প্রসঙ্গ; মাঝে মাঝে মান বাংলাকে ধরে আচ্ছা মতো ধোলাই দেওয়া।

আবেগের বশে আমরা ভাবি, বাংলাদেশের সব মানুষের ভাষা বাংলা। কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে সত্য হলো, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ছাড়াও অনেক ভাষা প্রচলিত। সেসব ভাষার শিশুদের জন্য বাংলা শেখানোর জন্য রাখা হয়েছে বাঙালি শিশুর মতো বন্দোবস্ত। অথচ তাদের জন্য বাংলা শেখানোর জন্য স্বতন্ত্র বই দরকার। বাংলা রূপকথা, গল্প, শব্দবই দিয়ে সহজতর উপায়ে বাংলা শেখানো যেতে পারে। কিন্তু তার আগে অবশ্যই শিশুর মাতৃভাষা শেখার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্র সে বন্দোবস্ত করেছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো নিয়ে বাঙালির সন্দেহের অন্ত নেই। সাংস্কৃতিকভাবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে আমরা ‘অপর’ করে রেখেছি। মনেই করা হয়, ওখানে কেবল ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা পড়ে। খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে, বাংলা মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীরাই বড় অংশ দখল করে আছে; রাষ্ট্রীয় তৎপরতার প্রভাবে সেখানেও বাংলা পড়ানো হয়। কিন্তু কী পড়ানো হয়? দুঃখের সঙ্গে বলতে হবে, যথাযথ পাঠ্যক্রম সেসব প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়নি। বেশিরভাগ পাঠ্যবস্তু সময়ের চেয়ে অনেক অনেক দূরবর্তী; আর এ কারণে ওই ধরনের সাহিত্যের সঙ্গে সমকালীন প্রজন্ম সংযোগ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ। 

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই কি বাংলা শেখানোর পরিকল্পিত কার্যক্রম চালু আছে? বিভিন্ন বিভাগ বিচ্ছিন্নভাবে বাংলা বিষয়ক কোর্স পড়িয়ে থাকে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিত্তি-ভাষা হিসেবে বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। তবে সেই বাংলাও আনন্দদায়কভাবে পড়ার বাংলা নয়।  

চাকরির পরীক্ষায় বাংলা একটি বিভীষিকা সৃষ্টিকারী বিষয়। সেসব পরীক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত অধিকাংশ পাঠ্যবস্তু অত্যন্ত অযৌক্তিক। মূল্যায়িত দক্ষতা ভবিষ্যৎ পেশাজীবনে খুব বেশি ভূমিকা রাখে না; বাংলা বিষয়ক দক্ষতার প্রয়োগ-ক্ষেত্র প্রায় শূন্য। সে ধরনের পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়নের প্রায়োগিক কোনো মূল্য নেই। সত্যি কথা বলতে, বাংলা বিষয়ের প্রতি সামগ্রিক বিতৃষ্ণা ও ভয় সৃষ্টি করেছে বাংলা পাঠক্রমে।

উচ্চশিক্ষায় বাংলার দশা অত্যন্ত করুণ। এ প্রসঙ্গে কয়েক ধরনের মত পাওয়া যায়; ১. বাংলা ব্যবহৃত হোক। প্রয়োজনীয় পরিভাষা তৈরি করে বাংলায় পুস্তক প্রণীত হোক। ২. বাংলার প্রয়োজন নেই; কারণ ইংরেজিতে পড়তেই হবে। ৩. নির্দিষ্ট কিছু বিষয় বা প্রসঙ্গ পড়ানো যেতে পারে। কারণ অধিকাংশ বই অনুবাদ করতে হবে ইংরেজি ভাষা থেকে। কিন্তু এই নীতিগত সিদ্ধান্ত কে নেবে? সরকার একা? শিক্ষাবিদ? নাকি বিশ্ববিদ্যালয়? 

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ রচনা বাংলায় অনুবাদ করা হবে। অনুবাদের কাজকে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে। বাংলা একাডেমিকে রাখা হয়েছে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের শীর্ষ ভাগে। এও বলা হয়েছে, বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিও ব্যবহার করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইংরেজির পাশাপাশি যাওয়া দূরে থাক, কাছাকাছি যাওয়ার মতো মেরুদণ্ডও বাংলা ভাষার নেই।

সামগ্রিক বক্তব্য এই, বাংলা ভাষার সক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়নি; প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ভাষা নিজেই যে একটি ক্ষমতা, সেই তত্ত্বও বিচার করা হয়নি। ক্ষমতার ভাষা হিসেবে বাংলাদেশের বাংলা ভাষা তার সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দরজায়ও পৌঁছতে পারেনি। তার প্রমাণ বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বরফশীতল সম্পর্ক।

মজার ব্যাপার এই যে, গোপনে বা প্রকাশ্যে ইংরেজি কাতর মধ্যবিত্ত বাঙালিই বাংলা ভাষা বিষয়ক ভাবাবেগে আকুল হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় ও সরকারি আকুলতা পাঁচফোড়ন দিয়ে সেই আবেগকে ঘনীভূত করে। কিন্তু লাউ আর কদুর অবয়ব ও স্বাদ একই রকম থেকে যায়। ভাষা জগতে থেকে যায় অপ্রসারিত বাংলা ভাষার মায়াবী মুখচ্ছবি।

বাংলা ভাষাকে যদি সত্যিই কার্যকরী প্রেক্ষাপটে দেখতে চাই, তাহলে ভাষানীতি ও ভাষা-পরিকল্পনা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অবশ্যম্ভাবী। ভাষার প্রয়োগ-ক্ষেত্র ঘিরে তৈরি হওয়া নানা রকম ভাষা-সমস্যার সমাধান খোঁজা যেতে পারে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। আবেগ নয়, গবেষণা-জিজ্ঞাসা ও গবেষণা-ফলের ভিত্তিতে গৃহীত হতে পরে বাস্তবায়ন উপযোগী সিদ্ধান্ত। তার সঙ্গে সঙ্গে ২৮ দিনের আবেগকে নিয়ে যেতে হবে যুক্তি ও বুদ্ধির চত্বরে।

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়