ওমর ফারুক হিমেল

বিশ্বজুড়ে সবাই অর্থ উপার্জন বা পরিচিতির জন্য কাজ করে। প্রত্যেক পেশায় কমবেশি সবকিছুর সংযোগ আছে, ধন্যবাদ আছে। কিন্তু ধন্যবাদহীন একটি পেশা আছে। সেটি হলো সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতা শুধু পক্ষে গেলেই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে ধন্যবাদ জানানো হয়। 

জনৈক পন্ডিত বলেছেন, ভালো সংবাদপত্র হচ্ছে যা জাতিকে নিজের সঙ্গে কথা বলায়। যেমনটি করোনাকালে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন সাংবাদিকরা, দেশে বা প্রবাসে। তবে প্রবাসে সাংবাদিকতার কোনো স্বীকৃতি নেই। মিথ আছে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শেষ সৈনিকটিও পালাতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হোক, নেশার কারণে হোক বা পেশার কারণে হোক তখনও সাংবাদিককে সেই পলায়নের খবর পাঠকদের জানাতে থাকতে হয়। বলা চলে, অবকাশ যাপনে গিয়েও সার্বক্ষণিক চোখ-কান খোলা রাখেন সাংবাদিকরা। সর্বশেষ খবর জানাতে আরাম ছেড়ে তারা কীবোর্ডে ঝড় তুলেন। ক্যামেরা হাতে মাঠে নামেন মানুষের জন্য। 

প্রবাদে আছে, বিজ্ঞান কখনও ঘুমায় না ‘সায়েন্স নেভার স্লিপস’। যার জ্বলন্ত প্রমাণ করোনাকালে একদল গবেষকের ঘুম নেই। তারা আবিষ্কারের নেশায় মত্ত। সবাই যখন করোনাকালে নানা বিষয়ে ব্যস্ত। একদল মেডিকেল সায়েন্টিস্ট করোনার টিকা আবিষ্কারের  নেশায় বিভোর। বিশ্বকে তারা নব আলোর মুখ দেখালেন, স্বপ্ন দেখালেন ও দেখাচ্ছেন।

একই কথা সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে সত্য তারা। ঘুমায় না শুধু নয়, সংবাদমাধ্যম ঘুমানোর কথা চিন্তাও করে না। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতেও দেশের মত প্রবাসের সাংবাদিকরা সদা জাগ্রত। তেমনি প্রবাসে প্রবাসী সাংবাদিকরা করোনাকালে প্রবাসীদের  নানান খবর তুলে এনেছে। অনেক সময় প্রবাসী সাংবাদিকদের আবেগ-অনুভূতি কীভাবে তুচ্ছ হয়ে যায়, তার উদাহরণ অনেকবারই আমরা দেখেছি। সাংবাদিকতাকে অন্যান্য পেশা থেকে আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। মর্যাদাপূর্ণ এই পেশায় যারাই জড়িত তারা দেশের প্রয়োজনে পেশাদারিত্বের সবটুকু উজাড় করেই দিয়ে থাকেন। অধিকাংশ সাংবাদিক নিজেদের নিয়ে ভাবে না।প্রবাস সাংবাদিকতায় শক্ত কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। 

মোদ্দা কথা হচ্ছে, প্রবাসে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের কেউ মূল্যায়ন করে না। বলা চলে, দেশের সাংবাদিকরা অর্থপ্রাপ্তির পাশাপাশি কম-বেশি সম্মান পেয়ে থাকে। কিন্তু প্রবাস সাংবাদিকদের নেই কোনো অর্থপ্রাপ্তি, নেই কোনো যুতসই স্বীকৃতি। অনেকেই সাংবাদিকতা করেন নেশায়। অর্থপ্রাপ্তিতো নেইই, সঙ্গে নেই কোনো কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। যেন ধন্যবাদহীন এক পেশা প্রবাস সাংবাদিকতা। দেশের সাংবাদিকদের যেমন অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়, তেমন প্রবাসী সাংবাদিকদেরও নানা কষ্ট করতে হয়। নিজেদের পড়াশোনা বা কাজের ফাঁকে তারা এই কাজ করেন। 

দীর্ঘ ১০ বছর কোরিয়ায় থাকা অবস্থায়, এমনও দিন গেছে যে লিখতে থাকায় চুলায় রান্না বসানোর ভুলে গেছি। রান্না ঘরে গিয়ে দেখি ততক্ষণে তরকারি পুড়ে ছাই। কিন্তু নিউজকে ছাই করিনি। লবণ-মরিচ দিয়ে পান্তা-ভাত খেয়ে রুমে চলে আসলাম। নেশা আর পেশা না মিললে যা হয়। আবার চিন্তা করি এটা নেশা। এ পেশায় পেট, সংসার কিছুই তো চলবে না। সারা দিন-রাত যেন সংবাদ মাথায় ঘুরে।

সংবাদের খোঁজে প্রতিমুহূর্তেই ঘোরাঘুরি। অনেক কিছুই চোখে পড়ে। নানা বিষয়, কত ইস্যু, যা হয়ত সংবাদ, হয়ত বা সংবাদ নয়। কিন্তু অনুসন্ধানী মন, সংবাদ খুঁজে কিছু মন দিয়ে লিখতে চাই। জার্মানিতে এসেও নানা সংবাদ পরিবেশন করছি। কিন্তু জার্মানিতে যা দেখলাম, প্রবাসী সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ নন। একই সঙ্গে অনেকেই নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন নন। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির পাশাপাশি প্রবাস সাংবাদিকদের নিজেদের আরো জানান দিতে হবে।

প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মুসা বলেছিলেন, ‘যা ভিউস তাই নিউজ। আর এই লেখালিখিতে বেড়েছে বন্ধু, বেড়েছে শত্রু। সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’। সত্যিই প্রবাসে এসে প্রবাস সাংবাদিকতার প্রেমে পড়লাম। প্রবাস সাংবাদিকতা এক ধরনের উন্মাদনা, অন্যরকম পাগলামি। তবে এ কথা সত্য সাংবাদিকতার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে ছোটবেলা থেকেই। তবে প্রবাসী সাংবাদিকতায়ও ঝুঁকি রয়েছে। 

অপসাংবাদিকতা বাদ দিলে যেটুকু থাকে তার সবটুকুই আত্মতৃপ্তি। বলাবাহুল্য ‘নোজ ফর নিউজ’, এখন প্রবাসে সর্বদা আমি সংবাদের গন্ধ নেওয়ার নাক নিয়ে হাঁটি, চলি, ঘুমাতে যাই। সেজন্যই খ্যাতিমানরা বলেছেন ‘সাংবাদিকতা কখনও নীরব হতে পারে না, এটি তার সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ এবং তার সর্বশ্রেষ্ঠ দোষ।’ হেনরি গ্রুনওয়াল্ড আমেরিকান সাংবাদিক। ‘আমি একজন সাংবাদিক হয়েছি যাতে পৃথিবীর হৃদয়ের সর্বনিকটে পৌঁছাতে পারি’ কথাটি হেনরি লুসের। তবে, দেশে ও প্রবাসে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সাংবাদিকতা তার যৌবন অনেকটা হারিয়েছে। আমেরিকান এক কিংবদন্তির মতে যে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে মানুষের মন ও চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ওএফ