পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ভুলতে বসেছে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি নতুন প্রজন্ম
আলতাব আলী হত্যার প্রতিবাদে ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী ব্যাপক গণবিক্ষোভ
একটু পরপর মসজিদ, শহরের গলিতে গলিতে বাংলা লেখা সংকেত, মাঝে মাঝে বাংলাদেশি দোকানগুলো থেকে আওয়াজ আসছে, সবজি লাগলে আসুন। কে বলবে এটা বাংলাদেশের কোনো শহর নয়? বাংলাদেশ থেকে যারা বিলেতে বেড়াতে এসেছেন কেবল তারাই বলতে পারবেন, লন্ডনের বেশিরভাগ অলিগলি যেন ঢাকারই প্রতিচ্ছবি! মনে হবে যেন বাংলাদেশ।
এমন পরিবেশ অবশ্য একদিনে তৈরি হয়নি। আগের কয়েক বাংলাদেশি প্রজন্মের সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাদের বহু ত্যাগের ফলেই আজ ব্রিটেনের বুকে অনন্য হয়েছে বাংলাদেশ। যদিও পূর্ব পুরুষদের সেই ত্যাগ আজ ভুলতে বসেছে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের অনেকেই।
বিজ্ঞাপন
কেবল পূর্ব পুরুষদের ত্যাগের ইতিহাস ভুলে যাওয়া নয়, এই প্রজন্মের অনেকই জড়িয়ে পড়ছেন মাদক আর নানা ধরনের অপরাধ চক্রে। ফলে ব্রিটেনে বাংলাদেশের সম্মানহানির পাশাপাশি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ছেন বাবা-মায়েরা।
বাঙালি অধ্যুষিত অনেক এলাকায় বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে আসা অনেকেই নতুন প্রজন্মের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। নিজ দেশের মানুষকে তারা তাচ্ছিল্য করে, কারি ফেইস গো ব্যাক, ফ্রেশি এমন ব্যঙ্গাত্মক ভাষা ব্যবহার করে সম্মানহানির অভিযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র মুখের ভাষায় নয় শারীরিক লাঞ্ছনারও শিকার হচ্ছেন অনেকেই। সম্প্রতি লন্ডনে বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ী নতুন প্রজন্মের এক সংঘবদ্ধ গ্রুপের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে আহত হয়েছেন। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এর সঙ্গে আরও সংঘটিত হচ্ছে চুরি, ছিনতাই, নাইফ ক্রাইমের মতো ভয়াবহ অপরাধ। এর মূলে রয়েছে মাদক।
বিজ্ঞাপন
এমন কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের অনেকেই জেলে যাচ্ছে। অনেকই আদালত কর্তৃক সাজা ভোগ করছেন। কিছুতেই কমছে না অপরাধ প্রবণতা। কিশোরদের পাশাপাশি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোরীরাও। মাদক সেবনের পাশাপাশি তারা যুক্ত হচ্ছে মাদক বিক্রির সঙ্গেও।
আর প্রতিদিনের মাদকের টাকা জোগাড় করতে তারা যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন নানার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এশিয় অন্যান্য কমিউনিটির চেয়ে বাংলাদেশি প্রজন্মের মাঝে অপরাধ প্রবণতা অনেক বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংঘটিত অপরাধের পরিসংখ্যান বিবেচনায় এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
পর্যাপ্ত নৈতিক শিক্ষার অভাব, খারাপ সঙ্গ, সচেতনতার অভাব ও পরিবারের মা-বাবার উদাসীনতা বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের বিপথে যাওয়া মূল কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে সাম্প্রতিক সংগঠিত অপরাধগুলোর বিবেচনায় এটি এই কমিউনিটির জন্য বড় একটি সংকেত।
পরিবারের পর্যাপ্ত নজর না থাকায় সময়ের মা-বাবারা তাদের সন্তানদের উপর প্রভাব হারাচ্ছেন। তাই মা-বাবাদের সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা, সন্তানদের সৎ সঙ্গ নিশ্চিত করা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। যারা ইতিমধ্যে আসক্ত হয়েছেন তাদের সারিয়ে তুলতে ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে হোম কেয়ার, মাইন্ডসহ বহু সামাজিক সংগঠন।
এখনকার যুক্তরাজ্য আর সত্তর দশকের যুক্তরাজ্য একই রকম ছিল না। সত্তর-আশির দশকে যেসব বাংলাদেশি অভিবাসীরা ব্রিটেনে এসেছেন তাদের অনেক সংগ্রাম পোহাতে হয়েছে। যে মানুষগুলো সেসময় যুক্তরাজ্যে বসবাস করতেন প্রকৃতপক্ষে কেমন ছিলো তাদের জীবন? সে সময়ের কয়েকজন বাংলাদেশি জানিয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা।
শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যের স্থানীয় নাগরিকরা অভিবাসীদের সহ্য করতেন না। কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবার রোষানল আর বঞ্চনা শিকার হতেন বাংলাদেশিরা। স্থানীয়দের ধারণা অভিবাসীরা এসে তাদের অধিকারে ভাগ বসাচ্ছেন, তাদের দেশের কর্তৃত্ব নিচ্ছেন। ১৯৭০ সনের পর থেকে বাংলাদেশিসহ প্রচুর এশিয়ান ও আফ্রিকান অভিবাসীদের আগমন হয় যুক্তরাজ্যে। সেসময় প্রতিনিয়তই ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) ও কট্টরপন্থী নাগরিকদের ঘৃণার হামলার শিকার হতেন অভিবাসীরা।
তারা নাগরিকত্ব লাভ করলেও গায়ের রং বিবেচনায় সেখানে তাদের উপর এই হামলা চালানো হতো। হামলাকারীদের ধারণা ছিল এভাবে হামলা করতে থাকলে হয়তো একসময় অভিবাসীরা তাদের দেশ ছেড়ে চলে যাবে। সেসময় হিজাব পরিহিতা নারীদের দেখলে টেনে খুলে ফেলা, এমনটি গায়ে হাত দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটতো প্রায়শই। তাদের হামলা থেকে রেহাই পেতো না স্কুলগামী বাচ্চারাও।
স্কুলে তাদের সুন্দর পরিবেশ ছিল না, বাচ্চারা স্কুলে গেলে বুয়েলিংয়ের শিকার হতো। পাকি, স্মেলি কারি ফেই-স, গো ব্যাক টু ইউওর কান্ট্রিসহ হিংসাত্মক বিভিন্ন মন্তব্য শুনতে হতো। সময়ের পালা বদলে আজ কিছু ব্রিটিশ-বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের কাছেও বাংলাদেশ থেকে আসা বাংলাদেশিদের এসব শুনতে হচ্ছে। যেন পূর্ব পুরুষদের সংগ্রামের ইতিহাস ভুলে গেছে তারা।
সত্তর দশকের পর যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইস্ট লন্ডনে অভিবাসীদের একটা বিরাট অংশ বসবাস শুরু করে। বছর কয়েক পরে এলাকাগুলোতে অভিবাসীরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৃদ্ধি পায়। একসময় সেখানে অভিবাসীরাও সমান প্রতিরোধ গড়ে তোলা শুরু করে। যার ফলে ব্রিটিশ কোনো নাগরিক দ্বারা কেউ হামলার শিকার হলে সেখানে সবাই প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এমনকি তাদের সঙ্গে সমানতালে সেখানে মারামারিতেও জড়িয়েছে অনেকেই। আইন থাকলেও আইনের পর্যাপ্ত প্রয়োগ ছিলো না সেসময়। তাই অনেকের ধারণা ছিলো এভাবে সমানভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুললেই একদিন এই চিত্র বদলাবে। এই সংগ্রাম চলতে থাকলো বহুদিন।
পূর্ব লন্ডনে আলতাব আলী পার্ক নামে একটি পার্ক রয়েছে। আলতাব আলী ছিলেন বাংলাদেশি। তিনি লন্ডনের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন। তৎকালীন চলমান হেট ক্রাইমের শিকার হয়ে যিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ১৯৭৮ সালের ৪ মে সন্ধ্যা অনুমানিক ৭টা ৪০ মিনিটে কাজ শেষে রাতে বাসায় ফেরার পথে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে বর্ণবাদীদের হাতে খুন হন তিনি। তার মৃত্যুর পর লন্ডনের বাঙালি সম্প্রদায় বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদে নামেন।
এসময় বাঙালিদের সঙ্গে লন্ডনে বসবাসরত অন্যান্য অভিবাসীরাও প্রতিবাদে যোগ দেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই আন্দোলন মারাত্মক আকার ধারণ করে। আন্দোলনের মুখে প্রশাসন তার খুনিদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনে। পরে ১৯৯৮ সালে আলতাব আলীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেন্ট মেরি পার্ক যেখানে আলতাব আলীকে খুন করা হয়েছিল সেই পার্ককে আনুষ্ঠানিকভাবে আলতাব আলী পার্ক হিসেবে নামান্তর করা হয়।
ব্রিটেনে এখন আর সে সময় নেই। আশির দশকের কথা অনেকেই হয়তো হাসিল ছলে গল্প বলে উড়িয়ে দিতে চাইবে। দেশটিতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে, বর্তমান সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে নিলে এটা বেশ বেমানান বলে মনে হয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে শুরুর সময়ে মানুষদের অনেক সংগ্রাম পোহাতে হয়েছে। আলতাব আলীর রক্ত আর বহু মানুষের ত্যাগের ফলে ব্রিটেনে আজ বাংলাদেশ অনন্য অবস্থানে পৌঁছেছে। ব্রিটেনের সর্বত্র বাঙালিরা একটি সম্মানজনক জায়গা করে নিয়েছে। সবজায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশিরা। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে স্থান পেয়েছে বাংলা ভাষা। সময়ের পালা বদলে ঘৃণা পরাজিত হয়েছে। অভিবাসী বিরোধিতা জনপ্রিয়তা পায়নি বরং বর্তমানে এশিয় বংশোদ্ভূত একজন নির্বাচিত হয়েছেন লন্ডন মেয়র হিসেবে।
যুক্তরাজ্যে প্রায় ছয় লাখের বেশি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ বসবাস করছেন। ব্রিটিশ সংসদে এমপি হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন অনেকেই, হয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলের মেয়র। শুরুর দিকের বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার থেকেই পাওয়া আজকের গৌরবান্বিত অনেক অর্জন। পূর্ব পুরুষদের এত আত্মত্যাগের ফলেই যুক্তরাজ্যের বুকে বাংলাদেশের এতো সুনাম। তবে খানিকটা তিক্ততা জায়গা করে নেয় এই প্রজন্মের অনেকের অন্ধকারের পথে পা বাড়ানোর খবরে। তাহলে এই প্রজন্ম কি ভুলতে বসেছে তাদের পূর্ব পুরুষদের আত্মত্যাগ?
ওএফ