বাংলাদেশ ক্রিকেট সংস্কৃতিতে একটি বিষয়ের হিসেব মেলানো বেশ জটিল। ঠিক কত বছর আন্তর্জাতিক আঙিনায় পাড়ি দিলে তাকে সিনিয়র বা অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের তকমা দেওয়া যায়? পঞ্চপাণ্ডব খ্যাত মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বা মুশফিকুর রহিমের বাইরে কি কাউকে অভিজ্ঞ বলার উপায় নেই? নাকি বাকিরা ইচ্ছে করেই অভিজ্ঞতার তকমা গায়ে মাখতে চান না!

সময় যত গড়াচ্ছে, ততই আর্তনাদ বাড়ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। দিনে দিনে বয়সটা নেহায়েত কম হচ্ছে না পঞ্চপাণ্ডবদের। মাশরাফি তো থেকেও নেই, অঘোষিত অবসরে সাবেক অধিনায়ক। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ টেস্টে নিয়মিত নন, সঙ্গে ইনজুরি ভোগাচ্ছে। সম্প্রতি তামিম ইকবাল আভাস দিয়েছেন চলতি বছরেই তিন ফরম্যাটের একটি ছেড়ে দেওয়ার। বাস্তবতা আমলে নিলে ২০২৩ বিশ্বকাপে রিয়াদ, সাকিব, তামিম আর মুশফিক; প্রত্যেকের নামের পাশেই বসবে সাবেকের তকমা।

এরপর কোন পথে বাংলাদেশ ক্রিকেট, পথ দেখাবেন কারা? নিউজিল্যান্ড সফরের শেষ টি-টোয়েন্টিতে দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতিতে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব সামলেছেন লিটন, কিন্তু তার পায়ের নিচেই যে মাটি নেই। নিজের খেলা সবশেষ ১২ ইনিংসে এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের নামের পাশে মোটে ২৭২ রান। ফিফটি মোটে ২টি। সৌম্য সরকারের অবস্থা আরও করুণ। ৯ ইনিংসে রান মোটে ১১৯ রান, ফিফটি মাত্র ১টি।

সাকিব-তামিম পরবর্তী সময়ের কথা ভেবে যার প্রতি সবচেয়ে আস্থা রেখেছে বাংলাদেশ দলের টিম ম্যানেজমেন্ট, সেই নাজমুল হোসেন শান্ত হতাশায় পোড়াচ্ছেন প্রতিনিয়ত। সাকিবের পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটিং অর্ডার তিন নম্বরে খেলিয়েও শান্তর ব্যাট রান পাওয়া যাচ্ছে না। সবশেষ ৮ ইনিংসে মাত্র ৮৬ রান করেছেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। নেই কোনও অর্ধশতক।

সবশেষ ৭ ইনিংসে মিঠুনের ব্যাটে ১১৮ রান। মোসাদ্দেক হোসেন, মেহেদী হাসান মিরাজরাও ব্যাট হাতে আস্থা যোগাতে পারছেন না। মোদ্দাকথা, দলের সিনিয়ররা রান পেলে, জ্বলে উঠলে তবেই জয় ধরা দিচ্ছে। যেদিন ব্যর্থ হচ্ছেন তামিম, সাকিব, মুশফিক, রিয়াদরা সেদিন পরাজয়ের খাতায় আরো একটি সংখ্যা বাড়ছে বাংলাদেশ দলের। 

অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অর্ধ যুগ পার করে ফেলেছেন লিটন। সৌম্য-মিঠুনদের প্রায় ৭ বছরের ক্যারিয়ার। মোসাদ্দেক-মিরাজরা জাতীয় দলের জার্সিতে খেলছেন ৫ বছর ধরে। এদিকে তাদের সমসাময়িক হয়েও বিশ্ব ক্রিকেটে রাজ করছেন বাবর আজম, ফখর জামান, ডেভিড মালান, ঋষভ পান্ত, লোকেশ রাহুল, হার্দিক পান্ডিয়া, মোহাম্মদ রেজওয়ান কিংবা হ্যানরিচ ক্ল্যাসেনরা। কাগজের পর কাগজ শেষ হবে, তবুও নামের তালিকা শেষ করা দায়।

কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে সৌম্য-লিটনদের পারফরম্যান্স নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন খোদ বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক তামিম ইকবাল। তাদের দায়িত্ববোধ কাঠগড়ায় তুলে তামিম বলেন, ‘এই যে চার জন নিয়ে কথা হয় (সিনিয়র ক্রিকেটার তামিম, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ)। বারবার উঠে আসে, ত্যি বলতে আমরা চার জন এই-সেই। এভাবে ভাবতে বা বলতে যদিও আমার ভালো লাগে না, কারণ আমি তরুণদের অনেক বড় সমর্থক, কিন্তু ব্যাপারটি হলো, ওদেরও এখন দায়িত্ব নিতে হবে এবং ভালো পারফর্ম করতে হবে।’

বাংলাদেশ ক্রিকেটের অভিভাবকদের একজন খালেদ মাহমুদ সুজন। ক্রিকেটারদের সুখ, দুঃখে জড়িয়ে থাকেন তিনি। সবথেকে বেশি আগলে রাখেন তরুণ ক্রিকেটারদের। তবে সম্প্রতি নিজের ক্ষোভ লুকাননি খোদ সুজনও। অভিযোগের তির দেগেছেন ৬ বছর পর এখনো সিনিয়র না হওয়া সৌম্য, লিটন, মিঠুনদের দিকে।

কিছুদিন আগে গণমাধ্যমকে সুজন জানান, ‘যারা (তরুণ) আছে তারা যে ক্যাপাবল না ব্যাপারটি তেমন না। তারাও অনেক ম্যাচ ভালো খেলেছে, ম্যাচ জিতিয়েছে। দলে সিনিয়র-জুনিয়র সবাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। এটা কোনো সিনিয়র-জুনিয়রের খেলা না। আপনি যখন জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করবেন তখন সিনিয়র-জুনিয়র, সবারই সমান দায়িত্ব থাকে। এর মানে এই না যে তামিমের দায়িত্ব থাকবে একশ আর লিটনের দায়িত্ব দশ।’

যোগ করেন সুজন, ‘আমি মনে করি তামিম, লিটন- দুজনেরই দায়িত্ব একশ। আপনি এখানে তুলনা করতে পারবেন না। লিটনের মতো অনেকেই পাঁচ-ছয় বছর ধরে খেলছে। কেন সবসময় সিনিয়রদের দায়িত্ব নিতে হবে? তুমিও তো দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এখানে একলা কেউ ম্যাচ জেতাবে এমন চিন্তা করা যাবে না। আমাদের এগারোজনকে কাঁধে হাত মিলিয়ে লড়তে হবে।’

বাংলাদেশ দলের সম্প্রতি পারফম্যান্স একেবারেই সুখকর নয়। নিউজিল্যান্ডে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের সঙ্গে ৩ ম্যাচের টি-টোয়েন্টিতেও হোয়াইটওয়াশ। এই ৬ ম্যাচের সঙ্গে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২ ম্যাচ টেস্ট সিরিজে ধবলধোলাই। সবেমিলিয়ে টানা ৮ ম্যাচে হার। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে সাবেক ক্রিকেটার ও কোচ আফতাব আহমেদ তরুণদের দায় দেখালেন।

আফতাবের ব্যাখ্যা, ‘অবশ্যই ওরা অনেক বছর ধরে খেলছে। ‌ আমার মনে হয় তাদেরকে এখন সিনিয়র হিসেবে ধরার সময় এসেছে। কারণ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যে জায়গাটা বোঝার দরকার, তারা ইতোমধ্যে সেই জায়গায় পৌঁছে গেছে। আমরা তাদেরকে কেন সিনিয়র বা অভিজ্ঞ হিসেবে গণনা করি না? এখন তাদেরকে অবশ্যই সিনিয়র হিসেবে তাদের দায়িত্বটা বুঝে নিতে হবে। বর্তমানে যে তিন-চারজন আছে, যাদেরকে সিনিয়র হিসেবে বলি সাকিব, তামিম, মুশফিক মাহমুদউল্লাহ। ক্রিকেট হচ্ছে একটি দলগত খেলা, সেখানে যদি আপনি ৩-৪ জনের ওপর নির্ভর করে থাকেন, তারা আপনাকে ফলাফল এনে দিবে, এটা আসলে অসম্ভব।’

দলের সিনিয়র যে চারজনের কথা বলা হচ্ছে, তার একজন তামিম। ইনিংস শুরু করা এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে ভালো শুরু এনে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হয়। তামিমের ব্যর্থতার দিন মুখ থুবড়ে পড়ে দলের টপ অর্ডার। দলের নির্ভরতার জায়গা যে মির্ডল অর্ডার, সেখানে কারণবশত সাকিব-মুশফিক রান না পেলে দুর্দশার সীমা থাকে না। শেষ দিকে ফিনিশারের তকমা গায়ে সেঁটেছেন মাহমুদউল্লাহ। দলের জয় রাঙাতে গেলে তার কাঁধেও বাড়তি দায়িত্ব। তাহলে দলের বাকিদের কাজটা কি? প্রশ্ন আফতাব আহমেদের।

আফতাব বলেন, ‘আমরা যখন খেলেছি তখন আমরা আমাদের রোলটা প্লে করার চেষ্টা করেছি। সে সময় সাকিব, তামিম বা নতুন যারা দলে ছিল, তারা সেটিকে ক্যারি করার চেষ্টা করেছে। এর ফল হিসেবে তখন কিন্তু আমরা সবে জেতা শুরু করেছিলাম। এখন কিন্তু সৌম্য-লিটনদের তাদের রোল প্লে করার সময়। এখন তারা রোল প্লে করবে, দলের সিনিয়র যারা আছে তারা ম্যাচ শেষ করে দিয়ে আসবে।’

আফতাব আরও যোগ করেন, ‘এখন যদি সিনিয়রদের খেলা শুরু করতে হয়, রোল প্লে করতে হয়, ইনিংস তৈরির দায়িত্ব নিতে হয়, আবার শেষও করতে হয়, তাহলে কিন্তু কষ্টকর। আমার মনে হয় ওদেরকে ওদের রোলটা বোঝা উচিত। না হলে আমার মনে হয় এটি টিমের জন্য ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না।’

সময়ের পর সময় যায়, দিনের পর দিন। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কেটে যায় বছরের পর বছর। কিন্তু যাদের বোঝার কথা, তারা বুঝবেন কবে? আদৌও কি সৌম্য-লিটনরা অভিজ্ঞ হবেন, নাকি ব্যর্থতার বোঝা মাথায় চাপিয়ে হারিয়ে যাবেন অকাতরে!

টিআইএস/এটি