আরেকটি টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে
পোশাকের রঙ সাদা, বলের লাল, চাইলে টানা ব্যাট করতে পারেন পাঁচদিন, পর্যাপ্ত মনে হলে এক ঘণ্টা পরও বলতে পারেন আর করবো না ব্যাটিং। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন। দিনের সংখ্যা এক, দুই...পাঁচ। টেস্ট ক্রিকেট এমনই, তাল ও ছন্দ, ধৈর্য্য ও সংযম, রোমাঞ্চ এবং রোমাঞ্চের রূপ একই।
একরকম বাংলাদেশও। গত বিশ বছর ধরেই এমন। পোশাকের রঙ সাদা হলেই বাংলাদেশের পারফরম্যান্স হয়ে পড়ে একেবারে রঙহীন। এ নিয়ে আলোচনার চেয়ে সমালোচনা হচ্ছে ঢের বেশি। তাতেও পারফরম্যান্সে বদল আসেনি।
বিজ্ঞাপন
গত তিন বছরে ১৫ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। যার মাত্র চারটিতে এসেছে জয়। দুইটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, দুইটি জিম্বাবুয়ে। সেটাও প্রায় বছর খানেক আগে। এই সময়ের মাঝে বাংলাদেশ ঘরের মাঠে হেরেছে নবাগত আফগানিস্তানের বিপক্ষে, হেরেছে দ্বিতীয় সারির ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের কাছেও।
হারের চেয়েও বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ভাবিয়েছে বেশি। জয়ের মানসিকতা, ভালো করতে চাওয়ার চেষ্টা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়েছে বারবার। প্রশ্ন উঠেছে ক্রিকেটারদের নিবেদন নিয়ে। এর মধ্যেই বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের শেষ সিরিজ, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
বিজ্ঞাপন
করোনা মহামারি এমনিতেই কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে অনেক। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য সেই বাস্তবতাটা আরও বেশি নির্মম। টেস্ট, ওয়ানডে থেকে টি-টোয়েন্টি। ফরম্যাটের দৈর্ঘ্য যত ছোট কিংবা বড়ই হোক, বাংলাদেশ হেরেছে একইভাবে।
ঘরের মাঠে সর্বশেষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই কেবল জয় এসেছে সাদা পোশাকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয় তারও দুই বছর আগে, ২০১৮ সালে। এরপর এমনকি ড্রও করতে পারেনি বাংলাদেশ। 'লকডাউন' শব্দটা বেশ পরিচিত এখন, করোনার কল্যাণে কিছু শব্দ পরিচিতি পেয়েছে বেশ, সে হিসাবে। শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে 'লক' হয়ে থাকা জয় পাওয়া যে কঠিন হবে, সেটা আঁচ করাই যায় তাই আগেভাগে।
কোয়ারেন্টাইন বিধিনিষেধের কারণে বাংলাদেশকে দুই টেস্টই খেলতে হবে পাল্লেকেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। ঐতিহ্যগতভাবেই যেখানেই দেখা যাবে স্পিন ঘূর্ণি। বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারেন স্বাগতিক স্পিনার লাসিথ এম্বুলদুনিয়া। ক্যারিয়ার মাত্র ১১ টেস্টের, তিনি সেখানে পেয়েছেন ৪৯ উইকেট।
বাংলাদেশ অবশ্য ভরসা খুঁজতে পারে নিজেদের স্পিনারদের দিকে তাকিয়ে। 'আবহাওয়া' মানিয়ে নেয়া নিয়ে কথা উঠেছে। নাজমুল শান্ত বলেছেন, কিছু করার নেই, মানিয়ে নিয়েই খেলতে হবে। 'আবহাওয়া কিংবা কন্ডিশন' অথবা 'শিক্ষা' যদি স্পিনারদের প্রয়োজন না হয়। তাহলে টাইগারদের ডেরায় আছেন মেহেদী হাসান মিরাজ ও তাইজুল ইসলামের মতো স্পিনার। যারা চাইলে গুঁড়িয়ে দিতে পারেন প্রতিপক্ষের ব্যাটিং।
বিশেষত মিরাজের সর্বশেষ টেস্ট সিরিজের পারফরম্যান্স একটু বাড়তি আশা দিতে পারে। ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি করেছেন, বল হাতে তো তিনি বরাবরই ভরসা দিতে পারেন। আইপিএল খেলতে যাওয়া সাকিব আল হাসানের অভাব পূরণে তার দিকেই তাই চোখ থাকবে।
চোখ থাকবে অধিনায়ক মুমিনুল হকের দিকেও। ঘরের মাঠে অবিশ্বাস্য গড়ে ব্যাটিং করা এই ব্যাটসম্যান বিদেশের মাটিতে গেলেই হয়ে যান ফ্যাকাশে। দুই দলের নির্দিষ্ট সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রানটা অবশ্য তারই। ২০১৮ সালে ঘরের মাঠে ২১৪ রান করেছিলেন তিনি। শ্রীলঙ্কার পক্ষে রেকর্ডটা যার, তিনি এখন অবসরে। কুমার সাঙ্গাকারা ২০১৪ সালে দুই সেঞ্চুরিতে করেছিলেন ৪৯৯ রান।
তবে নজর থাকতে পারে মুশফিকুর রহিমের দিকেও। তার ক্যারিয়ারে একটি ডাবল সেঞ্চুরি আছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। স্কোয়াডে থাকা ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র তিনি। তার নেতৃত্বেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একমাত্র জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ।
এখনো পর্যন্ত লঙ্কানদের বিপক্ষে ওই জয়টাই বাংলাদেশের একমাত্র জয়, সেটাও এসেছিল নিজেদের শততম টেস্টে। বাকি ১৯ টেস্টে ড্র এসেছে তিনটি, ১৬ টেস্টেই হেরে গেছে বাংলাদেশ।
এবারের লড়াইটা বাংলাদেশের যতটা না জয়-পরাজয়ের, তার চেয়েও বেশি মর্যাদার। হ্যাঁ, মর্যাদার। বিশ বছর পর এসেও নিজেদেরকে নতুন করে চেনানোর। আত্মবিশ্বাসী হয়ে লড়ে যাওয়ার মানসিকতা ছড়িয়ে দেওয়ার। হতাশা ভুলিয়ে নতুন করে আশা দেখানোর।
সেই লড়াইয়ে বাঁধা আছে অনেক। দলের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান নেই, নেই মুস্তাফিজুর রহমানও। পরিসংখ্যান পক্ষে নেই, সাম্প্রতিক সময়ের পারফরম্যান্সও। চারপাশে সমালোচনার ঝড় বইছে, প্রশ্ন উঠছে সামর্থ্য ও নিবেদন নিয়ে।
যেসব অমূলক না একদমই। ঘরের মাঠেও হতশ্রী পারফরম্যান্স আশাহত করেছে সমর্থকদের। সেটা বুঝতে হবে সবার আগে ক্রিকেটারদের। মাঠে দেখাতে হবে নিজেদের নিবেদন, লড়াইয়ের মানসিকতা। তাহলে হয়তো মিলবে সাফল্য, হয়তো না। তবে নিজেরা নিশ্চয়ই তৃপ্তি পাবেন, সমর্থকদের বেশির ভাগও। আর তারা যদি মনে করেন এটাও আরেকটি 'শিক্ষা সফর'। তাহলে জুটবে সমালোচনা, ট্রল আর হাস্যরস। ক্রিকেটাররা কী চান, সেই সিদ্ধান্তটা তো কেবলই তাদের!
এমএইচ/এটি