প্রায় সাত হাজার শব্দের এক বিশাল সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন রবীচন্দ্রন অশ্বিন। বাংলা অনুবাদে শব্দ সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে পাঁচ হাজার। অশ্বিন বলেছেন নিজের ছিটকে পড়ার কথা, মানসিক যন্ত্রণার কথা, কীভাবে শিকার হয়েছিলেন ব্যক্তিগত আক্রোশের— শুনিয়েছেন সেসবও। কীভাবে তিনি ক্রিকেটটা দেখেন, তার প্রস্তুতির ধরন কী, এসব জানলে আপনি খেলাটাকে যেন চিনবেন নতুন করে।

ইংল্যান্ডের ভারত সফরের আগে তিনি রুটের ব্যাটিং করা শ্রীলঙ্কা সফরের প্রতিটি বল দেখেছিলেন তিনবার করে। ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে স্টিভ স্মিথকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ঘোরের ভেতর। অনেকের কাছে ‘ক্রিকেট বিজ্ঞানী’ রবীচন্দ্রন অশ্বিনের ক্রিকেট দর্শনে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য হবেন। ‘দ্য ক্রিকেট মান্থলি’ ম্যাগাজিনের হয়ে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর সিদ্ধার্থ মঙ্গার নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারের পুরোটা অনুবাদ করেছেন  মাহমুদুল হাসান বাপ্পি।

মঙ্গা : বড় কোনো সিরিজের আগে আপনি যেভাবে প্রস্তুতি নেন, সেটা দিয়ে শুরু করতে চাই। কারণ আমার বিশ্বাস এই জায়গাটায় আপনি বিশ্বের সেরা। মনে আছে, একবার আপনি বলেছিলেন রবীন্দ্র জাদেজার মতো প্রকৃতিপ্রদত্ত অ্যাথলেটদের জন্য দিনে ৩০ ওভার করা সহজ কিন্তু আপনার মতো যারা শরীরের সঙ্গে লড়াই করছেন, তাদের জন্য ব্যাপারটা অনেক কঠিন। কোনো সিরিজের জন্য প্রস্তুতিটা কখন শুরু করেন?

প্রস্তুতির আসলে দুইটা ধরন আছে। একটা হচ্ছে শারীরিক, আরেকটা মানসিক ও টেকটিক্যাল। আমার মনে হয় না অন্যরা টেকটিক্যাল বিষয়গুলোতে খুব বেশি জোর দেয়। আমি এটা বলছি না টেকটিক্যাল প্রস্তুতি নিতেই হবে কারণ আমি এমন একটা পরিবেশে ক্রিকেট খেলি- মানুষের সামর্থ্য, শক্তিই এখানে টেকটিকসের চেয়ে বেশি নজর দেওয়া হয়।

শারীরিক প্রস্তুতির ব্যাপারে যদি আসেন, ২০১৭ এবং ২০১৯ সালে আমি প্রথম ইনজুরিতে পড়ি, সেটার নাম ছিল পাটেলার টেনডোনিটিস। এটা নিয়ে আপনি খেলতে পারবেন কিন্তু এই ইনজুরির সৌন্দর্য হচ্ছে আপনি হাঁটু দিয়ে ওয়ার্ম আপ করতে পারবেন না। সকালের দিকে, এমনকি হাঁটতে গেলেও ব্যথা করবে। অন্যরা তাড়াহুড়ো করে সকাল শুরু করবে কিন্তু আপনি ধাক্কাও লাগাতে পারবেন না।

সবকিছু ঠিক হতে অন্তত দুই থেকে তিনটা ল্যাপ তো লাগবেই। ব্যথাটা আসলে কখনোই যায় না। প্রথমে এটা আমার ডান পায়ে হয়েছিল। তখন লাফ দেওয়াটা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। বল করতে গেলে আপনার লাফ দিতে হবে, একটা পা অন্তত এক মুহূর্তের জন্য হলেও মাটিতে ফেলতে হবে। এটা আসেলে খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে গিয়েছিল। এমনকি অনুশীলন করাও তখন চ্যালেঞ্জিং ছিল। এরপর ধীরে ধীরে বা পাটাও আক্রান্ত হলো বেশি ভার নিতে নিতে।

এরপর আমার অ্যাথলেটিক পাবলগিয়া নামে আরেকটা ইনজুরি হলো। আমার মনে হয় প্রথম ইনজুরির সঙ্গে এটার সম্পৃক্ততা আছে। হাঁটু যেটা নিতে পারছিল না, সেটার জন্য পুরো শরীরকেই প্রস্তুত করতে হয় এখন। এরপর আমি অ্যাকশন বদলে বল করা শুরু করলাম কারণ পরের ইনজুরিটার জন্য প্রতিবার সাইড অন পজিশনটা কঠিন হয়ে গেল।

১০ ওভারের বোলিং স্পেলের পর শরীরে আর কোনো এনার্জিই থাকতো না। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে আমি আমার এবডমিন ছিড়ে ফেললাম, এডোকটরসও। এসব ইনজুরি আমার মনে অনেক ভয় ধরিয়ে দিলো। ক্রিকেট কমিউনিটিতে (ভারতে) ইনজুরির ব্যাপারটা বুঝতে পাড়ার অবস্থা ছিল খুবই পীড়াদায়ক। আমার ইনজুরিতে পড়ার পরিষ্কার একটা কারণ ছিল, কিন্তু কেউ সেটা খুঁজতে আগ্রহী হলো না।

বারবার বলা শুরু হলো সমস্যা আসলে সমস্যাই। কিন্তু সেটা আমাকে সমাধান পেতে কোনো সাহায্য করল না। ইনজুরির জন্য কাউকে লজ্জা দেওয়াটাও। দলের অনেকেই ইনজুরিতে পড়েছে কিন্তু যখন আমি ইনজুরিতে পড়লাম, মনে হচ্ছিল এটা খুব বড় কিছু। এটা নিয়ে কোনো সংবেদনশীলতা ছিল না। এসব আমাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। 

আমি তখন কাউন্টি ক্রিকেটে চলে গেলাম এই ভেবে, ‘আমাকে দিনগুলো পাড় করতে হবে’। আমাকে অন্তত ২৫ ওভার ইনজুরি ছাড়া বল করতে হবে। কারণ আমি যদি কাউন্টিতে ইনজুরিতে পড়তাম, সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকাতো। আমি নাকি খেলতে চাইনি অথবা একটা কনটেস্ট থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, এমনও বলা হয়েছিল। এই বক্তব্য আমাকে সবসময় কষ্ট দেবে।

আপনি আমাকে যেকোনো ধরনের কলঙ্ক দিতে পারেন, দল থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু আমার ইন্টেন্ট অথবা লড়াই নিয়ে সন্দেহ করাটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। যেকোনো সিরিজের আগে আমি চার সপ্তাহের প্রস্তুতি নেই। সকালের দিকে সক্রিয়তা ও ইনজুরির জায়গাগুলোতে নজর দেই। গুলতি ছোঁড়ার মতো কাজও করি নিজের অবস্থাটা দেখতে। এরপর দুই ঘণ্টা পর, নাস্তা করে স্টেন্থ ট্রেনিংয়ে যাই। যেখানে একটা বড় মাসেল তৈরির চেষ্টা করি। বিকালে কোনোদিন দৌড়াই, আবার কখনো স্কিল ট্রেনিংও করি।

এসব ইনজুরির কারণে আমাকে ফ্রন্ট অন, সাইড অন, স্লিংয়ি সব পজিশনেই থাকতে হয়। আমাকে সব পজিশন মাথায় রাখতে হয় শরীর কেমন সাড়া দিচ্ছে এটা দেখতে। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, ধরেন আমি যদি লেগ ব্রেক করছি, তাহলে আমার কাঁধে ব্যথা শুরু হবে একদিক থেকে, কারণ অন্য দিকটা বেশি ব্যবহার হয়েছে। আমাকে সব পজিশনে গিয়ে দেখতে হয় কোন জায়গায় ব্যথাটা কেমন।

প্রস্তুতির জন্য আদর্শ সময় হচ্ছে ছয় সপ্তাহ। যদি আপনার হাতে ছয় সপ্তাহ থাকে, মেইন্টেইন করেই চার-পাঁচ টেস্টের সিরিজ খেলা যায়। শেষ দুই বছরে এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি সবগুলো সিরিজে একই ওজন নিয়ে যেতে এবং সেটা ধরে রাখতে।

মঙ্গা : সবকিছু নিয়ে কি আপনার ব্যক্তিগত ট্রেনারের অধীনেই কাজ করেছেন?

যখন আমি ইনজুরিতে ভুগেছি, তখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি কেন এমন হলো। এমনকি আমি স্টেন্থ ও কন্ডিশনিং নিয়েও পড়া শুরু করলাম নিজের জন্য। কারণ ইনজুরিটা আমার মানসিক অবস্থা ও ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছিল। ২০০৯ সালে স্ট্রেন্থ ট্রেনিং শুরু করেছিলাম, কিন্তু একদমই বেসিক পর্যায়ের।

২০১২ সালে রাজমানি আমার বাসায় আসলো আর বলল, ‘আমি তোমার ট্রেনার হতে ও পার্থক্য গড়ে দিতে চাই।’ ২০১২ থেকে ২০১৫ অথবা ২০১৬, সে আমার জন্য সবকিছু করতো। তখন জাতীয় দলের ট্রেনার সুন্দারসানের সঙ্গে সে সমন্বয় করতো। এরপর শঙ্কর বসু জাতীয় দলের ট্রেনার হলো। তার পদ্ধতি ছিল একদমই আলাদা।

যখন আপনার সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের কাজ করা ট্রেনার থাকবে এবং তিনি হবেন জাতীয় দলের, তখন তাকে অনুসরণ করাটাই ভালো। এটা সবার জন্য সহজ। তবে শেষ পর্যন্ত আমি আবার রাজমনির কাছে ফিরে গেলাম। তার সঙ্গে দু বছর অনুশীলন করিনি। সে ওটা ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে নিয়েছিল। সে নিজেও ভালো ট্রেনার হতে পড়াশোনা করছিল। বসুর কিছু পদ্ধতি ধরে ফেলেছিল। আমার তাকে বলতে ইচ্ছে করেছিল, ‘বসু যা করেছে সেটা আমি করতে চাইনি, তোমার যেটা করার সেটা করো।’ এরপর আমি এ, বি, সি ও শেখা শুরু করলাম যেটা না করলেও চলতো। এভাবেই কক্ষপথে ফিরেছিলাম। রাজমানি ও বসুর কাছে আমার অনেক ঋণ।

মঙ্গা : আপনার কি কখনো মনে হয়েছে অনেক লম্বা সময় ধরে বাইরে আছেন?

২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে খেলাটা অনেকভাবে ভেবেছি। আমার মনে হয়েছে, ‘অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।’ যত কঠোরভাবে চেষ্টা করছিলাম, এটা আরও বেশি করে মনে হচ্ছিল। বিশেষত ওই দুইটা ইনজুরির পর- আমি ছয়টা বল করতাম এরপর মুমূর্ষ রোগীর মতো নিঃশ্বাস নিতাম। সব জায়গায় ব্যথা করতো।

আমাকে তাই মানিয়ে নিতে হতো। যখন হাঁটুর ব্যথাটা মারাত্মক হয়ে যেত, আমি পরের বলে লাফ দিতাম না। যখন লাফ কম দিতাম, তখন মূল জায়গায় ও কাঁধে স্বভাবতই বেশি চাপ দিতে হতো যেন পবালগিয়া ঠিক থাকে। তৃতীয় বলটা একটু অতিরিক্ত সাইড অন করতাম হিপটা কাজে লাগাতে। ওই সময় ছয় বল করেই আমি শেষ হয়ে যেতাম। অবস্থাটা এমন হতো, ‘আমার বিরতি দরকার।’

অনেক কারণে অবসরের কথা ভেবেছি। আমার মনে হতো, আমার ইনজুরির ব্যাপারে সবাই যথেষ্ট সংবেদনশীল না। মনে হয়েছে, অনেকেই তো সাহায্য পায়, কেন আমি বাদ যাবো? আমি তো দলের জন্য কম করিনি। অনেক ম্যাচ জিতিয়েছি, আমি অনুভব করেছি তবুও যথেষ্ট সাহায্য পাচ্ছি না। আমি সাধারণত কারো সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকি না- তবে তখন ওই মানুষটার অভাব বোধ করেছি যে আমাকে সাহায্য করবে, আমার প্রতি সহানুভূতি দেখাবে। আমার মনে হতো আমি দুর্দান্ত হতে পারিনি, কাঁধে একটা শক্ত হাতের অভাব বোধ করতাম। আমি ভেবেছিলাম নতুন কিছু চেষ্টা করা দরকার, যেটাতে আমি দুর্দান্ত হতে পারবো।

মঙ্গা : এই সময়টা কখন?

২০১৮ সালের ইংল্যান্ড সিরিজের ঠিক পরপরই। পরের বছর অস্ট্রেলিয়া সিরিজে আবার একই অনুভূতি হলো। অ্যাডিলেড টেস্টের আগে আমি আমার এবডোমিন ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। সিডনি টেস্টের আগে-পরেও একই কাজ করেছি। অনেক জায়গাতেও।  একটা মানুষের সঙ্গেই কথা বলতাম, আমার স্ত্রী। কিন্তু আমার বাবাও ছিলেন নাছোড়-বান্দা; তিনি বলতেন তুই আবার সাদা বলের ক্রিকেটে ফিরবি, আমি মরার আগেই সেটা দেখে যাবো। তার জন্য ব্যাপারটা ব্যক্তিগত হয়ে গিয়েছিল।

মঙ্গা : লোকজন বলার চেষ্টা করে আপনি অ্যাওয়ে সিরিজে গেলেই ইনজুরিতে পড়েন...

তারা সম্ভবত অন্য ক্রিকেটারদের এমন উদাহরণ দেখেছে। কিন্তু ব্যাপারটা আমার সঙ্গে হওয়ার পর অনুভব করেছি। তারা হয়তো ভাবে সেটা করাটা সঠিক। আমার কোনো সমস্যা নেই এতে। কিন্তু ইনজুরি হতেই পারে। শুধু যখন এটা ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করবে, তখন তারা বুঝতে পারে। সহানুভূতি ব্যাপারটা আপনাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে, মনে হবে ‘এটা যদি আমার সঙ্গে হতো?’ আমার মনে হয় ক্রিকেট কমিউনিটি হিসেবে, আমাদের এটার ঘাটতি আছে।

মঙ্গা : কখন আপনার মনে হলো রাজমানির কাছে আরেকবার ফিরে যাওয়া দরকার?

২০১৯ সালের অস্ট্রেলিয়া সিরিজের পর। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের আগে কাউন্টিতে গেলাম। রাজমনি আর আমি বিস্তৃতভাবে কাজ করলাম আট-দশ সপ্তাহ। সে আমার সঙ্গে ২০১৯ সালের পুরো আইপিএলের সময়টাতেই ছিল।

নিজেকে শারীরিকভাবে তৈরি করতে এটা ছিল চূড়ান্ত প্রচেষ্টা। আমি বিশ্বাস করি যদি আমি শারীরিকভাবে ঠিক থাকি তাহলে কেউ আমাকে থামাতে পারবে না। অন্তত নিজে যেন আয়নায় তাকিয়ে বলতে পারি,  ‘তুমি জানো, সবকিছু দিয়েছো।’ যদি এতে কাজ নাও হয়, সেটা মেনে নিতে রাজি আছি। এই কারণে আমার মনে হয়েছে একটা চেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তখন।

মঙ্গা : যখন কুলদ্বীপ ইয়াদব পাঁচ উইকেট নিলো সিডনিতে আর রবি শাস্ত্রী বলল সে বিদেশের মাটিতে সেরা স্পিনার। সে বলেছে, ‘সবার জন্যই সময় আছে। আমার মনে হয়েছে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন কারো সময় এসেছিল, চলে গেছে। সেটা কি আপনার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেছে?

আমি রবি ভাইকে অনেক সম্মান করি। আমরা সবকিছুই করেছি একসঙ্গে। ওই মুহূর্তে, আমার বিধ্বস্ত লেগেছিল। একদম বিধ্বস্ত। আমরা কীভাবে সতীর্থের সাফল্য উদযাপন করতে হবে এই ব্যাপারে কথা বলি। আমি কুলদ্বীপের জন্য খুশি ছিলাম। নিজে ফাইফার পাইনি, কিন্তু সে অস্ট্রেলিয়াতে ফাইফার পেয়েছে। আমি জানি এটা কত বড় ব্যাপার। এমনকি ভালো বল করেও আমি ফাইফার পাইনি। তাই আমি কুলদ্বীপকে নিয়ে সত্যিই খুশি ছিলাম। অস্ট্রেলিয়ায় জয় পাওয়াটাও আনন্দের জন্য বড় উপলক্ষ ছিল।

কিন্তু আমার যদি এখানে এসে তার ও দলের সাফল্যে উদযাপন করতে হয়। তাহলে অবশ্যই আমি এটাতে আছি মনে করতে হবে। যদি আমার মনে হয় আমাকে ছুঁড়ে বাসের নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে, কীভাবে আমি পার্টিতে এসে দল ও সতীর্থের সাফল্য উদযাপন করব? আমি রুমে ফিরে গেলাম, এরপর আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললাম। আমার বাচ্চারাও সেখানে ছিল। আমরা অসহায় বোধ করলাম এবং এরপরও পার্টিতে যেতে হলো। কারণ দিনশেষে অনেক বড় একটা সিরিজ জিতেছিল দল।

মঙ্গা : প্রথম টেস্ট জেতায় তো আপনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও ছিল...

তখন মনে হচ্ছিল প্রথম টেস্টটা বোধ হয় অনেক দূরের কোনো স্মৃতি। আমরা বাজেভাবে অলআউট হয়ে গেলাম, এরপর প্রথম ইনিংসে প্রথম চার ব্যাটসম্যানের তিনজনকেই আমি আউট করলাম। দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট যখন ফ্ল্যাট হয়ে গেল, তখন ৫০ প্লাস রান দিয়ে গ্র্যান্ড ত্রি এবডোমিনাল টিয়ার নিয়ে তিন উইকেট নিলাম। আমার মাথায় ছিল যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা নিয়েও দলের জন্য দারুণ কিছু করতে পেরেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি শোনলাম,  ‘নাথান লায়ান ছয়টা উইকেট নিয়েছে, অশ্বিন তিনটা।’

আমার শরীর নিয়ে হতাশ হয়ে গেলাম। যখন আমি সত্যিই ভালো বোলিং ফর্মে ছিলাম, তখন দমিয়ে দেওয়ার জন্য। শেষ যে ব্যাপারটা দরকার ছিল এমন তুলনা আর পরোক্ষ ইঙ্গিত। ওই প্রতিক্রিয়া আর সিডনিতে এসে আমার মনে হয়েছিল, দলের জন্য বোধ হয় কিছুই করিনি।

মঙ্গা : সিডনি টেস্টের পর ওই মন্তব্যগুলোর জবাবে উনি হয়তো বলতেন, ‘ওহ, আমি তাকে মোটিভেট করেছি, তার ভেতরে আগুনটা জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছি’ যেমনটা আমরা দেখেছি ঋষভ পান্তের সময়...

মোটিভেশন যাদের দরকার তাদের জন্য। কিন্তু যখন কেউ জীবনের কঠিন সময় পাড় করে এবং কাঁধে একটা হাতের অভাব বোধ করে...ওই সময়টা আমার জীবনের জন্য অনেক কঠিন ছিল।

মঙ্গা : আমি এমন অনেক সংবাদ সম্মেলনে ছিলাম, যেগুলোতে ইনজুরড খেলোয়াড়কে প্রটেক্ট করা হয়েছে। ওই অস্ট্রেলিয়া সিরিজে প্রতিটা ম্যাচের আগেই বলা হয়েছে অশ্বিন ফিটনেস টেস্টে পাশ করতে পারেনি। ভারতের ক্রিকেটে খুব অদ্ভূত ব্যাপারটা। পরে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ঘরের মাঠে আবার সুযোগ পেলেন। আপনি নিশ্চয়ই নার্ভাস ছিলেন...

আমি আসলে আট-দশ মাস ধরেই নার্ভাস ছিলাম। যতগুলো ম্যাচ খেলেছি, অ্যাথলেটিক পাবালগিয়া এমন একটা ইনজুরি যেটা আপনি সবসময় অনুভব করবেন। ধরেন, এবডোমিনের কাছাকাছি অথবা অ্যাডোকটরের আশেপাশে কিছু একটা অনুভব হবে। আমার মনে হতো, ‘এটা কি চলে গেল? আমি কি আবার এটার জন্য আবার প্রটেকশন নেব?’ এমন ধরনের মস্তিস্কবিকৃতি হতো।

আমার মনে হয় নিজের আত্মসচেতনতা খুব ভালো ছিল। আর আমি খুব ভেবেছি। এটা তাই আমার জন্য আরও কঠিন হয়ে গেছে। যদি আপনি ইনজুরড হন, আবার ফিরে আসেন, আপনি মাথা থেকে সেটা সরাতে পারবেন না। কিন্তু যদি আপনি ইনজুরড হন আর আমি যে ধরনের মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছি তেমন কিছুর মধ্য দিয়ে যান, আরও বেশি কঠিন ভুলে থাকাটা। আমার মনে হয় অভিজ্ঞতাটার জন্য খুব ভালো অবস্থানে ছিলাম। খুব ভালো জায়গায় ছিলাম জীবনের প্রতিকূলতা সামাল দিতেও, যেটার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

আমার এর আগে কখনোই সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার ছিল না। কখনও হেরে যাওয়াকে ভয় পাইনি। মাঠে গিয়ে পারফরম্যান্সের দিক থেকে হেরে গেছি, সেটা ঠিক আছে। ধোনি সবসময় যেটা বলে, এটা আসলে প্রক্রিয়ার বিপক্ষে ফলের লড়াই। আমি বিশ্বাস করি অবশ্যই আমি প্রক্রিয়াটা অনুসরণ করেছি। লাখ বা কোটি মানুষের সামনে হেরে যেতে আমি ভয় পাই না। এটার মানে কিচ্ছু না। অন্তত আমি তো সেখানে যাওয়ার সুযোগটা পেয়েছি, যেটা অনেকেই পায় না।

আমার তখন ৩২ বছর- সম্ভবত তখনও বেশির ভাগ স্পিনারের সেরা সময়টা বাকি থাকে। আমি পর্দার আড়ালে যেতে তৈরি ছিলাম না ওই সময়। আমার মনে হচ্ছিল শরীরের মাধ্যমে কেউ আমাকে তেমন কিছুর জন্যই ডাকছে। যদি দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে আবার তেমন কিছু হতো, আমি হয়তো বলতাম, ‘এই শরীর দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ সৌভাগ্যবশত পুরো সিরিজে তেমন কিছু হয়নি।

মঙ্গা : মানসিক ট্রমার কথা বললেন, কাটালেন কীভাবে?

একজন মেন্টর পেয়েছিলাম যার কাছে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ। এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেলে শুরুতে আপনার নিজেকে বলি হয়েছেন মনে হবে। এটা সবচেয়ে সহজ ব্যাপার, বেশির ভাগ মানুষ ভাবে জিনিসটা আপনি করতে পারবেন। যখন আপনি একবার এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাবেন, অনেক কিছুই পরিষ্কার হবে। যতগুলো মানুষ কোনো কিছুর শিকার হয়েছে, তখন অনেক মানুষ থাকবে যাদের দোষ দেওয়া যায়। কিন্তু যদি আপনার ত্যাগের ইচ্ছে আর কাজ করে যাওয়ার শক্তি থাকে, তখন এমনিতেই মানুষের বাধা টপকাতে পারবেন।

রবি ভাই ও আমার বিধ্বস্ত হওয়ার ব্যাপারটাতে, আমি জানি অনেক মানুষ এই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেলে সারাজীবন তার প্রতিপক্ষ হয়ে থাকত। কিন্তু আমি তাদের দলের না। আমি আসলে একটা টেবিলে বসে এই ব্যাপারে কথা বলতে পেরেছি। আমার কাছে, উনিই সব করেননি। কারণ যে কেউ ভুল করতে পারে। তাই আমি এটার বাইরে গিয়ে তাকিয়েছি। কেউ তার মত বদলাতেই পারে। আজ হয়তো সে খারাপ, কিন্তু কাল ভালোও হতে পারে। আপনি যতক্ষণ লোকজনকে সে যেটা তার জন্য দেখেন আর তাদের বেনিফিট অব ডাউট ও সহানুভূতি দেবেন, আপনি নিজেও ঠিক থাকবেন। এটা কোনো আধ্যাত্মিক অর্থহীন কথাবার্তা না। বাস্তবেও আমি এরকমই।

মঙ্গা : আপনি তো আর লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কিন্তু নিজে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন সেটাকে করতে পারবেন

একদম। দেখেন, আপনি কখন বাদ পড়বেন সেটা কি আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে? না, এটা অন্য কারো পছন্দে হবে। এখন আমি কি যে আমাকে বাদ দিয়েছে তার বিরুদ্ধে থাকব? আমরা সবাই জানি ওই লোকটা দলের ভালোর জন্য সেরাটাই করবে। আমি এটাকে ব্যক্তিগত কিছু বানাতে চাই না।

মঙ্গা : তার নিজের চাকরিও তো ভারতের জয়ের ওপর নির্ভর করে। তাই সে নিজেও ভারতের জন্য যেটা ভালো বলে বিশ্বাস করে, সেটাই করবে...

উনি যেটাই বিশ্বাস করুক, সেটা ভুল হোক বা সঠিক, আমি আনন্দের সঙ্গে আলাপ করতে রাজি আছি। কারণ আমার মাথায় আছে, আমিও বিশ্বাস করি, ভারতকে ম্যাচ জেতাতে পারবো। কিন্তু শুধুমাত্র তখন যখন আমি জানবো আলাপচারিতার কোনপাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি। যেমন, আমি একটা সত্যিকারের কারণে বাদ পড়লাম, যারা সিদ্ধান্তটা নিলো, খেলোয়াড় ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে যদি সত্যিকারের আলাপ হয় তাহলে সেটা আমি ব্যক্তিগতভাবে নেবো না। কিন্তু যখন কোনো কথা হবে না, আমি মানসিক শান্তি পাবো না। সবার এটার দরকার হয় না, কিন্তু আমার লাগে।

প্রশ্ন : আমরা গত দেড় বছর ধরে শান্ত এক অশ্বিনকে দেখছি। এটা কি মহামারির সময়টা কাজে লাগিয়ে হলেন?

এটা আরও আগে থেকেই শুরু হয়েছে। একজন মেন্টাল কন্ডিশনিং কোচের সঙ্গে চার থেকে ছয় মাস কাজ করেছিলাম। মানসিক উন্নতিতে সে সাহায্য করেছে, আমার মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য এনেছে, কখনো আয়নাও হয়েছে।

খারাপ সময়ে যখনই আপনি কারো সঙ্গে কথা বলবেন, বেশির ভাগ লোক আপনাকে বলবে কীভাবে ভালো করতে পারতেন, আপনার তরফ থেকে কী ভুল হয়েছে। কখনোই বলবে না অন্য কেউ আপনার সঙ্গে ভুল কিছু করেছে।

এখন এই দুটা চিন্তাভাবনাই ভুল, এটাই আমার মনে হয়। যখন কেউ আপনাকে সাহায্য করতে আসবে, তাদের কখনো ভুল বলবেন না, তাদের কখনো বলবেন না অন্য মানুষটা ভুল।  আপনার শুধু আওয়াজ করে যেতে হবে, তাদের আলাদা পথ দেখাতে হবে। যেটা সে (মেন্টাল কন্ডিশনিং কোচ) আমার সঙ্গে করেছে।

তার সঙ্গে প্রথম যেদিন কথা হলো- আমি বললাম, ‘বস, আপনি যদি বলেন আমার ভুল হয়েছে। তাহলে আমি আর এসবে নেই। কারণ জীবনভর এগুলোই শুনেছি, এখন আর সময় নেই শোনার।’ তারপর উনি বলল, ‘ওকে, ওকে, চিন্তার কিছু নেই। আমি কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছি, শুধু এটার উত্তর দিয়ে দিলেই হবে।’ সে এটাকে আলাদা একটা পথে নিয়ে গেল। আর হ্যাঁ, এতে কাজ হয়েছে।

মঙ্গা : তাহলে উনিই সমাধানটা এনে দিলেন? যেমন, আপনি এটা থেকে কীভাবে বের হবেন?

একদম, এটাই তো আমাদের দরকার, তাই না? সবারই সমস্যা থাকে। আর সবাই আপনাকে সমস্যায় নিয়ে ফেলবে। খুব অল্প মানুষ আছে যারা সমাধান খুঁজে বেড়ায়। সমাধানটা এনে দেয় এমন মানুষের সংখ্যা আরও কম।

মঙ্গা : উনি বলেছে, কী হয়েছে, কী ভুল করেছেন সেসব না ভেবে কীভাবে সব ঠিক করা যায় আর কী বাকি আছে সেটা নিয়ে ভাবতে?

উনি কখনোই স্পষ্টভাবে এমন কিছু বলেননি। কিন্তু ঘটনার পর, আমার মনে হয়েছে সে কীভাবে আমাকে ভাবাচ্ছে। পুরো থেরাপিতে উনি কখনো বলেনি, ‘এই লোকটা ভুল, তুমি সঠিক’ অথবা ‘তুমি সঠিক, এই লোকটা ভুল।’ সে অন্যরকম আলো দেখিয়েছে। আমার কথা শুনেছে। আমাকে বুঝিয়েছে, তুমি সবার সঙ্গে একইভাবে সম্পর্ক রাখতে পারবে না। আলাদা ব্যক্তিত্বের মানুষ থাকবে। আর আমাকে তাদের সঙ্গে আলাদাভাবে সম্পর্ক রাখতে হবে তারা যেন ক্ষুব্ধ না হয়। শুরুর দিকে আমি যাই অনুভব করতাম, শুধু মনে করতাম মুভ অন করা দরকার যেটা আমার হৃদয়কে হালকা করবে। কিন্তু অন্য কেউ হয়তো আমার কথায় কষ্ট পেতে পারে, এটা নিয়ে ভাবতাম না।

মঙ্গা : এবার একটু টেকটিক্যাল প্রস্তুতির ব্যাপারে আসি। আপনি কত ভিডিও দেখেন আর কখন?

ইংল্যান্ড যখন ভারতে এলো, আমি তাদের পুরো শ্রীলঙ্কা সিরিজ দেখেছি একটা বলও বাদ না দিয়ে। আমি হরির (ভারতের টিম অ্যানালিস্ট) কাছে গেছি আর জানতে চেয়েছি এম্বোলদোনিয়া কত গতিতে বল করল, দিলরুয়ান কত, কত শতাংশ বল স্টাম্পে ছিল। আমাদের একটা অ্যাপ আছে যেখাটে শটস থাকে, আমি আবার দিলরুয়ানের বল দেখেছি।

উদাহরণ হিসেবে ধরেন, জো রুট কখনও টানা দুটা বল ব্লক করবে না। তার ডিফেন্সে কিছুটা দুর্বলতা আছে আর আমার মনে হয় সে নিজেও সেটা জানে। অথবা সে সবসময় মুভ করে। তাই যতবারই সে অফ স্টাম্পের বাইরের বল ভালোভাবে ডিফেন্ড করবে, পরের বলটা সুইপ করবে।

মঙ্গা : অথবা রিভার্স সুইপ...

না না, তারা রিভার্স সুইপ করবে না। যখন আপনি অ্যারাউন্ড দ্য স্টাম্প যাবেন শুধু তখনই রিভার্স করবে। যতবারই অ্যারাউন্ড স্টাম্পে যাবেন, প্রথম বল, জ্যাক ক্রলি, জো রুট, সবাই রিভার্স সুইপ করবে। তারা অ্যাঙ্গেলটা পছন্দ করে আর আমি দেখি সেটা কেন।

যদি আপনি দেখেন, পুরো সিরিজে আমার মনে হয় না রুট আমাকে কতৃত্বের সঙ্গে সুইপ করতে পেরেছে। সে হয়তো সিঙ্গেল পেয়েছে, কিন্তু বাউন্ডারি খুবই কম। চিপাকে যে টেস্টটা হলো, দ্বিতীয় ইনিংসে অসম্ভব চাপের ভেতর সে আসলো আর স্কয়ার লেগ দিয়ে দুটা সুইপ করল। প্রথম ইনিংসে সুইপ করে কোনো বাউন্ডারি মারতে পারেনি। সেঞ্চুরি করার পর সে আমাকে দিনের শেষ দিকে ছক্কা মারল। কিন্তু স্বস্তির সঙ্গে সুইপ খেলে বাউন্ডারি মারতে পারেনি আমার বলে। (রুট চার টেস্টের ওই সিরিজে মোট ১৯ টি সুইপ শট খেলেছেন অশ্বিনের বলে, বাউন্ডারি পেয়েছেন তিনটি। শ্রীলঙ্কায় দুই টেস্টের সিরিজে তাদের মূল স্পিনারদের ৪৩ বার সুইপ করে ৩৯ বার পেয়েছেন বাউন্ডারি।)

মঙ্গা : তো আপনার অ্যাপ বল বাই বল ভিডিও দেয় সব ম্যাচের?

আমি চেষ্টা করি যোগাড় করার। অ্যাপে কিছু না থাকলে অ্যানালিস্ট কোম্পানিকে ডাকি। সাধারণত ভারতের সব ম্যাচ সেখানে থাকে। অন্য ম্যাচের শুধু বাউন্ডারি আর উইকেটগুলো পাই। আমার জন্য প্রতিটা বল দেখা গুরুত্বপূর্ণ।

আমাকে মারতে হলে আমি জানি স্টেপ আউট অথবা সুইপ করতে হবে কারণ আমি বাতাসে বল স্লো করে দেই না। তাই আপনাকে একটু আগে মুভ করতে হবে। আর আমি শেষ মুহূর্তেও বদলাতে পারি। স্টেপ আউট করলে ধরে ফেলতে পারি। সুইপ আর রিভার্স সুইপও আগে পড়ে ফেলতে পারি। এমনকি কোনো ব্যাটার যখন সিঙ্গেলও নেয় সুইপ করে, আমি আউটের সুযোগ দেখি।

মঙ্গা : আপনি তাহলে সিরিজের আগে ভিডিও দেখে এসব তথ্য পান?

আমি প্রতিটা বল দেখি। প্রথমে এমনিতে দেখবো, এরপর স্লো মোতে দেখবো, তারপর সুপার স্লো মোতে দেখবো। চেষ্টা করব যতটা সম্ভব কাটাছেঁড়া করার। যদি এতে না হয়, তাহলে স্ক্রিনটা আলাদা করে দেখবো। এরপরও যদি পুরোপুরি ব্যবচ্ছেদ করতে না পারি, হরির কাছে যাই আর জানতে চাই বল এ, বল বি, বল সি এর জন্য আলাদা স্ক্রিন করা যাবে কি না। এর মধ্যে আমি খেলাটায় ঢুকে যাই, আমি এর আগে কিচ্ছু বাদ দিতে চাই না। আমি মাঠে ব্যাটসম্যানদের বুঝতে পারায় সবসময়ই ভালো, কিন্তু গেল তিন চার বছরে আমার মনে হয় নিজের অ্যানালাইসিস ও ব্যাটসম্যানকে বুঝতে পারাটা অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছি। কারণ আমার মনে হয় আমি যেতে পারবো এমন ০.৫% ও বাদ দেই না।

মঙ্গা : যখন অস্ট্রেলিয়াতে গেলেন। স্টিভ স্মিথকে নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী ছিল?

ছয় সপ্তাহের জন্য আমি তাকে নিয়ে ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম, কেবল দুই বা তিন সপ্তাহের জন্য না। শুধু ফুটেজ দেখেছি, আলাদা ম্যাচ দেখেছি। সর্বশেষ যে সিরিজটা তারা খেলেছিল (২০২০ সালে ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে) নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে। আমি প্রতিটা দিন দেখেছি। অ্যাপে গেছি আর দেখেছি লাবুশেন উইল সামেরভিলের বলে কত রান করেছে? কোন বলটা সে কাউ কর্নার দিয়ে মারল?

আমার মনে হয় অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে প্রিমেডিটেড শট খেলার প্রবণতা আছে। ‘অজিদের মতো খেলা’ বলে তারা আক্রমণাত্মক বিকল্পটা খুঁজে। অজি পিচগুলো ট্রু হয়। তাই আপনি বলের পিচিং না দেখেই উইকেট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন, বোলারদের জন্য যেটা খুব বিরক্তিকর।

স্পিনার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় আপনাকে সব ঠিকঠাক রাখতে হবে। প্রতিটা রান শর্ত মেনে দিতে হবে। তো, লাবুশেন যখনই উইকেট থেকে বেরিয়ে এসেছে, সে কাউ কর্নার দিয়ে মেরেছে স্পিনারদের অথবা মিড অফের ওপর দিয়ে। খুব কম সময়ই সেটা লং অনে মেরেছে। কখনও ফ্ল্যাট সুইপ খেলেনি। লেপ সুইপগুলো ছিল প্যাডেলের মতো। এই সবগুলো শট ছিল ঘোড়ার মতো এবং খুব ঠিকঠাক।

যদি আপনি না জানেন অথবা যথেষ্ট ফুটেজ না দেখেন, এসব ব্যাপার বের করতে পারবেন না। আর স্মিথের ব্যাপারটা হলো, সে খুব বেশি মোমেন্টাম নির্ভর ব্যাটিং করে। তার সব ব্যাটিংই আসে হাত থেকে, আমার ভাবনা ছিল তার হাতটাকে বিরক্ত করা পুরো সিরিজজুড়ে। তার হাত নাড়ানোর একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। আপনার সেটাকে ধরতে হবে আর এমনভাবে বল করতে হবে যেন ওই প্যাটার্নটা বাধা পায়। তাই আমি ভিন্ন লোড আপস, আলাদা গতি ও রান আপে বল করেছি। আমার মনে হয়েছে আমি বোধ হয় তাকে ধরতে পেরেছি।

মঙ্গা : প্রস্তুতি ম্যাচগুলোর জন্য নিজেকে কীভাবে তৈরি করেন? অথবা যখন প্রস্তুতি ম্যাচ থাকে না আর টেস্ট ভেন্যুতে যাওয়ার আগে চার-পাঁচদিনের অনুশীলনের সময় পাওয়া যায়?

বিশেষত যখন বাইরে যাই, টেল এন্ডারদের দ্রুত ফেরানো গুরুত্বপূর্ণ। আমি কিছু ডেলেভারি অনুশীলন করি। যেটা দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজে লাগবে। শুধুই কিছু আলাদা বল, যেটা চেষ্টা করি ও প্রস্তুতি ম্যাচেই পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করি। এরপর চেষ্টা করি বলটা ব্যবহার করায় অভ্যস্ত হতে।

যখন সাইড পজিশনে থাকবেন, ডিউক বলের ড্রিফটটা বিস্তীর্ণ হয়ে যায়। আর আউটসাইট লেগে পিচ করতে শুরু করে বাঁহাতিদের জন্য। ডিউক বলে যখন আপনি স্ক্র‌্যাম্বলড সিমে বল করবেন, অনেক সময় হয়তো আকাঙ্ক্ষিত ফলটা পাবেন না। কুকাবুরা বলের শেপটা খুব ভালো থাকে। স্ক্র‌্যাম্বলড  সিমটা এখানে আলাদাভাবে ব্যবহার করা যায়।

কিন্তু ডিউক বল হাতে খুব বড় মনে হয়। তাই কখনো কখনো স্ক্র‌্যাম্বলড সিমটা কাজ করে না। চকচকে দিকটা ধরে ফেলতে পারার সম্ভাবনা তাই বেশি। আপনি সেটা চাইবেন না। কিন্তু যে পিচে বাউন্স ও ক্যারি আছে, আমার মনে হয় স্ক্র‌্যাম্বলড সিমটা খুব ভালো সুবিধা দেয়।

আমি চেষ্টা করি আর দেখি স্ক্র‌্যাম্বলড সিম আমাকে ফলটা দেয় নাকি। যদি একই রকম বল করি নরমাল সিমে, এটা অফ স্টাম্পে পিচ করবে। যদি স্কয়ার সিমে বল করি, এটা হয়তো মিডল স্টাম্পে পিচ করবে। আর যদি স্ক্র‌্যাম্বলড সিমে বল করি, এটা হয়তো ফিফথ স্টাম্পে পিচ করবে। তো এই বিষয়গুলো প্রস্তুতি ম্যাচে দেখি।

আমার সাধারণ রুটিন হচ্ছে কিছুটা সাইড অন, কিছুক্ষণ ফ্রন্ট অনে থেকে দেখা, কাঁধের পেছনের ও সামনের দিকে ভার নিয়ে দেখা। এরপর আলাদা রিস্ট পজিশন দেখি কোন জায়গা থেকে ব্যাটসম্যান ও নন স্ট্রাইকারকে দেখা যায়। সবকিছুই দেখি। এসব প্রস্তুতি ম্যাচকে কখনোই প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ম্যাচ হিসেবে দেখি না। এসব ম্যাচ খুব ভালো পরীক্ষাগার। আমার জন্য অ্যাকশনের ভেতরে ঢুকার মঞ্চ। রান আপ স্পিড, রিদম, আমার রান আপের গতিটা দেখে নেওয়া, শেষটা, লাফ দেওয়া, সাইড অন, ফ্রন্ট অন, সিম ওপেন, হাইপার এক্সটেনশন এসব কিছু দেখারও। আমার অনেক বিষয়ের ভেতর দিয়েই যেতে হয়।

মঙ্গা : যখন আপনি টেস্ট ভেন্যুতে যান, নেটে অনুশীলন করার মতো হাতে দুদিন সময় থাকে। তখন কী করেন?

স্পিনারের জন্য লেন্থটা অবশ্যই ঠিক রাখতে হবে, লাইনটা অপশনাল। আমার মনে হয় কিছু মাঠে যখন আপনি বল স্পিন করাবেন, বল যতটুকু চেয়েছেন তার চেয়ে বেশি ফুলার হয়ে যাবে। আর এটা অনেক কারণে হতে পারে। আমি আবার ফিরে গেলাম আর বুঝতে পারলাম আমার কন্টাক্ট পয়েন্ট আরও ভালো করতে হবে। আমার লেন্থ আমার পা কোথায় পড়ল সেটার ওপর নির্ভর করে।

অনিল (কুম্বলে) ভাই যখন কোচ ছিল আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি। উনি আমাকে বলেছেন, ‘বল যদি সামনে পড়ে, ক্রিজের পেছন থেকে বল করো’। আমি এটা চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছু কারণে কাজ হয়নি। আমি ক্রিজের পেছন থেকে বল করেছি যখন আমার মনে হয়েছে এটা চাই।

কিছু নির্দিষ্ট কারণে আমার মনে হয়েছে কন্টাক্ট পয়েন্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে ধরেন, যদি আমার বলটা ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে মনে হয় সামনের পা মাটিতে পড়েছে, এটা নির্দিষ্ট একটা জায়গায় পড়বে। আমার পা গোড়ালি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত পড়াটা মাথায় রাখি। যদি আমার পায়ের আঙ্গুল পড়ার পর বলটা ছাড়ি, তাহলে এটার আলাদা ফল হবে। যদি আমার অগ্রসর হওয়ার দৈর্ঘ্য কমিয়ে দেই ও রান আপ স্পিড বাড়িয়ে দেই, সেটার একটা ভিন্ন ফল হবে।

তো প্রতিটা আলাদা জায়গা, প্রতিটা বল আপনাকে আলাদা ফল দেবে। যদি আপনি এগুলো ও কন্ডিশন আগে বুঝে যান, ভালো করাটা সহজ। কখনও যথেষ্ট সময় থাকে না যখন আপনি দেশের বাইরে ট্যুরে যান। কখনও আপনি খেলছেন এমনভাবে শিখবেন। এজন্য প্রথম পাঁচ ছয় ওভার একরকম হয়, পরেরগুলো আলাদা।

মঙ্গা : তো আপনার পায়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে?

আমি বল রিলিজে দেরি করতে পারি। এসব আসলে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত ফলটা হয়তো অন্যরকম হতে পারে কিন্তু বেশির ভাগ সময় আমি যেটা মনে করবো সেটাই হবে। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় আমার পায়ের সব আঙ্গুল মাটিতে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি, শরীরের ওজনটাকে সামনে আনি, এরপর বলটা ছাড়ি। আমি বাতাসে সময় কম দেই।

অনেক ব্যাটার রিলিজ পয়েন্টটা দেখেই স্টেপ আউট করে। কিছু এমন হয়, কেউ হয়তো দেখল আমার আর্ম ৯০ ডিগ্রিতে আছে, আমার ঘাড়ের কাছে, সে হয়তো ভাববে সুন্দর বল আসবে, ফ্লাইট থাকবে। তখন আমি আমার পায়ের আঙ্গুল মাটিতে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি ও বলটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলটা করি। তার মানে হচ্ছে সে বেরিয়ে এসেছে আর আমি কিছু বাড়তি সময় পেয়েছি।

সবার শরীর কিছু সূত্র মেনে চলে। আমার মনে হয় সবাই বলের রিলিজটা দেখে এরপর স্টেপ আউট করে, পেছনে যায় অথবা যা কিছুই করুক। কিছু মানুষ গতিপথ ঠিক রেখে যাবে, আমার মনে হয় এখানে দেরি অথবা তাড়াতাড়ি করার মতো সামর্থ্য আমার আছে। তো এটা তাড়াতাড়ি অথবা দেরিতে করেও আমি লেন্থ মিস করি না। এ কারণেই লেন্ডিংয়ে এত বৈচিত্র্য আনতে পারি। 

মঙ্গা : দুইটা ম্যাচের মাঝখানে কী করেন?

আমি নিজের অভিজ্ঞতায় আবার ঘুরে আসি। কেউ আমাকে কীভাবে খেলেছে, শটটা কীভাবে করেছে, তারা কীভাবে আমাকে মেরেছে যদি সেটা করে থাকে, কীভাবে আমি আলাদা কিছু করতে পারি। কোনটা কাজে এসেছে, কোনটা আসেনি। এটাই প্রসেস ও ফল, তাই না? শুধু প্রসেসটাকে সাধারণভাবে মেনে চলাটাই প্রসেস না।  

কিছু কাজ করে, সেটা ধরে থাকা। এটা আসলে কাজ না, কাউকে ছুঁড়ে ফেলা? এই ধরনের বিষয়ে স্টিভ স্মিথ এমন একজন যে ভাবে। ধরেন প্রথম টেস্টের পর (স্মিথ স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন), সে তখন সামনের পায়ের বলের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করল। যেটা ছিল আগের আউটের প্রতিক্রিয়া।

মঙ্গা : তাহলে আপনি যদি বুঝতে পারেন কেউ সেরাটা খুঁজছে, তারা সমাধানটা বের করে ফেলেছে। আপনি ওই সমাধানটার জন্য প্রস্তুত। প্রথম ও দ্বিতীয় টেস্টের মাঝখানে তিনদিন সময় থাকে। এই তিনদিনে কি সবগুলো বল দেখেন?

আমি স্মিথ ও লাবুশেনের প্রতিটা নেট সেশনের ফুটেজ যোগাড় করেছি। মেলবোর্নে এমনকি তারা সুরাজ রানদিবকে (শ্রীলঙ্কার সাবেক অফ স্পিনার) নিয়ে এসেছিল। আমার মনে হয় তার আমার মতোই উচ্চতা ছিল অথবা ওই রকম হাই আর্ম ছিল। লাবুশেনের পরিকল্পনাই ছিল অফ সাইডে চলে যাওয়া কারণ সে স্টেপ আউট করেছে আর ফ্লাইটে বিট হয়েছে অ্যাডিলেডে।

সে ব্যাক ফুটে গেছে আর তখন আমি বলের গতিতে পরিবর্তন এনেছি বা এমন কিছু। নেটে সে মিড অন দিয়ে ড্রাইভের চেষ্টা করেছে আর এরপর শুধু সিট ব্যাক করেছে আর অফ সাইড দিয়ে রান করার চেষ্টা করেছে। আমি তাই এটার জন্য তৈরি ছিলাম।

এমনকি লাবুশেন যখন দ্বিতীয় টেস্টে এলো, ব্যাট-প্যাড চান্স ছিল কিছুটা। যেটা পূজারার মাথার ওপর দিয়ে গেছে। এরপর থেকে সে অফ সাইডে খেলা শুরু করল। যখন সে অফ সাইডে খেলে, সামনে আসতে চায় না।

মেলবোর্নে ভালো ড্রিফট ছিল, আমি তাই রাউন্ড দ্য স্টাম্পে আসলাম। যখনই আপনি রাউন্ড দ্য স্টাম্পে আসবেন, মার্নাসের ওই অভ্যাস ছিল লাইনটা দেখা আর ফ্ল্যাট সুইপ করার। যখন আপনি ওভার দ্য স্টাম্পে যাবেন, সে ফ্ল্যাট সুইপ করবে না। সে শুধু ওভার দ্য উইকেটে গেলেই প্যাডেল করবে।

যখন আপনি রাউন্ড দ্য উইকেট যাবেন, হার্ড সুইপ করবেই। আমার মনে হয় সে এটা সামারভেলিরের বলে করেছে। তো যখনই আমি অ্যাঙ্গেলটা বদলেছি, আমি জানতাম সে সুইপ করবে। যখন কেউ রাউন্ড দ্য স্টাম্পে যায় তারা ভাবে না সে তার অফ স্টাম্পে বলটা পিচ করানোর মতো ক্ষমতা নেই।  

অথবা তারা এই ধরনের স্পিনই খেলে। তো আমি ক্রিজের কর্নারে গেলাম আর অস্বস্তি তৈরি করলাম। তখন কেবল এটা নিশ্চিত করলাম সে তার বাম চোখ দিয়ে দেখুক। বলটা সুন্দরভাবে ড্রিফট করেছে। সে সুইপ করতে চেয়েছে আর বল প্যাডে গিয়ে লেগে আউট হয়েছে। কিন্তু ডিআরএস তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। পরের ইনিংসেও একই ঘটনা ঘটল।

ওভার দ্য স্টাম্প এলাম, তাকে কিছু ড্রাইভ দিলাম অফ সাইডে খেলতে এরপর আবার রাউন্ড দ্য স্টাম্পে চলে এলাম। এবার আর সে সুইপের চেষ্টা করল না, স্টেপ আউট করল আর মারতে চাইল। এরপর আউট হয়ে ফিরে গেল। এখন তার জন্য একটাই বিকল্প বেঁচে ছিল অফ সাইডে যাওয়া। যেই মুহূর্তে সে ফ্ল্যাট দেখল, পেছন ফিরল আর বল ড্রিফট করল। বলটা ফ্ল্যাট আর ফুল ছিল আর সে ক্যাচ দিয়ে আউট হলো। সে যখন পেছনে গেল, সে নিজেই সামনে আসতে বাধ্য হলো। আপনি চাইলে ফুটেজ দেখতে পারেন।

মঙ্গা : তিন বছর আগে অবসরের কথা ভেবেছেন। এখন হরভজন সিংকে টপকে গেছেন টেস্টে ভারতের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর তালিকায়। খুব শিগগিরই কপিল দেবকে ছাড়িয়ে যাবেন। টি-টোয়েন্টি দলেও ফিরেছেন। এরপর কী?

সত্যি বলতে আমি এসব নিয়ে ভাবি না। ক্যারিয়ারের এমন একটা পর্যায়ে আছি যেখানে অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময় নেই। শুধু ক্রিকেটটা খেলতে চাই। একটা ব্যাপার আমাকে বের করতে হতো, আমার মাথা কেন বলেছিল হাল ছেড়ে দিতে? কেন অবসর নিতে চেয়েছিলাম? আমি আসলে খেলাটা উপভোগ করছিলাম না।

কেন? কারণটা ছিল বাইরের। যদি আমার চিন্তা ভেতরের বিষয়ে আনতে পারতাম, খেলাটা উপভোগ করতে পারতাম। আমার যেটা করতে হতো যা কিছুই হোক, সেটা মেনে নেওয়া। আমি দলে থাকি অথবা না থাকি, পারফর্ম করি অথবা না, নিজের টার্মেই থাকব।

যখন অস্ট্রেলিয়ার বিমানে চড়লাম। আমি সত্যিই নিজেকে বলেছি, এটাই তোমার শেষ ট্যুর, এটাই শেষ। একটা শিলাও যেন উন্মুক্তহীন না থাকে। নিজেকে বলেছি, ‘কখন প্রথম সুযোগটা পাবে সেটার জন্য তৈরি থাকতে হবে। এটা হয়তো প্রথম টেস্টে হবে না। হয়তো দ্বিতীয় টেস্টে, অথবা তৃতীয় বা চতুর্থ টেস্টে হবে। অথবা তুমি হয়তো পুরো সিরিজটাই বসে কাটিয়ে দেবে।’ আমি আশাও তেমনই করেছিলাম। পরিবারকে নিয়ে গিয়েছিলাম কারণ তাদের সমর্থন আমার দরকার ছিল। আপনি নিজেকে বলছেন এটাই শেষ সফর। আপনি সেখানে গেছেন আর জেনেছেন প্রথম ম্যাচে আপনি নেই!

এটা আসলে কোনো ব্যাপার না। আমার জন্য ক্রিকেট শুধু খেলার বাইরেও বেশি কিছু। আট মাসের মতো ভারতের সাদা বলের কোনো খেলাই দেখিনি। সেটা যখন আমাকে আঘাত করল, তখন বুঝতে পারলাম মানসিক ট্রমার মধ্যে আছি। মেন্টাল কন্ডিশনিং কোচের কাছে গেলাম আর বললাম, ‘বস আমার জন্য ক্রিকেট না দেখে থাকাটা অবিশ্বাস্য।’ এখন কালকে যদি আমি না খেলি অথবা কেউ আমাকে লাত্থি দিয়ে বের করে দেয়, আমি এরপরও ক্রিকেট দেখব। কারণ খেলাটাকে ভালোবাসি।

আর আমি যদি খেলাটা না দেখতে পারি, তাহলে এটা পরিষ্কারভাবে বলবে ব্যাপারটা ব্যক্তিগত। এটা ব্যক্তিগত হোক বা না, অথবা অন্য কোনো মানুষের জন্য, আমি এসব গুণি না। আমি এটা ব্যক্তিগতভাবে নিতে পারি না, কারণ আমার মধ্যে আরও ভালো হওয়ার মতো বুদ্ধি আছে। কিন্তু আমার কাছে সমাধান ছিল। আমি বিশ্বাস করতাম কেন সুযোগ পেয়েছি। যদি সমাধান না থাকতো, হয়তো সুযোগ পেতাম না। এটা হয়তো আধ্যাত্মিক শোনাচ্ছে, কিন্তু ব্যাপারটা এমনই।

মঙ্গা : এরপর জাদেজা ইনজুরড হলো আর আপনি সুযোগ পেলেন খেলার। আপনি কি অ্যাডিলেড টেস্টের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন যদি দলে নাও থাকেন?

অবশ্যই। যদি না খেলতে পারি, খেলবো না। যদি জাদেজা খেলে আর বল করে, আমি শিখতে পারবো। বাইরে থেকে শিখতে পারবো ব্যাটাররা কীভাবে খেলে। আর হয়তো পরের ম্যাচেই আামি সুযোগ পাবো। যদি আমি ভাবি সুযোগ পাইনি, তো চুপ করে বসে থাকি, এরপর সুযোগ আসে ও ব্যর্থ হই। আমি ওই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলাম না তাহলে।

মঙ্গা : আপনার স্ত্রী এমসিজিতে জেতার পর টুইট করেছিল আপনাকে নাকি কখনও এত খুশি দেখেননি...

ভারতের ক্রিকেটের পুরোটাজুড়ে আসলে স্টারডম, ঠিক না? কোন টম, ডিক অথবা হ্যারি ৩৬ রানে অলআউটের পর ভারতকে সুযোগ দিয়েছে? মেলবোর্ন টেস্টের পর আমার মনে হয়েছিল, ‘তুমি জানো, তুমি ভারতকে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছো। আর আমি এখানে দেশকে আরেকটি ম্যাচ জেতানোর জন্য এসেছি।’ এটা অনেক প্রশান্তির ছিল। কিছুটা নির্বোধের মতো কাজও ছিল, কিন্তু পৃথিবীটা এভাবেই চলে।

মঙ্গা : আমি নিশ্চিত যদি দলের অংশ হতাম, আর কেউ বলতো একজন প্রথম টেস্টের পর বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, তাই তোমরা ৪-০ তে হারবে। আমিও তাহলে বিরক্ত হতাম।

উপযুক্তভাবেই আসলে। এটা একজন মানুষের ভুল না। এটাই উপলব্ধির ক্ষমতা। মানুষ বিশ্বাস করে, কে লড়ছে? কে বলে যে পূজারা, রাহানে, বুমরাহ অথবা অশ্বিন আছে। কে বলে? কেউ না। এমন না যে এই ছেলেরা দেশের জন্য ম্যাচ জেতায় না।

এমএইচ