মোহাম্মদ হাফিজ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন গেল বছরের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু এটিকে সময়ের সীমানার গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখা এক ধরনের অন্যায়। ৪০-পেরিয়েও এখনও কীভাবে ‘তরুণ’। ‘মর্ডান ক্রিকেটারদের’ সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে টিকে আছেন কী করে। নিজেকে ভেঙে নতুন করে বারবার গড়ার গল্প। 

অথবা কীভাবে এগিয়ে যাবে দেশের ক্রিকেট। ঘরোয়া কাঠামোই বা কেমন হবে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট অথবা ‘ট্যালেন্ট হান্টের’ কাজ আসলে কতটুকু। গলফ খেলতে খেলতে তিনি কীভাবে আবিষ্কার করলেন পা দুটো আরেকটু ঠিকঠাক করা দরকার। সবকিছুই বলেছেন পাকিস্তানি অলরাউন্ডার। 

তরুণ ক্রিকেটারদের অথবা ছিটকে পড়াদের জন্য এই সাক্ষাৎকার হতে পারে অনুপ্রেরণা। ক্রিকেটপ্রেমিদের জন্যও হতে পারে হাফিজের লড়াই জানার দারুণ এক মাধ্যম। দ্য ক্রিকেট মান্থলি ম্যাগাজিনে ওসমান সামিউদ্দিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের পুরোটার বাংলা অনুবাদ করেছেন মাহমুদুল হাসান বাপ্পী...

ওসমান : গত বছরের শুরুর দিকে আপনি আবার জাতীয় দলে ফিরলেন এরপর আবার বিশ্বকাপের পরই বাদ পড়ে গেলেন। এর আগে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে বা এমন কিছু ভেবেছিলেন?

হাফিজ : না। কোনোভাবেই না। আমি পাকিস্তানের হয়ে শেষ বড় ইভেন্ট খেলেছিলাম যেটা- বিশ্বকাপ। নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম। আমার দায়িত্ব ছিল মোমেন্টাম নিয়ে আসা অথবা ধরে রাখা। ৪ নম্বরে খেলেছি তখন। ওপেনারদের জন্য ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল। আমার দায়িত্ব ছিল আলাদা।

তো, অনেক জায়গায় লোকজনের মনে হয়েছে আমি ভুল শট খেলেছি; কিন্তু সেটাই আমার দায়িত্ব ছিল। আমাকে গিয়েই দ্রুত রান তুলতে হতো। হয়তো ২৫ বলে ২৫ রান করে আউট হয়েছি আর সবাই ভেবেছে উইকেটটা বোধ হয় ছুঁড়ে দিয়ে আসলাম। কিন্তু এটাই আসলে পরিকল্পনা ছিল।

ওসমান : আপনি সবসময় যেমন খেলতেন, হুট করে সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে বলা হলো। এটা আসলে কতটা কঠিন ছিল?

২০১৭ সাল থেকেই আমার দায়িত্ব বারবার বদলাচ্ছে। আমাদের ওপেনারদের বলা হয়েছে নতুন বলে উইকেট না হারিয়ে লম্বা সময় ধরে খেলতে। আপনি যদি তাদের আর আমার স্ট্রাইক রেট দেখেন, আকাশ-পাতাল ব্যবধান।

আমি কখনও এটা নিয়ে অভিযোগ করিনি। আমার জন্য এসব সবসময় একটা সুযোগ। আমি যাই বলি না কেন, সেটা পূরণ করার ১১০% চেষ্টা করি। ওপেনার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম, এরপর তিন ও চার নম্বরে খেলেছি, আবার ওপেনার হয়ে গেছি। কিন্তু কখনো কারো কাছে অভিযোগ করিনি যে ওই জায়গাটাতে খেলতে চাই।

ওসমান : কিন্তু মানসিকভাবেও কি ব্যাপারটা কঠিন ছিল না?

অবশ্যই ছিল। আপনি যদি পেছন ফিরে তাকান, আমাকে বদলাতে হয়েছে, নিজেকে নিজে প্রস্তুত করেছি, ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়েছি; শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই। এই কারণে এমনকি আজও আমি মডার্ন ক্রিকেট খেলা তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারছি।

২০০৩ সালে যখন ওপেনার ছিলাম, তখন আমার মানসিকতা ছিল আলাদা। নিজেকে বলে নিতাম, ওয়ানডেতে প্রথম ১৫ ওভার নতুন বল খেলতে হবে। যদি তোমার স্ট্রাইক রেট ৫০ হয়, সেটাও ভালো। আপনি ওই যুগ থেকে এখন আছেন ১৫০ স্ট্রাইক রেটে খেলার যুগে। আমি সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলেছি।

ম্যাচ উইনার হিসেবে রাখতে চেয়েছি সবসময়। শুধু ‘সো কল্ড’ হয়ে থাকিনি। সত্যিকারার্থেই ম্যাচ জিতিয়েছি। ২০১৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলাম। কিন্তু এরপরই আমাকে বাদ দেওয়া হয়- অবশ্যই সেটা কঠিন ছিল। আমি শত ভাগ খুশি মনে চলে যাবো যদি আমার চেয়ে ভালো কোনো তরুণ খেলোয়াড় আসে। কিন্তু সেটা যদি না হয়, কেন তারা আমাকে দেশের হয়ে খেলা থেকে আটকে রাখবে? আমি বোর্ড সভাপতির সঙ্গে দেখা করে বলেছি- যদি আমার চেয়ে ভালো কেউ থাকে, তাহলে নিয়ে আসেন। কিন্তু যদি না থাকে, আমার অভিজ্ঞতা ও পারফরম্যান্স পাকিস্তানের দরকার আছে।

বাদ পড়ার পর সুযোগ থাকতে পারে, এমন সব জায়গায় কথা বলেছি। যেখানে গিয়ে নিজের স্কিলকে ঝালিয়ে নিতে পারবো। যখন ফিরে আসলাম, অস্ট্রেলিয়া সফরের ঠিক আগে বোর্ড সভাপতির সঙ্গে কথা বললাম। তখন বলেছি, যদি আপনি মনে করেন তারা এই মুহূর্তে আমার চেয়ে ভালো খেলোয়াড়। তাহলে আমাকে জানাবেন, আমি আর আসবো না। অস্ট্রেলিয়া সফরে যেতে চেয়েছি কিন্তু আমাকে নেওয়া হয়নি।

ওসমান : গত বছরটা (২০২০) আপনার জন্য টি-টোয়েন্টিতে রেকর্ড ভাঙার ছিল। আপনি নিজের ব্যাটিংয়ে একরকমের নতুন মাত্রায় যোগ করলেন পাওয়ার হিটিং দিয়ে। এর আগে কখনোই এক পঞ্জিকাবর্ষে এত বেশি ছক্কা মারেননি...

তিন চার বছর ধরেই পাওয়ার হিটিংয়ের গুরুত্বটা বুঝতে পারছিলাম। এটার সঙ্গে আমাকে মানিয়ে নিতে হতো। আমার স্কিলেও উন্নতির দরকার ছিল। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর কাজ শুরু করেছিলাম, কঠিন ছিল ব্যাপারটা। নিজের খেলায় কখনো পরিবর্তন এনেছি কিন্তু এরপরও অনুশীলনে টেকনিককেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। যেগুলো সারাজীবন করেছি, সেগুলোই করে গেছি। কিন্তু বিশ্বকাপের পর সিপিএলে খেলতে গেলাম, অনেক ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়ের সঙ্গে ও তাদের বিপক্ষে। দেখলাম তারা অন্য যেকারো চেয়ে ভালো পাওয়ার হিটার।

এটার কারণ তারা অনেক বেশি অনুশীলন করে। প্রতিদিন অনুশীলনে টেকনিক্যাল দিকগুলো দেখে, এরপর ৫০-১০০টা বল ছক্কা মারে মাঠে। আমি ক্রিস গেইলকে এমন করতে দেখেছি, এভিন লুইসকেও। তারা যেহেতু নেটেই ছক্কা মারে তাই মাঠে গিয়ে কাজটা আর এতটা কঠিন থাকে না। এরপর আমিও মানসিকভাবে ওই ধরনের অনুশীলনের জন্য নিজেকে তৈরি করলাম। কাভার ড্রাইভ ও পুল শট যেভাবে রিস্টটাকে নিচে রেখে খেলি, আগে অনুশীলন করার কারণে। একই ব্যাপার পাওয়ার হিটিংয়ের ক্ষেত্রেও, বলটাকে পাওয়ারের সঙ্গে তুলে দেওয়া।

এরপর আমি ২০১৯ সালে গলফ খেলা শুরু করলাম। দেখলাম যে আমরা যেভাবে ব্যাটিং করি তার সঙ্গে অনেক মিল আছে। একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার দেলাম যখন আপনার দাঁড়ানোর ভিত্তিটা ছোট থাকবে, তখন ছোট শট খেলবেন। আমি বড় শট খেলতে পারিনি। এটার বা পাওয়ার হিটিংয়ের জন্য, আমার ভিত্তিটাকে বিস্তৃত করতে হয়েছে।

ওসমান : মানে বোঝাতে চাচ্ছেন পা দুটো প্রশস্ত রাখেন?

হ্যাঁ, অন্তত কাঁধ পর্যন্ত। গলফ খেলে চার থেকে পাঁচটি ব্যাপার শিখেছি। প্রথম, আপনাকে অবশ্যই শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে হবে বলটা জোরে মারতে। দুই, আপনার ব্যাট সুইং অবশ্যই বলের লাইনে থাকতে হবে। তিন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলটা ঠিকমতো দেখতে হবে। চার, শরীরের গতিপ্রকৃতি থাকতে হবে বলটা যেভাবে খেলবেন সেভাবে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর পাঁচ নম্বর হচ্ছে আপনার ফলো থ্রু।

যখন আমি নেটে যাই, অনুশীলনে এগুলো করার চেষ্টা করি। এতে আমার উপকার হয়েছে। দশটার মধ্যে অন্তত তিন চারটা শট আমি ৭০ মিটার মারতে পারি, বাকিগুলোও ৫০ মিটার যাবে। এরপর এটা আস্তে আস্তে বাড়ল। দশটার মধ্যে অন্তত ছয়-সাতটা ৭০-৭৫ বা ৮০ মিটার যায়। আমার মূল ব্যাপারটা বদলে গেল। 

আমি এখনও নিজের বেসিক টেকনিক নিয়ে কাজ করি কিন্তু ফোকাসটা বদলে গেছে। এখন আমি প্রতিবার অন্তত ৪০-৬০টা বল খেলি পাওয়ার হিটিংয়ের কাজের জন্য। বাকি যে বিষয়গুলো মেনে চলি- আমি মনে করি না ক্যারিয়ারের কখনোই টেকনিক্যালি পুরোপুরি ঠিকঠাক ছিলাম কিন্তু পাওয়ার হিটিংয়ে কাজ হয়েছে। এটা আমাকে স্ট্রাইক রেট ও বাউন্ডারির সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করেছে।

ওসমান : এটা কি আপনি নিজেই বুঝতে পারলেন?

হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি বুঝতে পেরেছি তিন-চার বছর আগে অন্য দলগুলোর ব্যাটসম্যানরা কীভাবে ব্যাট করতো এবং কেন তারা আমাদের চেয়ে ভালো ছিল। তারা ৩২৫-৩৫০ রান করতো আর আমরা ২৭০ এর আশেপাশেই আটকে থাকতাম। আমাদের আসলে পাওয়ার হিটার ছিল না। আমি এটার ব্যাপারে কয়েকবার আলোচনা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তারা জমিদারি ভাব ধরে ছিল। তাই নিজেই শুরু করি। এই ভাবনা ছিল যদি আমি এগিয়ে যেতে চাই, আজকের ক্রিকেটটা খেলতে চাই, নিজেকে আরও ভালো কেউ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই। তাহলে এটা আমাকে এমনভাবেই করতে হবে। 

তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলেছি ও তাদের বোঝাতে চেয়েছি এটার গুরুত্ব। তরুণদের বলেছি অনেক দেরিতে এসে আমি ব্যাপারগুলো বুঝেছি কিন্তু তারা যেন শুরুতেই বুঝতে পারে সেটা চাই। কারণ যদি তারা এখনই এসব করে, তাহলে সেটা অন্য যেকারো চেয়ে ভালো কাজে দেবে। 

আপনি যদি ১০-১২ বছর আগের ও আজকের খেলা দেখেন, যদি ব্যাপারগুলো ধরতে না পারেন, কখনোই সাদা বলে ভালো ক্রিকেটার হতে পারবেন না। কেউ কেউ আছে যারা ব্যাপারগুলো বুঝতে পেরেছে। রিজওয়ান তাদের একজন, তাকে ভালো করতে দেখে আমি খুব খুশি। সে নিজে থেকে আমার কাছে এসে এসব ব্যাপারে কথা বলেছে।

আমরা ওয়ান অন ওয়ান সেশনও করেছি। সে অনেক ইতিবাচকতা নিয়ে আমার কাছে এসেছে। ইফতেখার আহমেদ আরেকজন, সে আমার সঙ্গে খাইবার পাখতুনে খেলেছে। আরও কয়েকজন তরুণ ক্রিকেটার আছে। যেমন আব্দুল্লাহ শফিক, আমার মনে হয় সে অনেক প্রতিভাবান। ব্যাটিং সম্পর্কে আমার যতটুকু জানাশোনা আছে, বাবর আজমের পর সে আমাকে মুগ্ধ করেছে টেকনিক্যালি। আমার মনে হয় সে পাকিস্তানের তারকা হবে। হায়দার আলির সঙ্গেও কয়েকবার কথা হয়েছে।

ওসমান : আপনার কী মনে হয় আইপিএলে পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের খেলতে না পারাটা বড় ধরনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া?

আমার মনে হয় এটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে থাকা একটা সুযোগ কিন্তু সবকিছু না। আপনি যদি পুরো বিশ্বের যেকোনো জায়গায় লিগ ক্রিকেট খেলেন, তাহলেই ভালো প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় খেলছেন। সেটা সিপিএল হোক, বিপিএল বা বিগ ব্যাশ। হ্যাঁ, আইপিএল একটা প্ল্যাটফর্ম যেখানে সবাই আসে কিন্তু একমাত্র না।

আইপিএল না খেলেও পাকিস্তান এক নম্বর টি-টোয়েন্টি দল হয়েছে, যেটা অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। এর চেয়েও বড় ব্যাপার আমাদের বুঝতে হবে জাতি হিসেবে আমরা যে ধরনের প্রতিভা পাচ্ছি, তাদের সত্যিকারের প্রোডাক্ট হিসেবে তৈরি করতে হবে। যদি প্রোডাক্ট না বানাতে পারি, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লড়াই করতে পারবো না। বিশ্ব তাদের প্রোডাক্ট বানানো খেলোয়াড় পাঠায়, প্রতিভাবানদের না। প্রতিভা একটা ছোট্ট জায়গায় আবদ্ধ থাকে। আমরা শুধু প্রতিভা চাই। বিশ্ব কিন্তু প্রোডাক্ট বানাচ্ছে। 

জাতি হিসেবে আমরা যে ধরনের প্রতিভা পাচ্ছি, তাদের সত্যিকারের প্রোডাক্ট হিসেবে তৈরি করতে হবে। যদি প্রোডাক্ট না বানাতে পারি, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লড়াই করতে পারবো না। বিশ্ব তাদের প্রোডাক্ট বানানো খেলোয়াড় পাঠায়, প্রতিভাবানদের না। প্রতিভা একটা ছোট্ট জায়গায় আবদ্ধ থাকে। আমরা শুধু প্রতিভা চাই। বিশ্ব কিন্তু প্রোডাক্ট বানাচ্ছে। 

ওসমান : আপনার ক্যারিয়ারে আপনি পাকিস্তানকে নেতৃত্বও দিয়েছেন। ১৭ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন। আলাদা অনেক দায়িত্বে খেলেছেন। দলে আসা-যাওয়ার ভেতর ছিলেন। একটা খেলোয়াড় যখন আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে, হুট করে দায়িত্ব বদলে যায়, তার উন্নতিতে এসব কতটা প্রভাব ফেলে?

এই প্রশ্নের উত্তর একেকজন একেকভাবে দেবে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, যদি ভালো বোলার বা ব্যাটসম্যান হতে চান, এটা একটা অংশ। আপনাকে প্রোডাক্ট হিসেবে পুরোপুরি তৈরি করবে না। কঠোর পরিশ্রম একটা অংশ। সৎ হওয়া, এটা একটা অংশ। প্রাণবন্ত হওয়া, সেটাও। এসব বিষয়ে প্রতিভাবানদের নজর দিতে হবে। এগুলো আমরা স্বীকার করি না। আমরা বলি, এই ছেলেটা ভালো ছক্কা মেরেছে, সে অনেক প্রতিভাবান। এই ছেলেটা ভালো সুইং দিয়েছে, সে প্রতিভাবান, তাকে খেলাও।

আমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেও নিজেকে শিকার মনে হতো, নিজের ব্যর্থতার জন্য অন্যদের দায় দিতাম। আমি এটা অন্যদের কাছে শিখেছি, এখানে সবাই এভাবেই ভাবে। আমি রান করছি না, তো অন্য কাউকে দায় দিয়েছি। পারফরম করছি না, বলেছি কোচ ভালো না। পারফরম করছি না, তখন বলেছি অধিনায়ক ঠিকভাবে আমাকে ব্যবহার করছে না। ২০০৭ সালে বুঝতে পারলাম আর অনেক কৃতজ্ঞ সেটার জন্য- আমার ব্যর্থতা কেবল আমার জন্য অন্য কারো না। 

ওসমান : এটা কীভাবে বুঝতে পারলেন?

যখন আমি দলের বাইরে গেলাম, অনেকে ভাবল শেষ হয়ে গেছি। সবাই ভেবেছে, শেষ, একেবারেই শেষ হয়ে গেছি। যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়ে গেছে। তখন আমি নিজেকে বলেছি, তুমি ২০০৩ থেকে ০৭ সাল পর্যন্ত খেলেছো। আর দলে সুযোগ পাওয়ার মতো পারফরম্যান্স করতে পারোনি।

তিন বছর ধরে নিজেকে শারীরিক, মানসিক ও টেকনিক্যালি খুঁজে বেড়িয়েছি ও তৈরি করেছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যদি এখন ফিরে আসি, প্রোডাক্ট হিসেবে আসতে চাই। ‘প্রতিভা’ থেকে বেরিয়ে আমাকে ‘ম্যাচ উইনার’ হতে হবে। এরপর পাকিস্তানকে ম্যাচ জেতাতে শুরু করলাম। এই গল্পটা আমি তরুণদেরও বলি।

যখন ২০২০ সালে ড্রেসিং রুমে ফিরলাম। তখন দেখলাম একে অন্যকে বলছিল, ‘ইয়ো ইয়ো টেস্টে কত পেয়েছো?’, ‘তোমার বেঞ্চ প্রেস কত?’ অথবা ‘২ কিলোমিটার কতক্ষণে দৌড়েছো?’। আমি তাদের বললাম, যখন আমি পাকিস্তান দলে এসেছি, ইনজামাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। পাকিস্তানের হয়ে তিনি ১০ হাজার রান করেছেন। মোহাম্মদ ইউসুফ, যে অনেক সেঞ্চুরি করেছে আর পাকিস্তানকে ম্যাচ জিতিয়েছে। আমি শহীদ আফ্রিদিকে দেখেছি, যিনি তিন-চার ম্যাচ পরপরই ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়ার মতো পারফর্ম করেছেন।

শোয়েব আক্তার ছিলেন, যে পাঁচ উইকেট নিয়ে দেশকে ম্যাচ জিতিয়েছে। উমর গুলকে দেখেছি, পাঁচ উইকেট নিয়ে দেশকে ম্যাচ জিতিয়েছে। তারা কেউই ইয়ো ইয়ো টেস্ট দিয়ে জেতায়নি। হ্যাঁ, এটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কেবলই একটা অংশ।

যদি আপনি পাঁচ বছর ক্রিকেট খেলে একটা ম্যাচেও সেরা খেলোয়াড় হতে না পারেন আর বলেন আপনি ম্যাচ উইনার; আমার কাছে এটা জোকসের চেয়ে বেশি কিছু না। আমার ক্যারিয়ার বদলে গেছে যখন নিজের ব্যর্থতাকে মেনে নিয়েছি আর অন্যকে দোষ দেওয়া বন্ধ করেছি।
 
ওসমান : আপনার বয়স এখন ৪০ হয়ে গেছে। কোন জিনিসটা আপনাকে এখনও চালিয়ে যাওয়ার তাড়না দিচ্ছে?

সত্যি বললে, একটা ব্যাপার আমি এখনো পাইনি- যদিও অনেক কিছু জিতেছি কিন্তু বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য কখনো হতে পারিনি। ব্যক্তিগতভাবে এটা আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমি সবকিছু দিচ্ছি এটা সম্ভব করতে।

ওসমান : ঘরোয়া ক্রিকেটে আপনি অনেক বদল দেখেছেন। ডিপার্টমেন্ট এসেছে, চলেও গেছে। সর্বশেষ যেটা হলো, ডিপার্টমেন্ট বাদ, দল ও খেলোয়াড়ের সংখ্যাও কম। এ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

আমার মতামত পরিষ্কার ও স্বচ্ছ। খেলোয়াড় হিসেবে সুন্দর খেলাটির আরও বেশি ছড়িয়ে দেওয়া। আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাতে হবে, বঞ্চিত করা যাবে না। নতুন প্রজন্মকে স্বাগত জানাতে হবে কিন্তু আমরা যদি উল্টো তাদের সংখ্যাটা কমিয়ে দেই, তাহলে তারা এটা থেকে আরও দূরে সরে যাবে।

ওসমান : আপনার মনে হচ্ছে এই স্ট্রাকচার তাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে?

নিজেই ভেবে দেখুন। এই মুহূর্তে আপনি দেখছেন ১৯২ জন খেলোয়াড়, ছয়টা দল। কিন্তু পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি, আপনি তাদের মাত্র ছয়টা দল করতে পারেন না।

হয়তো কিছু দিক থেকে এটা সফল সিস্টেম। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা হলো পাকিস্তান গরীব দেশ, এটা মাথায় রাখলে আমাদের ক্রিকেটারদের আরও বেশি সুযোগ ও আর্থিক সাহায্য দরকার। গ্রাসরুট লেভেল থেকে যদি চিন্তা করেন, আপনাকে একটা রোড ম্যাপ বানাতে হবে ক্লাব ক্রিকেট থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত। কিন্তু আমি গত দুই বছরে ওরকম কোনো রোড ম্যাপ দেখিনি।

যদি আপনি ভালো কিছু এনে একটা সিস্টেম বদলান, তাহলে একটা বিকল্প আনলেন। অন্যথায় না। আমার এমন অনেক ক্রিকেটার বন্ধু আছে যারা দিন এনে দিনে খেতে পারে না, তাদের আয় এতটাই কম। তারা সুযোগটাও হারিয়ে ফেলেছে। তাদের অর্থনৈতিক দেখভাল কে করবে? পাকিস্তান কোনো কল্যাণকামী সমাজ না। কীভাবে একটা ছেলে ক্লাবে যাবে আর প্রায় এক লাখ টাকা দিয়ে ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম কিনবে?

আমাদের তাদের ব্যাপারেও ভাবতে হবে। আমরা শেষ সিস্টেমটা বদলেছি, ঠিক আছে, ভালো। কী ঘটবে সেটা আসলে পাঁচ বছর পর বোঝা যাবে। কিন্তু সেটাকে তো উপযুক্ত বিকল্প দিয়ে বদলাতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই নেই, সেটারও দুই বছর হয়ে গেল।

পারফরম করছি না, তখন বলেছি অধিনায়ক ঠিকভাবে আমাকে ব্যবহার করছে না। ২০০৭ সালে বুঝতে পারলাম আর অনেক কৃতজ্ঞ সেটার জন্য- আমার ব্যর্থতা কেবল আমার জন্য অন্য কারো না। 

ওসমান : পিসিবি হয়তো বলতে পারে যে ১৯২ জন খেলছে, তারা একদম সেরা খেলোয়াড়...

আমি ওই ভাবনা ও বদলটাকে সম্মান করি। আপনার ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু যদি এটা ভালো কিছু না দেয়, ইস্যুটা ঠিক না করে দেয়, এর দায় কার? কেউ কি দায়টা নেবে? আরেকটা বিষয় হলো, আপনাকে দেশে খেলাটাকে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। ছোট করে ফেললে তো হলো না।

ওসমান : আপনার কি মনে হয় না পিএসএল সেটা করছে? আরও বেশি মানুষ খেলাটা দেখছে, বাচ্চারাও যোগ দিচ্ছে..

এটা ভালো। কিন্তু পিএসএল মজার বিষয়, একটা উৎসব, সবাই এটা দেখে ও অংশ হতে চায়। কিন্তু এখানে যাওয়ার রোড ম্যাপটা কী? যারা পিএসএল খেলতে চায়, তারা কীভাবে এখানে আসবে?

ওসমান : ফ্র্যাঞ্চাইজির উন্মুক্ত ট্রায়ালে?

আমি যখন এই ধরনের ট্রায়ালে গিয়েছি, তখন দেখেছি হাজারো ছেলে চেষ্টা করছে। কেউ হয়তো সোজা ব্যাটে টেকনিক্যালি খেলেছে, তাকে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে। যে ছেলেটা জোরে মেরেছে, তাকে নির্বাচন করা হয়েছে। এটাই কি আমাদের করার ছিল? আপনার মনে হয় এটা পাকিস্তানের ক্রিকেটকে সামনে এগিয়ে নেবে? টেস্টে?

আমি এটা বলতে চাই না যে অমুক সঠিক, আরেকজন ভুল। শুধু এটা দেখাতে চাচ্ছি, পাকিস্তানের গ্রাসরুট, ক্লাব পর্যায়, জেলা বা গ্রেড দুই লেভেলের একটা রোডম্যাপ থাকতে হবে। ইতোমধ্যেই দুই বছর হয়ে গেছে কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারিনি।

ক্লাব লেভেলের ক্রিকেটাররা জানে না, তারা কীভাবে সেটার চেয়ে বড় কোনো জায়গায় যাবে। জেলা পর্যায়ের ক্রিকেটাররা জানে না তারা কীভাবে সেটার চেয়ে ভালো জায়গায় খেলবে। তাদের কার কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে বা কীভাবে, যে সে উন্নতি করেছে? ওই পাঁচটা-ছয়টা স্টেজ পার করে কেউ প্রথম শ্রেণি খেলেছে, এমন খেলোয়াড় কোথায়? যদি খুঁজে পান, আমাকে জানাবেন!

ওসমান : আপনি তাহলে মানছেন, পাকিস্তানের ক্রিকেটে পিএসএলের গভীর প্রভাব আছে?

অবশ্যই, এটার খুব ইতিবাচক প্রভাব আছে। ভক্ত-সমর্থকও দারুণ, এটা পাকিস্তানে খেলাটার চিত্র। এখানে যেভাবে খেলাটা খেলা হয়, দুর্দান্ত ব্যাপার। পাকিস্তানে পুরো মৌসুম হওয়াটা, খুব খুব স্পেশাল একটা জিনিস। এটার কৃতিত্ব সরকার ও পিসিবিকে দিতেই হবে।আমার মনে হয় পাকিস্তানের চেয়ে ভালো প্রোডাক্ট ক্রিকেটার সাম্প্রতিক অতীতে কেউ দিতে পারেনি। এসব পাকিস্তানের ক্রিকেটের জন্য ভালো চিত্র তুলে ধরে বিশ্বে।

ওসমান : পাকিস্তানের স্থানীয় ক্রিকেটারদের জন্য আন্তর্জাতিক তারকাদের সঙ্গে খেলার ও শেখারও তো দারুণ সুযোগ এটা...

হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি হয়তো দেখেন পাকিস্তানের অনেক বড় নাম পিএসএলে দেখা যায়। দুর্ভাগ্যবশত, আমি আপনাকে বলতে পারি, আরও অনেক ভালো খেলোয়াড় খেলতে পারে না। এমনকি দল যদি আটটাও হয়, অনেক ভালো খেলোয়াড় বাদ যাবে। আমার মনে হয় সময়ের সঙ্গে আরও বেশি দল হওয়া উচিত পিএসএলে।

পাকিস্তানে এখন একটাই খেলা আছে। পাকিস্তানের সব শিশু, সে যা কিছুই হোক না কেন-ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা আমলা; জীবনের একটা পর্যায়ে ক্রিকেট খেলেছে। আমাদের যত বেশি সম্ভব সুযোগ দিতে হবে তাদের, যারা খেলতে চায়। আমাদের এটা করতে হবে যেন আরও অনেকে এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়।

ওসমান : খুব বেশিদিন আগের কথা না, আপনার হাঁটুতে ইনজুরি ছিল। আপনি যেটার সমাধানের জন্য সাহায্য চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেবল আপনি একা না যে বোর্ডের মেডিকেল সাহায্য পায়নি। পাকিস্তান কি বিশ্বের অন্য দলগুলোর চেয়ে খেলোয়াড়দের যত্ম নেওয়ায় পিছিয়ে?

হ্যাঁ, আমি এটার সঙ্গে একমত। কয়েক বছর ধরে আমরা পিছিয়ে গেছি। আমাদের চিকিৎসা, ইনজুরি প্রতিরোধ ও পুনর্বাসন, আমরা পিছিয়ে গেছি। এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে ভাবতে হবে। একেবারে ঘরোয়া লিগ থেকে শুরু করতে হবে। যখন আপনি পিসিবির অধীনস্থ খেলোয়াড় হবেন, আমাদের রোড ম্যাপ বানাতে হবে কীভাবে খেলোয়াড়দের চিকিৎসার বিষয়গুলো দেখভাল করব। যদি এখানে কোনো ইস্যু থাকে, তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। 

আমি পুরো বিশ্ব ঘুরে দেখেছি। তার হাঁটুতে ব্যথা হয়েছে, জানার আগেই আবার ১৫০ গতিতে বল করতে নেমে গেছে যেন কিছুই হয়নি। কোনো অপরাশেন বা কিচ্ছু না। এখানে কিছুই হয়নি, অপারেশনও না। কিন্তু ছেলেটা এসে বল করবে ১২৫ গতিতে। আর ল্যাংড়াবে, আমাদের এসব বিষয়গুলো দেখতে হবে।

আমরা সবসময় শেষের ফলটাই দেখি। যেন আমরা পৃথিবীর এক নম্বর হতে সব করছি, কিন্তু কেন ওই বিষয়গুলো দেখছি না? আমাদের সিরিয়াসলি বিষয়গুলো দেখতে হবে যেখানে আমরা অনেক পিছিয়ে, এগুলো বের করতে হবে, প্রডাক্ট বানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে বুঝতে হবে।

এভাবেই আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারবো। স্কুলে একজন মোটামুটি ধরনের ছাত্র ছিলাম। আমি সেরা হতে চাইতাম কিন্তু জানতাম না কীভাবে হবো। আমি শুধু এটা হতেই চেয়েছি। কিন্তু দেখিনি কীভাবে সেরা ছাত্ররা ওই জায়গাটায় পৌঁছাতে পরিশ্রম করছে। তার শৃঙ্খলা ভালো ছিল, আমার চেয়ে ভালো পড়তো, এজন্য এক নম্বর হতো। ব্যাপারটা এমন, আমি সেরা দল হতে চাই কিন্তু সেটা হতে যে উপাদানগুলো দরকার, সেগুলো দেবো না।

ওসমান : আপনি যদি পাকিস্তান ক্রিকেটের কোনো কিছু বদলানোর সুযোগ পান, সেটা কী হবে?

আমার মনে হয় না আমি ওই স্টেজে আছি যেখান থেকে বড় কিছু বলা যায়। কিন্তু অনুমান করি, আমাদের আরও বেশি মানুষকে খেলতে উৎসাহিত করতে হবে, আরও বেশি সুযোগ দিতে হবে। ঘরোয়া পর্যায়ে, আমি অবশ্যই বেশি জায়গা তৈরি করব যেন তরুণরা পারফর্ম করার ও খেলার সুযোগ পায়। আমি প্রতিটা খেলোয়াড়ের সব স্টেজে সুযোগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই।

এমএইচ/এটি