ফুটবল বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা। সত্তর-আশির দশকের ফুটবলকে ঘিরে রয়েছে অনেক রুপকথার গল্পও ! কিন্তু সেই সময়ে ফুটবলের তুমুল জনপ্রিয়তা থাকলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য এসেছে নব্বইয়ের দশকে। ’৯৯ সাফ গেমস ফুটবলে স্বর্ণ জয় বাংলাদেশের ফুটবলে প্রথম বড় কোনো অর্জন। ফাইনালে তারকা ফুটবলার আলফাজ আহমেদের একমাত্র গোলেই এসেছিল সেই স্বর্ণ। বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে এসে আলফাজ আহমেদের কাছ থেকে ’৯৯ সাফ গেমস ও ফাইনালের গল্প শুনেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের

গোয়া সাফ ফুটবল খেলার কয়েক মাসের মধ্যেই নেপালের কাঠমান্ডুতে সাফ গেমস ছিল। সাফ গেমসে আমাদের যাত্রাটা শুভ হয়নি। প্রথম ম্যাচেই হেরেছিলাম। সেই হারের পর একজন কর্মকর্তা ফুটবলারদের উপর অযাচিত অভিযোগ এনেছিল। আমরাও বেশ অসন্তুষ্ট ছিলাম। দলে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ফুটবলার-কর্মকর্তা দ্বন্দ্ব নিরসন করতে ঢাকা থেকে উড়ে আসেন বাদল দা (প্রয়াত বাদল রায়)। বাদল দা স্থানীয় এক হোটেলে সবাইকে নিয়ে বাঙালি খাবারের আয়োজন করেন। এতে আমরা আশ্বস্ত ও উদ্বুদ্ধ হই। দলের পারফরম্যান্সেও ভালো হতে থাকে পরের ম্যাচগুলোতে।

দলের পারফরম্যান্স ভালো হলেও আমি ছিলাম চাপের মধ্যে। একে তো সহ-অধিনায়ক এর উপর নির্ভরযোগ্য স্ট্রাইকার হয়েও টুর্নামেন্টে আমার কোনো গোলই নেই। টিম ম্যানেজমেন্ট, মিডিয়ায় সব জায়গায় আমাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। একমাত্র ইরাকি কোচ সামির শাকির আমার উপর আস্থা রাখলেন। অন্য ম্যাচের মতো ফাইনালেও একাদশে রাখলেন। 

স্বাগতিক নেপালের বিরুদ্ধে ম্যাচ। নেপাল ফুটবল প্রিয় জাতি। অনেক দর্শক। এর মধ্যে আমি খানিকটা অফ ফর্মে। ম্যাচের প্রথম কয়েক মিনিট বাড়তি দৌড় ঝাঁপ করলাম। বল ধরে দুই-তিনটি আচমকা শট নিয়ে খানিকটা আত্নবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করলাম। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে আমরা কর্ণার পেয়েছিলাম। কর্ণার কিক বক্সের মধ্যে পড়ল। কয়েক পাক ঘুরে বল আমার পায়ে আসল। বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটু দেখে শুনে প্লেসিং করলাম। জটলার মধ্যে জায়গা খুব অল্প। গোলরক্ষক দূরে ছিল মাঝে ডিফেন্ডারদের ভিড়। এরপরও খুব সূক্ষ্মভাবে বল ঠেললাম। দুই জন ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে বল ধীরে ধীরে গোল লাইন অতিক্রম করছিল। মাত্র চার-পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই বল জালে প্রবেশ করে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন বলটি অনাদিকাল ধরে যাচ্ছেই গোললাইন অতিক্রম করছে না! গোললাইন ক্রস করার পরপরই সবাই যখন উল্লাস করছিল। আমি খানিকটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে একটু নির্ভার হলাম। কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে পেরে। 

ম্যাচের বাকি সময় আরো দুই একবার সুযোগ পেয়েছিলাম। শটও নিয়েছিলাম, গোল হয়নি অবশ্য। আরেকটি গোল করলে হয়তো আমরা আরো নির্ভার থাকতে পারতাম। নেপালিরা আমাদের উপর অনেক চাপ দিয়েছিল। ডিফেন্সে বিশেষত জুয়েল রানা ও গোলরক্ষক বিপ্লব দুর্দান্ত খেলেছিল। অপেক্ষায় ছিলাম কখন রেফারি বাঁশি বাজাবে। রেফারি বাঁশি বাজানোর পরপরই আমি কয়েক মিনিট নিশ্চুপ দাড়িয়ে ছিলাম। টুর্নামেন্টে গোলশূন্য থাকা আমার পা থেকেই যে স্বর্ণজয়ী গোলটি আসবে কে জানত। 

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ দল প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জেতে (মিয়ানমারে চার জাতির টুর্নামেন্ট)। ওই দলেও আমি ছিলাম; ’৯৯ সাফ গেমসের পর আরো দুইটি টুর্নামেন্টে (’০৩ সালে ঢাকায় সাফ ফুটবল ও ‘০২ সালে ভূটানের কিংস কাপ) জয়ী দলের সদস্য ছিলাম। চারটি’র মধ্যে অবশ্যই ’৯৯ সালের সাফ গেমসের শিরোপা আমার কাছে ভিন্ন স্বাদের। আমার গোলেই বাংলাদেশ গেমসে স্বর্ণ জিতেছে। ২১ বছর পার হলেও কাঠমান্ডুর সেই দিনের কথা এখনো মনে পড়ে। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও সেই স্মতি সজীব থাকবে। জাতীয় দলের জার্সিতে আমার হ্যাটট্রিক আছে, ক্লাবের হয়ে দেশে-বিদেশে অনেক গোল রয়েছে। এএফসি প্লেয়ার অফ দ্য মান্থও হয়েছি একবার। কিন্তু সাফ গেমসের ফাইনালের একটি গোলই আমার জীবনের সবচেয়ে দামী গোল। 

যে গোল দেশকে দিয়েছে একটি স্বর্ণ, ওই গোল যে স্বর্ণজয়ী গোল! সেই গোল আলফাজ আহমেদকে বাংলাদেশের ফুটবলের বিশেষ ইতিহাসে রেখেছে।  

এজেড/এটি/এনইউ