দিয়ার গল্পের শুরুটা নীলফামারীতে। আরচ্যারির ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রামের ট্রায়ালে দাঁড়িয়েছিলেন, কোনোকিছু না দেখেই বাদ দেওয়া হয়েছিল তাকে। এরপর জেদ ধরেছিলেন। সেই জেদ তাকে করেছে দেশের আরচ্যারির বড় তারকাদের একজন। তির-ধনুকের সঙ্গে সন্ধি করা মেয়ে শুনিয়েছেন নিজের জেদের গল্প।

বাবার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন কীভাবে আরচ্যারিতে বদলে গেল, খেলার আগে নিজেকে কীভাবে তৈরি করেন, ট্রেনিংয়ে না থাকলেই বা কী করেন দিয়া; বলেছেন সেসব। শুনিয়েছেন, নিজের প্রিয় তারকা, প্রিয় নায়ক ও প্রেমের প্রস্তাব পাওয়ার গল্পও। এই সাক্ষাৎকার দিয়া সিদ্দিকীকে চেনাবে নতুন করে। এশিয়ান পর্যায়ে সাফল্য এনে দেওয়া ও বিশ্বদরবারে পতাকা তুলে ধরা এই ক্রীড়াবিদের সঙ্গে কথা বলেছেন মাহমুদুল হাসান বাপ্পি...

প্রথমে শুরুর গল্পটা দিয়েই শুরু করি, আরচ্যারিতে কীভাবে আসলেন?

দিয়া : ওরকমভাবে তো আরচ্যারি চিনতাম না ওই সময়। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। নীলফামারীতে তখন ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম হয়। ওখানে আমি শুধু ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলাম। কিছু ক্রাইটেরিয়া দেখে তারা বাছাই করছিল। কিন্তু আমাকে একেবারে না দেখেই বাদ দিয়ে দিয়েছিল।

পরে আমি জেদ ধরলাম যে আমাকে তো দেখলেনই না, তাহলে বাদ দিলেন কেন? উনারা আমার কাছে জানতে চাইল, তোমার কী খেলার ইচ্ছে আছে? আমি বললাম, খেলার ইচ্ছে না থাকলে কি এখানে আসতাম নাকি!

সেখানেই শুরু, সময়টা ২০১৬ সালের শেষদিকের। এরপর ২০১৭ সালে ঢাকার টঙ্গী ক্যাম্পে আসি। আমার আব্বু চাচ্ছিল, আমি যেন বিকেএসপিতে (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) ভর্তি হয়ে খেলার সঙ্গে পড়াশোনাটাও করি। এই জন্য বিকেএসপিতে ট্রায়াল দেই। ওখানেও টিকে গিয়েছিলাম। এভাবেই আসলে আরচ্যারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া।

কিন্তু আপনার বাবা নাকি চাইতেন আপনি যেন ডাক্তার হন...

দিয়া : আব্বু সবসময়ই চাইতেন এটা। এখনও হয়তো চান। কিন্তু আমি খেলাধুলা বেশি পছন্দ করি, তাই হয়তো প্রকাশ করেন না। এমনিতে আমার এখন আর ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে নাই। আরচ্যারিটাই চালিয়ে যেতে চাই।

আরচ্যারির মতো এমন একটা অপরিচিত খেলায় যখন ট্রায়াল দিতে গেলেন- কোনো রকম দ্বিধা কাজ করেনি?

দিয়া : আমার আসলে যেকোনো ধরনের খেলার প্রতিই ঝোঁক ছিল। এজন্যই ট্রায়ালটা দিতে গিয়েছিলাম। নতুন খেলা দেখে একটু কৌতূহলও ছিল। চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম আসলে কেমন..., জানতাম না এভাবে প্যাশন হয়ে যাবে অথবা জড়িয়ে পড়ব।

শুধু দেখতে গিয়ে তো বাদ পড়লেন, এরপর জেদও ধরলেন..

দিয়া : হ্যাঁ, ধরেছি। খুব ভালো জেদই ধরেছিলাম। কারণ, আমার সাধারণত এটা পছন্দ না যে কোনোকিছুতে আমাকে না দেখেই বাদ করে দেবে। এটা একটু অন্যরকম না?

আমি চেষ্টা করে দেখি, যদি না পারি তখন না হয় বাদ দিয়ে দেবে। কিন্তু উনারা আমাকে না দেখেই বাদ দিয়ে দিয়েছিল। এটা আমার ইগোতে লেগেছিল স্বাভাবিকভাবেই।

আপনার কি ইগোটা একটু বেশি?

দিয়া : কিছু কিছু বিষয়ে, সবকিছুতে না। এটাকে আসলে ইগো না বলে আত্মসম্মানবোধ বলা বোধ হয় ভালো। সব জায়গাতে না, যেখানে দরকার আর কী।

ওই জেদটার কারণে এখন আপনি এত বড় তারকা। নিজের প্রতিই তো কৃতজ্ঞতা বোধ কাজ করার কথা...

দিয়া : আল্লাহর কাছে সবসময় শুকরিয়া আদায় করি। আমি অত বড় তারকা না, আপনি যেমন বললেন। যতটুকু হতে পেরেছি, দোয়া করবেন যেন আরও ভালো কিছু অর্জন করতে পারি।

তবে হ্যাঁ, এটা সত্যি। পেছন ফিরে তাকালে একটু ভালো তো লাগেই। মনে হয় ধৈর্য ধরাটা খারাপ না। ভালো ও খারাপ দুই সময়কেই এমনভাবে নিতে হয়, যেন সেটা স্বাভাবিক থাকে।

ট্রায়ালে যখন টিকে গেলেন, তখন কি আবার উল্টো হয়ে গেল..., মানে বাবার সমর্থনটাই বেশি পেলেন?

দিয়া : হ্যাঁ, বাবার সমর্থনই সবচেয়ে বেশি ছিল। আমারও অনেক ইচ্ছে ছিল। আম্মু তেমন রাজি ছিলেন না। কারণ, উনি আমাকে ছেড়ে থাকেননি কখনো। তাই আমাকে দূরে দিতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো চলেই আসলাম।

নিজের নামটা প্রথম কবে পত্রিকায় দেখলেন, সেটা কি মনে পড়ে?

দিয়া : আমি মনে হয় কখনো নিজের নাম পত্রিকাতে দেখিনি, টিভিতেও না। সবাই বলে। কিন্তু কখন কোন পত্রিকায় আসল, সেটা আমি দেখতে পাই না। শেষবার যখন বিকেএসপিতে গিয়েছিলাম, তখন একটা ছবি কালেক্ট করেছি প্রথম আলো পত্রিকা থেকে। এছাড়া আর কখনো কোনো ছবি পাইনি। সবাই বলে তোমার ছবি এসেছিল, কিন্তু আমি পাই না।

কখনো ইচ্ছেও জাগে না নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে, নাকি এমনিতেই পান না?

দিয়া : না, না। ইচ্ছে তো জাগেই। কিন্তু যখন ক্যাম্পে থাকি তখন পত্রিকা নেওয়া হয় না, পড়তেও পারি না। ছবিও দেখা হয় না। বাসায় আব্বু নেয়, উনিই হয়তো গুছিয়ে রাখে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে হয়তো আমাকে দেয় না।

ঠিক আছে, পরের বার দেখা হলে আমিই নিয়ে আসবো...

দিয়া : কেউ এভাবে গিফট করলে তো মন্দ হয় না। নিয়ে আসবেন তাহলে....(হাসি)

এবার একটু খেলাতে আসি, আরচ্যারি তো ভীষণ মনোসংযোগের খেলা। এরপরও আপনার কোন জিনিসটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?

দিয়া : দেখেন, আরচ্যারি এমন একটা জিনিস, যদি আমি ‘আর’ বলি তাহলে আমাকে ‘চ্যারিটা’ বলতেই হবে। একবার দাঁড়িয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত মনোযোগটা ধরে রাখার কোনো বিকল্প নেই। কোনোভাবেই মাঝখানে সেটা হারানো যাবে না। কোনো সুযোগই নেই আসলে।

কারণ, মনোযোগ সরে গেলেই সমস্যা হয়ে যাবে। তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটা ধরে রাখতে হবে। যদি আমার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খেলা থাকে, ভালো কিছু করতে চাইলে তাহলে আমার ততক্ষণই মনোসংযোগ ধরে রাখতে হবে।

ভালো কিছু বলতে, আপনার নিজের লক্ষ্যটা আসলে কী? অলিম্পিকে মেডেল?

দিয়া : প্রতিটা অ্যাথলেটেরই তো আসলে স্বপ্ন থাকে অলিম্পিকে মেডেল জেতা। কিন্তু আমি একটু অন্যভাবে ভাবি। ধরেন, সামনে আমার একটা গেম আছে, আগে ওটাতে ভালো করা। এরপর ধাপে ধাপে পরের পর্বে যাওয়া। আমার লক্ষ্য এমনই থাকে আসলে।

স্বপ্নের কথা বাদ। বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কি আপনার সত্যিই মনে হয় অলিম্পিকে মেডেল জিততে পারবেন?

দিয়া : ব্যাপারটা আসলে এরকম না। বাংলাদেশ খেলাধুলায় এত বেশি উন্নত না। কিন্তু আরচ্যারি বা অন্য ডিসিপ্লিনগুলোতে যেভাবে উন্নতি হচ্ছে, যদি আরচ্যারিতে নাও হয় অথবা ২০২৪ সালে...; ২০২৮ অলিম্পিকে মেডেল জিততে পারব বলেই আমার বিশ্বাস। লক্ষ্যটা আসলে উপরে রাখা ভালো, ইন-শা-আল্লাহ একদিন হবে।

আপনার প্রতিদিনের রুটিনটা কেমন?

দিয়া : ডেইলি রুটিনটা যদি বলি, সকালেই ঘুম থেকে উঠা হয়। সাতটার সময় উঠি। নাস্তা করে এরপর মাঠে যাই। নয়টা বা সাড়ে নয়টার দিকে একটা বিরতি থাকে, যখন ক্যাম্পে থাকি রুটিনটা এমন। এরপর সাড়ে এগারোটার দিকে মাঠ থেকে ফিরি। আবার ফ্রেশ হই, খেতে যাই।

এরপর একটু রেস্ট নিয়ে তিনটার দিকে আবার প্র্যাক্টিস। তারপর হালকা জিম বা রানিং থাকে। ছয়টার দিকে রুমে ফিরে আসি। এরপর রুমে গিয়ে ফোনে কিছু করি অথবা হালকা কাজ থাকলে সেগুলো করি। ক্যাম্পে থাকলে আসলে খেলা নিয়েই থাকা হয়, আর অল্পস্বল্প পড়াশোনা।

বিকেএসপিতে থাকলেও সকালে উঠি। তিনদিন মাঠ থাকে আমাদের। এরপর সেখান থেকে কলেজে যাই, কলেজ থেকে ফিরে ডাইনিং। বিকেলে অনুশীলন থাকে। সেখান থেকে ফিরে আবার ক্লাসমেটদের সঙ্গে আড্ডা। স্যারদের যদি কোনো পড়া থাকে, সেটাও শেষ করা হয়। এরকমই আর কী।

ডায়েটও তো কন্ট্রোল করতে হয়?

দিয়া : আমি ডায়েট কন্ট্রোল করি না তেমন। যখন মনে হয় ওজন বাড়ানো দরকার, তখন বাড়াই। আমি খুব বেশি খাই না। যতটুকু দরকার ততটুকু খাই। অতিরিক্ত কিছু খাই না। কিন্তু যখন মনে হয় আমার একটু ওজন বাড়ানো দরকার, আমার ইনজুরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তখন ওজন বাড়াই। যেমন এবার বাড়ালাম।

টুর্নামেন্টের আগে আপনার প্রস্তুতিটা কেমন থাকে?

দিয়া : টুর্নামেন্টের আগে আমরা ক্যাম্পে থাকি। সেখানেই প্রশিক্ষণ চলে, ওভাবেই প্রস্তুতি নেই। নিজেকে তৈরি করি ভালো কিছু করার জন্য। সেরাটা যেন দিতে পারি। নিজেকে গেমের মধ্যে যাচাই করি কতটুকু সক্ষমতা আছে, মূল টুর্নামেন্টে ভালো করার। যদি কিছু ভুল দেখি, তাহলে সেটা শুধরানোর চেষ্টাও করি।

খেলার বাইরের সময়টা কীভাবে কাটান?

দিয়া : খেলার বাইরে গত বছর তো সারাক্ষণই ক্যাম্পে থাকলাম। এর বাইরে মাঝেমধ্যে গল্পের বই পড়ি, ভিডিও দেখি। বিকেএসপিতে গেলে পড়াশোনা নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকি। সাজেশন কালেক্ট করতে হয় তখন। আর প্রাইভেট থাকলে তো সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। আর হয়তো আব্বু-আম্মুর সঙ্গে কথা বলি।

রান্না জানেন না?

দিয়া : হ্যাঁ, রান্না করি মাঝেমধ্যে। যদিও এটা ক্যাম্পে নিষেধ। তাও আমি লুকিয়ে লুকিয়ে রান্না করি। রান্না জানি বলতে খুব বেশি কিছু জানি না, অল্প একটু-আধটু জানি।

নিজের প্রিয় খাবারটা রান্না করতে জানেন?

দিয়া : আমার প্রিয় খাবার বিরিয়ানি। কিন্তু আমি ওটা রান্না করতে পারি না। বাইরে থেকে কিনে আনি। কাচ্চির আলুটা আমার খুব পছন্দের।

আরচ্যারির বাইরে আপনার পছন্দের খেলা কোনটা?

দিয়া : আপাতত আমাদের এখানে রিক্রিয়েশন হিসেবে টেবিল টেনিস খেলাটা দিয়েছে। বসে বা দাঁড়িয়ে খেলা যায় যেগুলো, সেগুলো ভালো লাগে। আগে দাবা খুব পছন্দ করতাম, এখন তেমন করি না। ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস— এসব একটু বেশি ভালো লাগে। এছাড়া গোল্লাছুট ধরনের খেলা ভালো লাগে।

ক্রিকেট-ফুটবল দেখেন না?

দিয়া : যখন খেলা থাকে, তখন দেখি। যদিও ব্যক্তিগতভাবে ক্রিকেট আমি তেমন পছন্দ করি না। তবে শেষ একটা ম্যাচ দেখেছি, আমার খুবই ভালো লেগেছে।

কোনোদিন যদি একজন তারকার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান, কার সঙ্গে দেখা করতে চান?

দিয়া : আমার খুব ইচ্ছে আর্জেন্টিনা গিয়ে মেসির সঙ্গে দেখা করার। আমি আর্জেন্টিনার ফ্যান, লিওনেল মেসির সবচেয়ে বড় ভক্ত। হয়তো দেখিয়ে দেখিয়ে ভক্ত না। কিন্তু আমার মেসিকে খুব ভালো লাগে। ছোটবেলায় দাদুর বাসা থেকে শুনে এসেছি, ‘মেসি’, ‘মেসি’, ‘মেসি’। তখন থেকেই তার ভক্ত। আর্জেন্টিনার খেলা আমি মিস দেই না যখনই হোক। আমার গলা ভেঙে যায় চিৎকার করতে করতে। একদম ছোটবেলার প্রেম মেসি।

প্রেমের কথা যখন বললেন, তখন জিজ্ঞেস করেই ফেলি। প্রথম প্রেমের প্রস্তাবটা কবে পেলেন?

দিয়া : এসব এত বেশি মনে রাখি না। কারণ, এগুলোকে এখন খুব বেশি পাত্তা দেই না। এজন্য ডেট ফিক্সড করে মনে রাখাটা আমি পছন্দ করি না।

আপনার কিন্তু অনেক ছেলে ভক্ত আছে। তারা জানতে চায়, আপনি কতগুলো প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছেন?

দিয়া : স্বাভাবিকভাবেই দেখবেন একটা মেয়ে মানুষ কতগুলো প্রস্তাব পায়। যদি সে সেলিব্রেটি নাও হয়, কত প্রেমের অফার পায়। আমি শিওর জানি না কতগুলো পেয়েছি, গুনি নাই কখনো। এখন অনেকে আছে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলে। কেউ আছে ছেঁচড়ামি বা ফ্লার্টিং করে, এগুলো তো ধরা যায় না।

এগুলো ধরলে কি সেঞ্চুরি হবে?

দিয়া : হতে পারে (হাসি)।

আপনাকে সবসময় রোমান সানার আশেপাশে দেখা যায়। কারণটা কী?

দিয়া : উনি একজন অনুপ্রেরণা। উনার কাছ থেকেই আসলে আমরা সবসময় অনুপ্রাণিত হই। উনি ভালো করছেন, উনাকে দেখেই আমাদের নতুন প্রজন্মের ভালো করার ইচ্ছে জাগে। উনাকে দেখে ভাবতাম, কীভাবে এত ভালো করেন। কোচ সবসময় উনাকে দেখাতেন। শুধু যে উনার রেজাল্ট ভালো এমন না, শ্যুটিংও অনেক ভালো, মানুষ হিসেবেও উনি দারুণ।

শেষ করে দেই, সিনেমা তো দেখেন, প্রিয় নায়ক কে?

দিয়া : ঋত্বিক রোশন (হাসি)।

এমএইচ