দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়। পাথরের রাজ্য নামেও এ জেলা বেশ পরিচিত। এ জেলার  সদর ও তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সমতল ভূমি ও নদীতে প্রচুর পরিমাণে নুড়ি পাথর পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে বেশি পাথর পাওয়া যায় তেঁতুলিয়া উপজেলায়।

পাথরের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতেন প্রায় কয়েক হাজার শ্রমিক। শুধু শ্রমিকরাই নন, এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষই পাথরকে ঘিরে নির্ভরশীল। কেউ শ্রমিক, কেউবা ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন আর চোখে পড়ে না সেই চিত্র। এক বছর ধরে এ এলাকায় পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক।

বিকল্প কর্মসংস্থানে অনেকে নিজেকে নিযুক্ত করলেও কেউ কেউ আবার কাজ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। পাথর শ্রমিকরা জানান, উত্তোলনকাজ বন্ধ থাকায় তাদের কাজও বন্ধ। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। শ্রমিকরা একপ্রকার অলস সময় পার করছেন। তাদের চোখে-মুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। বিষণ্ন চেহারা ভাবছেন, কীভাবে চলবে তাদের সংসার?

জানা যায়, দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এ এলাকার মানুষের প্রধান পেশা পাথর উত্তোলন। এর সঙ্গে জড়িত উপজেলার হাজার হাজার নারী-পুরুষ। তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল রাতের আঁধারে অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে গভীরে মাটি খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করছিল। পরে স্থানীয় প্রশাসন ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধের পাশাপাশি সমতল ভূমিতেও পাথর উত্তোলন বন্ধ করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আর এভাবে বেকার হয়ে পড়েন হাজার পাথর শ্রমিক ও ব্যবসায়ী।

এদিকে পাথর উত্তোলনের দাবিতে চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর বাজারে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করলে এতে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংর্ঘষ বাধে। এ সময় এক শ্রমিক নিহতসহ অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হন। এতে পুলিশের কয়েকজন সদস্যও আহত হন। পরে পুলিশ বাদী হয়ে ৭৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং চার-পাঁচ হাজার জনকে অজ্ঞাত উল্লেখ করে দুটি মামলা করে। তারপর থেকে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা একপ্রকার ভয়ের মধ্যে দিন পার করছেন।

তবে জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হলেও এতে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলা খুব কঠিন বলে জানায় তারা। তবে তাদের অভিযোগ, অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে রাতের আঁধারে যারা পাথর উত্তোলন করেন, তারা রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন এবং তারাই রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

জীবিকার তাগিদে কিছু শ্রমিক নদীতে ভেসে আসা নুড়ি পাথর কুড়ালেও সেখানেও রয়েছে প্রশাসনের বাধা। ফলে লুকিয়ে শ্রমিকরা জীবন বাঁচার তাগিদে পাথর কুড়িয়ে দুই বেলা ভাতের জোগাড়ের চেষ্টা করছেন।

সরিজমিনে দেখা যায়, জীবিকার তাগিদে কিছু সাধারণ শ্রমিক করতোয়া নদীতে ভেসে আসা নুড়ি পাথর কুঁড়ালেও সেখানেও রয়েছে প্রশাসনের বাধা। ফলে লুকোচুরি করে শ্রমিকরা জীবন বাঁচানোর তাগিদে কিছু পাথর কুড়িয়ে দুই বেলা ভাতের জোগাড়ের চেষ্টা করছেন। আবার কালেভদ্রে কয়েকটা গ্যারেজে পাথর ভাঙার দৃশ্য দেখা যায়। এভাবে হঠাৎ দু-একটা পাথরের গ্যারেজে ক্রাসার মেশিন ঘুরলেও, ঘুরছে না শ্রমিকদের জীবনের চাকা। সেগুলোতে এক দিন কাজ করলে দুদিন বসে থাকতে হয়।

একসময় তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন সড়কের পাশে চোখে পড়ত পাথর আর পাথর। সেখানটা আজ যেন রূপ নিয়েছে মরুভূমিতে। নেই কাজের কোনো তোড়জোড়, কোলাহল। পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শুধু পাথরশ্রমিক ও ব্যবসায়ীরাই ক্ষতির মধ্যে পড়েননি, এর প্রভাব পড়েছে এই এলাকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও।

এ বিষয়ে পঞ্চগড় জেলার সচেতন মহল মনে করে, এ এলাকায় মানুষের পাথর ছাড়া বিকল্প কর্মসংস্থান তেমন নেই। ফলে জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে পরিবেশবান্ধব সনাতন পদ্ধতিতে যদি পাথর উত্তোলন চালু করা যায় বা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়, তাহলে যেসব নারী-পুরুষ শ্রমিক বেকার আছেন, তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

পাথরশ্রমিকরা জানান, হঠাৎ পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়ায় আমরা পাথরশ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছি। আগে সারা দিন কাজ করে আমরা যেখানে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি পেতাম এখন পাথর বন্ধ হয়ে যাওয়া বেশির ভাগ সময় বেকার সময় পার করছি। মাঝেমধ্যে কাজ করতে পারলেও মজুরি পাই ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এতে সংসার কীভাবে চলবে? তারা আরও জানান, সংসার ও কিস্তির টাকা জোগাড় করার জন্য লুকিয়ে নদী থেকে পাথর কুড়াতে গেলেও এতে তাদের তেমন লাভ হয় না। সরকরের কাছে আমাদের অনুরোধ, সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের জন্য যদি সুযোগ করে দেয়, তাহলে আমরা আবারো ভালো করে পরিবার-পরিজন নিয়ে দিন কাটাতে পারব৷

এ বিষয়ে পাথর ব্যবসায়ীরা বলেন, হঠাৎ পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে লোকসানে পড়ে চরম কষ্টে দিন পার করছি। সরকারের কাছে অনুরোধ, যদি সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা ব্যবসায়ীরা অনেক উপকৃত হব। এতে শ্রমিকদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।

কথা হয় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর বাজারের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী আবু সালেহ মিলনের সঙ্গে। তিনি জানান, ভজনপুর এলাকায় আগে অনেক পাথর উত্তোলন হতো। বিভিন্ন এলাকার মানুষ এসে পাথরের কাজ করত। এতে আমাদের বেচাবিক্রিও ভালো চলত। কিন্তু পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষের আয় কমে গেছে, আমাদের দোকানের বিক্রিও কমে গেছে। অনেক শ্রমিকের কাছে অনেক টাকা পাব, কিন্তু কাজ না থাকায় তারাও টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। আমরাও বিপদে আছি।

পঞ্চগড় পাথর বালি ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু সালেক জানান, পঞ্চগড়ের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এলাকার পাথর বালুর অবদান অপরিসীম। অনেক আগে থেকে পঞ্চগড় জেলা অর্থনৈতিক অবস্থানে পাথর ও বালু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পাথর-বালুর ব্যবসা করে অনেকে তাদের ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন এবং জীবিকা নির্বাহ করছেন। ইদানীং অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের কারণে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। হাজার হাজার ব্যবসায়ী ও শ্রমিক এতে বেকার হয়ে পড়েছেন।

এখন কিছু মানুষ বিভিন্ন এলাকায় পাথর তুলছেন সনাতন পদ্ধতিতে। কিন্তু সরকার এতে কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। সরকার যদি সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের বন্দোবস্ত করে দেয়, তাহলে এ এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে।

আবু সালেক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পাথর বালি ফেডারেশন

তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান ডাবলু জানান, তেঁতুলিয়া উপজেলায় পাথর উত্তোলনের সঙ্গে বহু মানুষ কর্মসংস্থানে জড়িত ছিল। কিন্তু কিছু কুচক্রী মহল অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা বন্ধ করা হয়েছে। ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করব, সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করে কয়েক হাজার শ্রমিককে আবারও কাজের সংস্থান করে দেওয়া হোক।

পঞ্চগড় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, উত্তরের জেলা পঞ্চগড় হিমালয়কন্যা নামে পরিচিত। এ জেলার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে দুটি বিষয় প্রাধান্য পায়। একটি হলো সমতল ভূমিতে চা চাষ, আরেকটি পাথর উত্তোলন। পঞ্চগড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ নদীতে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করে। তিনি আরও জানান, পঞ্চগড়ে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ। আমরাও ড্রেজার মেশিন বন্ধের পক্ষে। কিন্তু যেসব মানুষ ও শ্রমিক নদীতে পাথর উত্তোলন করে জীবিকা করেন, তারা যেন স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, সে জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করছি।

এ ব্যাপারে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, তেঁতুলিয়ায় সমতল ভূমি থেকে পাথর উত্তোলন প্রশাসন থেকে বন্ধ করা হয়েছে। কারণ, এতে জমির শ্রেণি পরিবর্তন ও ভূমি ধ্বংস হয়। এতে কর্মসংস্থান বা কর্মক্ষেত্র লোপ পায়নি৷ তেঁতুলিয়ায় শ্রমিকদের কাজ করার বিভিন্ন উৎস রয়েছে। যেমন চা-শিল্প রয়েছে। এখানকার কৃষিজমিগুলো তিন বা চার ফসলি। এখানে বন্দর রয়েছে। সেখানেও শ্রমিকদের কাজ করার সুযোগ আছে।

আমরা সরেজমিনে পরিদর্শন করলাম। ব্যবসায়ী, প্রশাসন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা সবার মতামত ও যা দেখেছি, তা সরকারের কাছে উপস্থাপন করব। পাথর উত্তোলনের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে নেবে। তবে পরিবেশ রক্ষায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই।

শেখ রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব

সচিব বলেন, তা ছাড়া সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করা যায় কি না, সে বিষয়ে আলোচনার পরিপেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে মতবিনিময় সভায় উঠে আসে।

জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসম জানান, পাথর উত্তোলন ড্রেজার মেশিন দিয়ে তোলা যাবে না, এটাই বন্ধে সবাই একমত এবং যারা পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত, তারাও স্বীকার করেছন। তবে প্রস্তাব এসেছে, সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করা যাবে, তার নিশ্চয়তা কে দেবে যে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করবে না? প্রশাসনের দায়িত্ব থাকলেও প্রশাসনের নজরদারির কথা বলেছেন ব্যবসায়ীরা।

উল্লেখ্য, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় পাথর কোয়ারি বিষয়ে জেলা প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট দপ্তরপ্রধান ও অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শেখ রফিকুল ইসলাম। গত ৭ জানুয়ারি তেঁতুলিয়া উপজেলার ডাকবাংলো পিকনিক কর্নারের বেরং কমপ্লেক্সে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে তিনি জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর, মূর্খাগছ, কালিতলা, নিজবাড়ি, করতোয়া ও ডাহুক নদীসহ বিভিন্ন এলাকায় পতিত পাথর উত্তোলনের সাইট পরিদর্শন করেন।

এনএ