সরকারি প্রণোদনা দিতে খামারিদের কাছ থেকে টাকা আদায়
এক খামারির কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের টেকনিশিয়ান বিপ্লব কুমার
দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন খাদিজা বেগম। ভ্যানচালক স্বামী মনিরুজ্জামান লকডাউনে আটকে পড়েছিলেন বাড়িতে। ঘুরছিল না ভ্যানের চাকা, চলছিল না সংসার। সেই সঙ্গে বাড়িতে থাকা দুটি গাভি নিয়ে পড়েছিলেন বিপাকে। সরকার করোনাকালে খামারিদের সহায়তার জন্য তালিকা প্রস্তুত করে। আশ্বাস দেয় অনুদানের। সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন খাদিজা বেগম। তবে তিনি সরকারি কোনো অনুদান এখনও পাননি। উল্টো প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে দুই হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে।
খাদিজা বেগম সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের ভ্যানচালক মনিরুজ্জামানের স্ত্রী। তার ছেলে খায়রুল আলম সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগে স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র।
বিজ্ঞাপন
খাদিজা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের অভাবের সংসার। স্বামী ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। করোনায় লকডাউনের সময় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। নিজেদেরই সংসার চলে না আবার দুটি গাভিকেও খাবার দিতে পারছিলাম না। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দুটি গরুর তালিকা করা হয়। বলা হয়েছিল, সরকারি অনুদান দেবে। আমাকে তিন মাস আগে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে ডাকা হয়। সেখানে গেলে জানানো হয়, তালিকায় আমার নাম এসেছে। আমি ১০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান পাবো। এই টাকা নিতে গেলে ২ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে।
অফিসের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ‘এই ২ হাজার ৫০০ টাকা আমরা খাবো। আপনি ১০ হাজার টাকা পাবেন এই টাকার বিনিময়ে।’ তখন আমি বলেছিলাম, টাকা দিচ্ছি, তবে আমি খুব অভাবগ্রস্ত মানুষ। টাকাটা যেন আমি পাই। না পেলে আমার টাকা ফেরত দিতে হবে। তবে সেই টাকা আমি এখনও পাইনি।
বিজ্ঞাপন
এদিকে কালিগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের টেকনিশিয়ান বিপ্লব কুমারের খামারিদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, বিপ্লব কুমার এক খামারিকে বলছেন, আপনি অনুদানের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। সেটিতে আপনি সিলেক্ট হয়েছেন। ১০ হাজার টাকা পাবেন। এখন এই টাকা নিতে গেলে, আমাদের পরিবারের ভেতর থাকতে গেলে আপনাকে ২ হাজার ৫০০ টাকা খরচ করে এই টাকা নিতে হবে। এরপর তিনি টাকাটি গ্রহণও করেন।
খাদিজা বেগমের ছেলে কলেজছাত্র খায়রুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০ হাজার টাকা আমরা এখনও পাইনি। তবে এখন বাড়িতে এসে হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মনোজিত কুমার মন্ডল, টেকনিশিয়ান বিপ্লব কুমার, ডা. জাকির হোসেনসহ পাঁচজন বাড়িতে এসে ভয়ভীতি দেখিয়ে বলেছেন, ‘মামলা করবো। টাকা নেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছো কেন?’ অথচ টাকা নেওয়ার ভিডিও আমি ছাড়িনি অন্য কেউ ছেড়েছে। এখন বাড়িতে এসে বলছেন, রেজিস্ট্রেশনের জন্য টাকা নিয়েছিলেন। মিথ্যা কথা বলছেন তারা।
টাকা উত্তোলনের বিষয়ে প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের টেকনিশিয়ান বিপ্লব কুমার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২ হাজার ৫০০ টাকা নিয়েছি। ২ হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশনের জন্য আর ৩০০ টাকা ভ্যাট। এছাড়া ২০০ টাকা খরচ বাবদ বেশি নেওয়া হয়েছে। কতজনের কাছ থেকে নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকলের কাছ থেকেই এই টাকা নেওয়া হয়েছে।
কালিগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মনোজিত কুমার মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, কালিগঞ্জ উপজেলায় দুই হাজার হাঁস-মুরগি ও গরুর খামারির তালিকা করা হয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই করোনাকালীন প্রণোদনা হিসেবে অনুদান পাচ্ছেন। ১০ হাজার টাকা থেকে ২৪ হাজার টাকা অনেকে পেয়েছেন বলে আমি শুনেছি। যেহেতু টাকাটি তাদের বিকাশ অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে, এ কারণে সবগুলো বলা সম্ভব নয়। অনুদানের টাকা পাওয়া কেবল শুরু হয়েছে।
২ হাজার ৫০০ টাকা করে উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, টাকাটি ঘুষ নয়, খামারিদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য নেওয়া হয়েছে। ২০০০ হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশনের জন্য আর ৩০০ টাকা ভ্যাট। এছাড়াও ২০০ টাকা খরচ বাবদ বেশি নেওয়া হয়েছিল।
তবে কালিগঞ্জ উপজেলায় দুই হাজার মানুষের কাছ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে মোট ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, করোনাকালে জেলায় মুরগি ও দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিদের তালিকা করা হয়। এ, বি ও সি ক্যাটাগরি করে ৯ হাজার ৮৭৯ জন খামারির তালিকা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। খামারিদের দেওয়া বিকাশ অ্যাকাউন্টে এই সহায়তার টাকা এখন পাঠানো হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা দুধ উৎপাদনকারী খামারি রয়েছেন তাদেরকে করোনাকালীন সরকারি অনুদান দেওয়া হচ্ছে। তিনটি ক্যাটাগরি করে খামারিদের তালিকা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই শেষে এখন অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। আমার জানা মতে সর্বনিম্ন ১০ হাজার ও সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত এই সরকারি অনুদানের টাকা সহায়তা পেয়েছেন অনেক খামারি। সেটি এখনও চলমান রয়েছে। এই টাকা পেতে আমাদের দপ্তরের কোনো ফি নির্ধারণ করা হয়নি। ফ্রিতেই এই টাকা খামারিরা পাচ্ছেন।
কালিগঞ্জ উপজেলায় ২ হাজার ৫০০ টাকা করে উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি শুনেছি বা এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে। এরপর খাদিজা বেগমের বাড়িতে আমি গিয়েছিলাম তবে তিনি কোনো অভিযোগ দেননি বরং আমাদের আপ্যায়ন করেছেন। টাকাটি যদি রেজিস্ট্রেশন কাজে ব্যয় হয় তবে ঠিক আছে। যদি না হয় তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আকরামুল ইসলাম/আরএআর