বিগত তিন বছর ধরে আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না রংপুর খাদ্য বিভাগ। কোনো কোনো মৌসুমে চাল সংগ্রহ হলেও লক্ষ্যমাত্রার ৫ ভাগ ধানও সংগ্রহ করতে পারেনি জেলার খাদ্য গুদামগুলো। সেই রেশ এখনও কাটেনি। এবারও ব্যর্থতার সেই একই ধাক্কা। জেলায় ধান সংগ্রহে সফলতা শূন্যের কোটায় হলেও চালে পূর্ণ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রা।

ধান-চাল সংগ্রহের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি সংগ্রহ মূল্যের তুলনায় বাজারদর বেশি হওয়ায় কৃষকেরা সরকারের কাছে ধান বিক্রিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

রংপুরের চলতি আমন মৌসুমে খাদ্য অধিদপ্তরের ধান সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সোমবার (৩০ জানুয়ারি) পর্যন্ত সংগ্রহ শুরুর ৭৬ দিনে জেলার ৯টি খাদ্য গুদামে এক ছটাক ধানও সংগ্রহ করতে পারেনি অধিদপ্তর। সংগ্রহ অভিযান শেষ হওয়ার আর ২৯ দিন বাকি রয়েছে।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আমন মৌসুমে এবার সরকারিভাবে জেলার ৯টি খাদ্য গুদামে ৯ হাজার ৪৩ মেট্রিক টন ধান এবং ১৫ হাজার ৮৩০ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রতি কেজি ধান ২৮ টাকা ও চাল ৪২ টাকা কেজি দরে কৃষকের কাজ থেকে কেনা হচ্ছে। কৃষকেরা কৃষি অ্যাপসের মাধ্যমে সরাসরি খাদ্যগুদামে ধান দিতে পারবেন।

গেল বছরের ১৫ নভেম্বর শুরু হয়েছে আমন মৌসুমের  ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রহ অভিযান শেষ হবে। গত ৭৬ দিনে এক গ্রাম ধানও সংগ্রহ করতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। তবে এ সময়ে শতভাগ চাল সংগ্রহের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

২০২১ ও ২০২২ সালেও আমন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি রংপুর খাদ্য বিভাগ। এ সময় আমনের মৌসুমে ১৬ হাজার ২১৪ মেট্রিক টন চাল ও ১০ হাজার ১৪৯ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর মধ্যে চাল শতভাগ সংগ্রহ হলেও ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১৪ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছিল।

জেলায় লক্ষ্যমাত্রার অধিক বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদন হলেও খাদ্যগুদাম লক্ষ্যমাত্রার সিকিভাগও ধান সংগ্রহ করতে পারছেন না।
এবার বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকায় সরকারি মূল্যে বোরো ধান দিতে আগ্রহী হারিয়েছে কৃষকেরা। এতে খাদ্য বিভাগ চালে হাসলেও ধানে যেন ধরাশায়ী। কিন্তু দাম বাড়িয়েও কেন পুরোদমে সফলতার হাসি নেই খাদ্য বিভাগে, সেই প্রশ্ন বরাবরের মতো এবারও ঘুরপাক খাচ্ছে।

কৃষকদের অভিযোগ, খাদ্য গুদাম ১৪ ভাগ আর্দ্রতা না হলে ধান নিতে চায় না। অনেক সময় এ কারণে খাদ্য গুদামে ধান দিতে গিয়ে কৃষকদের ফিরে আসতে হয়। এছাড়াও রয়েছে প্রতি টন ধানে ৫০০-৬০০ টাকা কর্মকর্তাদের প্রদান, রিকশা, শ্রমিকদের চাদা, পরিবহন ভাড়া। এজন্য মূলত কৃষকেরা খাদ্য গুদামে ধান দিতে অনীহা প্রকাশ করেছে। যার ফলে খাদ্য গুদাম বিগত বছরগুলো থেকে ধান সংগ্রহ করতে পারছেন না।

রংপুর সদর উপজেলার হরিদেবপুর এলাকার কৃষক নুরুল হক বলেন, ধান সংগ্রহের সময় আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের নিচে থাকলে সরকারি লোকজন ধান নিতে চায় না। বাড়িতে মেশিন না থাকায় আমরা সঠিক আদ্রতা মেপে যেতে পারি না। খাদ্য গুদামের ধান ফ্যান দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হয়। এর হেরফের হলেই ফেরত পাঠায়। এতে আর্থিক লোকসান গুনতে হয়। তাছাড়া এখন সরকারি দরের চেয়ে বাজারে ধানের দাম অনেক বেশি। আর এসব কোনো ঝামেলা নেই। নগদ টাকায় বাড়ি বিক্রি করায় খাদ্য গুদামে ধান দেই না।

তারাগঞ্জের হাড়িয়ারকুঠির আরেক কৃষক জহুরুল ইসলাম বলেন, খাদ্য গুদামে ধান দিতে গেলে টনে লেবার খরচ আছে, সরকারি অফিসাকেও খুশি করতে হয়। এ ছাড়া টাকা নিতে ব্যাংকে দৌড়াদৌড়ি তো আছে। প্রয়োজনের সময় টাকা পাওয়া যায় না। তাই খাদ্যগুদামে ধান না দিয়ে বাজারে বিক্রি করছি।

ধানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া প্রসঙ্গে কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা ঘাম ঝরানো শ্রমে উৎপাদিত ধান নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তারা বেশি দামে সরকারের কাছে ধান বিক্রির আশায় থাকেন। কিন্তু সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাজারদর বেশি হলে কৃষক কাকে ধান দেবে? লাভ যেখানে সেখানেই কৃষকের ধান গড়াবে। কারণ সরকারের ধান সংগ্রহ করা হয় মূলত কৃষকদের কাছে থেকে। কিন্তু বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকায় এবার কৃষকেরা ধান দিতে আগ্রহী ছিলেন না।

পীরগঞ্জ উপজেলা খাদ্য গুদামের (এলএসডি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফ হোসেন বলেন, কৃষকেরা লাভের আশায় থাকেন, তারা যেখানে বেশি দেখছেন সেখানেই ধান দিচ্ছেন। একারণে সংগ্রহ অভিযানে চালে সফলতা মিললেও ধানে কোনো ভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। মূলত কৃষকদের কাছে থেকে ধান সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহকালীন ধানের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়াতে কৃষকেরা ধান দিতে আগ্রহী নন। তাই ধানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি এবার।

তিনি আরও বলেন, পীরগঞ্জে এবার ৮৫৬ মেট্রিক টন ধান এবং ২ হাজার ৯৯৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক ছটাকও ধান সংগ্রহ হয়নি। তবে অভিযান শুরুর ৭৬ দিনে ২ হাজার ৬৯৯ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ৯০ ভাগ সংগ্রহ হয়েছে। বাকিটা খুব দ্রুত সময়ের হবে বলেও জানান তিনি।

রংপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রিয়াজুর রহমান রাজু বলেন, বাজারে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ধানের দাম বেশি। কৃষকেরা ধান মাড়াইয়ের পরই পাইকারের কাছে বিক্রি করতে পারছেন। এতে কোনো আর্দ্রতার পরিমাপের প্রয়োজন হয় না। তাই তারা খাদ্য গুদামে ধান দিতে অনীহা দেখাচ্ছেন।

ধান-চাল দিতে গিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ৭২২ চাল কল খাদ্য গুদামে চাল দিয়েছে, চুক্তির বাইরে ২০১টি। খাদ্য গুদামে ধান দিতে কৃষকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে