গত রোববার (২১ মার্চ) মধুখালীতে ট্রাক-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হন

সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। যত দিন যাচ্ছে বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বাস-ট্রাক ওভারটেকিং আইন করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না দুর্ঘটনা। ঢাকা-খুলনা (এন সেভেন) মহাসড়কের ফরিদপুর অংশের ফরিদপুর সদর থেকে মধুখালী উপজেলার কামারখালী ব্রিজ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার মহাসড়কে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে প্রাণহানির পাশাপাশি পঙ্গুত্বের জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে অনেককে।

গত ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত ১ বছর ৩ মাসে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার মহাসড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। এর মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও ছাত্র রয়েছেন। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় অনেক স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে।  

ফরিদপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি সময় পর্যন্ত ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ৩০ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি।

গত রোববার (২১ মার্চ) ফরিদপুরের মধুখালীতে ট্রাক-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ছয় সদস্যসহ নিহত হয়েছেন ৯ জন। সকাল ৯টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মাঝকান্দি নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহতদের মধ্যে দুইজন ঘটনাস্থলে মারা যান। চারজনকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। বাকি তিনজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

নিহতরা হলেন- ২০১৯ সালের নভেম্বরে ঢাকার আশুলিয়াতে প্রতিপক্ষের দেওয়া আগুনে নিহত তৃতীয় লিঙ্গের মেহের ওরফে কাজলীর মা মিয়াজান বিবি (৬৮), বোন আমেনা বেগম (৪৮), স্ত্রী কুটি বিবি (৪২), মেয়ে মরিয়ম (২৫), জামাই জুয়েল রানা (৩২) এবং মরিয়ম-জুয়েলের চার মাসের শিশু মুজাহিদ।

নিহত অপর তিনজন হলেন- আইনজীবী আব্বাসউদ্দিন (৪৮), গ্রামের মাতব্বর নজরুল ইসলাম (৬০) ও গাড়িচালক আল আমিন (৩০)। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন- কুদ্দুছ (৩০), নূরুন্নাহার (৩৫), আলামিন (২৫), রাশিদা (৩৫) ও আবদুল্লাহ (৪)। নিহতদের বাড়ি ঝিনাইদহের  মহেশপুর উপজেলার কাজীর বেরিয়া ইউনিয়নের সামন্তখোলা গ্রামে।

মহেশপুর উপজেলার কাজীর বেড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বি এন সেলিম রেজা বলেন, আমার ইউনিয়নের জন্য এটি একটি বিপর্যয়কর ঘটনা। আমাদের ইউনিয়ন কখনও এতগুলো লাশ একসঙ্গে দেখেনি। সারা ইউনিয়নে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

তিনি বলেন, নিহত জুয়েল রানার এক আত্মীয় গত বছর মারা যান। ঢাকার একটি ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট ছিল। ওই অ্যাকাউন্টের টাকা উত্তোলনের জন্যই পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন জুয়েল। পথিমধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটে। 

২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ঘটে আরেকটি বড় দুর্ঘটনা। ফরিদপুর সদর উপজেলার মল্লিকপুর এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের চারজনসহ নিহত হন ছয়জন। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হন আরও কয়েকজন।

নিহতরা হলেন- ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা ওলামাদলের সভাপতি ডা. শরীফুল ইসলাম (৪০), তার মেয়ে তাবাচ্ছুম (৮), ভাগনি তানজিলা (১৮), শ্যালিকা তাকিয়া আক্তার (১৩), বন্ধু এসআই ফারুক হোসেন ও মাইক্রোবাসের চালক নাহিদ। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন ডা. শরীফুল ইসলামের স্ত্রী রিমি আক্তার। 
তিনি বর্তমানে পঙ্গু। 

জানা যায়, সুনামগঞ্জ থেকে বেনাপোলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা মামুন পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মল্লিকপুর এলাকায় পৌঁছালে বোয়ালমারী থেকে ঢাকাগামী একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের চারজনসহ ছয়জন মারা যান।

২০২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুরের মধুখালীতে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্কাস শেখ (৪০) নামে এক মোবাইল ব্যবসায়ী নিহত হন। তার বাড়ি উপজেলার বাগাট ইউনিয়নের মুন্সীপাড়া এলাকায়। 

নিহত আক্কাস মধুখালী বাজারে মোবাইলের ব্যবসা করতেন। তিনি নিজেও মোবাইল মেকানিক ছিলেন। 

জানা যায়, মধুখালী উপজেলার বাগাট ইউনিয়নের মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা মৃত ছরোয়ার শেখের ছেলে আক্কাস শেখ দুপুর ১২টার দিকে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি থেকে মধুখালীতে তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। পথিমধ্যে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের নওপাড়া মোড় নামক স্থানে পৌঁছালে অজ্ঞাত পরিবহন তাকে চাপা দেয়। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। ওই সময় স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে দ্রুত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। হাসপাতালে ভর্তির কিছু সময় পরই তিনি মারা যান।

গত বছরের ২৭ জুলাই ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের তেতুলতলা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হলেন- গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার বরাসুর গ্রামের জাহাঙ্গীর শেখ (৫০) ও চাঁদপুরের সাইফুল ইসলাম (২২)। জাহাঙ্গীর শেখ চাঁদপুরের একটি কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। 

জানা যায়, দ্রুতগতির একটি ট্রাক বিপরীত দিক থেকে আসা একটি অটোবাইক, একটি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশাকে চাপা দিয়ে সড়কের পাশের খাদে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়। 

চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মধুখালী উপজেলার বোয়ালিয়া নামক স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারসহ তিন ব্যক্তি মারা যান। অজ্ঞাত ট্রাকচাপায় তৌফিক আহমেদ শুভ (২৬) নামে এক টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার মারা যান। তিনি রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। তার বাড়ি চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার সেনেরহুদা গ্রামে।

ওই দিন উপজেলার কামালদিয়া ইউনিয়নের টাকদিয়া গ্রামের আবুল শেখের স্ত্রী  ভানু বেগম (৫০) ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের উপজেলার ব্রা‏ক্ষণকান্দা বাজার এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় দ্রুতগামী হানিফ পরিবহনের বাস তাকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।

একই দিন উপজেলার সরকারি আইনউদ্দিন কলেজের সামনে মোটরসাইকেল থেকে পড়ে ঘটনাস্থলেই উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের দীঘলিয়া গ্রামের আবুল কালাম আজাদের মেয়ে তানিয়া (২০) মারা যান। তানিয়া তার দুলাভাইয়ের সঙ্গে মোটরসাইকেলযোগে মধুখালী থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন।

ফরিদপুর হাইওয়ে পুলিশের পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে একাধিক চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। তারপরও সুযোগ পেলেই বেপরোয়া গতিতে গাড়িগুলো চলাচল করে। আর এতেই বিপর্যয় নেমে আসে। 

ফরিদপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহরিয়ার রুমি জানান, গাড়ির চালক ও মালিকদের পাশাপাশি যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে। তবেই বেপরোয়া গতি রোধ করা সম্ভব হবে। সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে এন সেভেন সড়কের বিভিন্ন স্থানে ডিসপ্লে দেওয়া হয়েছে।

ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অ্যাডভোকেট শিপ্রা গোস্বামী বলেন, এই মৃত্যুর মিছিল রোধ করতে শুধু ডিসপ্লে আর চেকপোস্ট বসিয়ে হবে না। আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার। যারা বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালায় তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

এ বিষয়ে ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, আমরা আর সড়কে মৃত্যুর মিছিল দেখতে চাই না। কেউ প্রত্যাশা করে না তার আপনজন হারিয়ে যাক। এক্ষেত্রে অবশ্যই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি সড়কে চলাচলকারীদের আরও সচেতন এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল  হতে হবে। 

বি কে সিকদার সজল/আরএআর