একসময় আমবাগানে ভোর থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত আম পাড়া, আম প্যাকেট করা, দূরদূরান্তে পাঠানো ও বিক্রিসহ যাবতীয় কর্মযজ্ঞ। তিন মাস কাজ শেষে কখন আসবে পরের মৌসুম; সে অপেক্ষা শুরু হতো। তিন মাসের আয় দিয়ে সারা বছর সংসার চলত না তাদের। আমের রাজধানীখ্যাত দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের এমন দৃশ্য প্রতি বছরই দেখা যেত।

শিবগঞ্জ উপজেলা ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা। এখানকার কর্মহীন মানুষ বছরের বাকিটা সময় কাজ না পেয়ে হতাশায় ভুগতেন। বাড়ির পাশেই যেহেতু ভারতীয় সীমান্ত, অনেকেই নিরুপায় হয়ে অবৈধকাজে জড়াতেন। সীমান্তে গরু, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ নানা নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য ও পণ্য আনা-নেওয়ার কাজ করতেন। একসময় এসব কাজকে যুক্তিযুক্ত মনে করতেন তারা।

এমন কর্মকাণ্ড ২০০৬ সালের আগে। তবে এখন এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা বদলে দিয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনামসজিদ স্থলবন্দর। ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে স্থলবন্দরটি চালু হওয়ার পর এখানকার শ্রমজীবীদের কাজের চিন্তা নেই। সীমান্তঘেঁষা শাহবাজপুর ও দায়পুকুরিয়া— এই দুই ইউনিয়নের পাঁচ হাজার দিনমজুর স্থলবন্দরে কাজ করছেন। এতে স্থলবন্দরের কার্যক্রমের প্রভাব পড়েছে তাদের জীবনযাত্রায়। তারা এখন স্বপ্ন দেখছেন উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার।

জানা যায়, সোনামসজিদ স্থলবন্দরের পানামা পোর্ট লিংকের ভেতরে নিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা এক হাজার ২৬৬ জন। বাকি প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক ফলমূল, মসলা, বিভিন্ন কৃষিপণ্য, পাথর, কয়লা ও জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্য ভারতীয় ও দেশীয় ট্রাকে ওঠানো-নামানোর কাজ করেন। তবে এখন তাদের অবসর বসে থাকার ফুরসত নেই।

সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে আপেল, কমলা, আঙুর, কিশমিশ, বেদানা, এলাচ, দারুচিনি, জিরা, চিড়া, চাল, গম, ভুট্টা, তামা, দস্তা, শাড়ি, পাথর, কয়লা ও পেঁয়াজ আমদানি-রফতানি হয়।

বন্দরের নিবন্ধিত শ্রমিক বালিয়াদিঘী পূর্বপাড়া গ্রামের আব্দুস সামাদ (৩০)। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে স্থলবন্দরে কাজ করি। এখানে কাজ করার আগে কৃষিক্ষেতে দিনমজুরের কাজ করতাম। দুদিন কাজ পেলে পরের দুদিন বসে থাকতে হতো। সংসার চালাতে হিমশিম খেতাম। খুব কষ্টে দিন কাটত। স্থলবন্দরে কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা আয় করি। পরদিন কাজ পাওয়া না-পাওয়া নিয়েও চিন্তা নেই। প্রতিদিন ব্যস্ত থাকি আমরা।

আরেক শ্রমিক কর্ণখালী গ্রামের নুরুল ইসলাম (৪৫) বলেন, আট বছর ধরে এখানে কাজ করি। আল্লাহর রহমতে কাজ করে অনেক ভালো আছি। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আরেক ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছি। এমনকি একটি গাভিও কিনেছি। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে স্থলবন্দরে কাজ করে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সরকার আরও বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখলে অধিক পরিমাণে পণ্যদ্রব্য আমদানি-রফতানি হবে। এতে শ্রমিকেরাও লাভবান হবেন।

ভারতীয় ট্রাক থেকে পাথর নামানো ও বাংলাদেশি ট্রাকে পাথর ওঠানোর কাজ করেন বালিয়াদিঘী গ্রামের রাজিবুল হকের ছেলে মো. শামীম (২৫)। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হওয়ায় পড়াশোনা করা হয়নি। প্রায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করে চলেছেন স্থলবন্দরে। এখানে সারাদিন কাজ করে উপার্জন করেন ৬০০-৮০০ টাকা। 

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বাড়ছে প্রতিদিন। গত কয়েক বছরে আমাদের মজুরি বাড়েনি। অনেক ভারী ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়। কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় আহত হই। চিকিৎসার জন্য যেতে হয় সদর হাসপাতাল অথবা রাজশাহীতে। তাই আমাদের দাবি, সোনামসজিদ স্থলবন্দরে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হোক।

স্থলবন্দরের শরিফুল ইসলাম বলেন, আগে ছেলেমেয়েদের ভালো পোশাক কিনে দিতে পারিনি। ভালো খাওয়াতে পারিনি। নুন আনতে পান্তা ফোরায় অবস্থা ছিল। গত চার বছর ধরে বন্দরে কাজ করে সচ্ছল হয়েছি।   

তিনি বলেন, এখন এখানে কাজের সুবাধে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভালো আছি। এছাড়া তাদের উন্নত ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবতে পারি। সোনামসজিদ স্থলবন্দর এলাকায় কাজ করা সব শ্রমিকের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান তিনি।

সোনামসজিদ স্থলবন্দরের পানামা পোর্ট লিংকের শ্রমিক ঠিকাদার ও মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. সেনাউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, স্থলবন্দর চালু হওয়ার আগে শিবগঞ্জ উপজেলা শাহবাজপুর ও দাইপুকুরিয়া ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষ বিভিন্ন চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এখন কাজের জায়গা তৈরি হওয়ায় তারা এসব ছেড়ে দিয়ে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করছেন।

শ্রমিকদের জন্য বিমার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা বিভিন্ন সময়ে আহত বা নিহত হতে পারেন। তাই তাদের জন্য বিমার ব্যবস্থা থাকলে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম গতিশীল হবে এবং তারাও খুশি হবেন। এমনকি এতে তাদের পরিবারও সুরক্ষা পাবে।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের বিমার বিষয়ে আলোচনা করা হবে জানিয়ে সোনামসজিদ স্থলবন্দরের পানামা পোর্ট ম্যানেজার মাইনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে স্থলবন্দর থেকে ৪৮১ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি তা ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এতে অবশ্যই শ্রমিকদের বড় ভূমিকা রয়েছে।

আমদানি-রফতানিকারকদের সংগঠন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকার শ্রমজীবীদের জন্য সবচেয়ে বড় কাজের ক্ষেত্র সোনামসজিদ স্থলবন্দর। অন্যদিকে সরকারেরও উচিত শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করা। কারণ, এখনো পণ্যবোঝাই ও খালাস করতে একমাত্র অবলম্বন শ্রমিকরাই। এই এলাকার শ্রমজীবীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সোনামসজিদ স্থলবন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

মুঠোফোনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ডা. শামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিবেচনায় ইতোমধ্যে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আশা করি, খুব দ্রুত হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু করা হবে। এছাড়া করোনাকালে খাদ্যসামগ্রী ও স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিভিন্ন উপকরণ শ্রমিকদের বিতরণ করা হয়েছে। এমনকি দুই ঈদে তাদের উৎসব বোনাসের ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে।

এতদিন বিভিন্ন কোন্দলের কারণে শ্রমিকদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ সফল করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে সব শ্রমিকের জন্য বিমা চালুর বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে আলোচনা করা হবে।

এনএ/এমএ