মিরাজ ছোটকাল থেকেই পড়ালেখার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। পারিবারিক অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও কোনো অবস্থাতেই তিনি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেননি। কারণ, লেখাপড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন তার সব সময় ছিল। স্বপ্ন দেখতেন চিকিৎসক হয়ে গরিব মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবেন, মানবিক চিকিৎসক হয়ে দেশের কল্যাণে নিজের মেধাকে কাজে লাগাবেন।

২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস কোর্সের প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাক্রমে ৩৭৯৫তম হয়ে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ জামালপুরে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন মিরাজ। ভর্তি পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৬৯.৫ নম্বর।

কিন্তু অভাব-অনটনের কারণে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে তার। অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তার পরিবারের সবার মধ্যে।

মো. ফিরোজ উদ্দিন ও মালেকা বেগমের দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে তৃতীয় সন্তান মো. মিরাজ এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় নোয়াখালী ন্যাশনাল মডেল কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

তাদের বাড়ি নোয়াখালী সদরের চর শুল্লাকিয়া গ্রামের চাঁদ মিয়া বাড়িতে। তারা বাবা দিনমজুরের কাজ করেন ইটভাটায়। দিনশেষে যা রোজগার, তা দিয়েই চলে সংসার। মিরাজের মা মালেকা বেগম গৃহিণী। তার বড় ভাই রিয়াজ উদ্দিন পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করে চালাচ্ছেন তার পড়ালেখার খরচ।

হতদরিদ্র ঘরে জন্মগ্রহণ করেও মো. মিরাজ এবার এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। ভর্তির খরচ মেটাতে একমাত্র দুধের গরুটা বিক্রির সিদ্ধান্ত মা মালেকা বেগমের। তা-ও মায়ের দুশ্চিন্তা, তারপর নিজেদের কী হবে? ছেলের প্রতি মাসের খরচ চালাবেন কী করে?

মিরাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, খেয়ে না-খেয়ে পড়াশোনা করে আজ আমার এই পর্যন্ত আসা। বাবা ইটভাটায় কাজ করেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী বাবার পক্ষে সংসার ও আমার পড়ালেখার খরচ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমার বড় ভাই পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে আমার পড়ালেখার খরচ চালিয়েছেন। আমাদের অভাব-অনটনের সংসার। নদীভাঙনের ভয়ে নিজ বাড়ি থেকে নানার বাড়িতে এসে থাকি। পরিবারের এমন পরিস্থিতি দেখেও আমি একদিন চিকিৎসক হব, এই স্বপ্ন দেখতাম।

তিনি আরও বলেন, একমাত্র বসতভিটা ছাড়া আমার পরিবারের আর কোনো সম্বল নেই। আমি চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ পেয়েও টাকার অভাবে মেডিকেলে ভর্তি হতে পারব কি না, এখন সেই দুশ্চিন্তা আমাকে তাড়া করছে। একটি দুধের গরু আছে। তা বিক্রি করে হলেও মেডিকেলে পড়ানোর ইচ্ছা করছে আমার পরিবার।

মিরাজের বড় ভাই রিয়াজ উদ্দিন বলেন, একসময় আমার স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু পারিবারিক অভাবের কারণে সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সেই স্বপ্ন এবার পূরণ করবে আমার ভাই। ২০১৭ সাল থেকে আমার টিউশনির টাকা দিয়ে মিরাজের পড়ালেখার খরচ চালিয়েছি। সামনে তার মেডিকেলের খরচ কীভাবে চালাব, তা নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় আছি।

আমার মতো গরিব বাবার সন্তান মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, এ জন্য গর্বে আমার বুকটা ভরে ওঠে, এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা বাবার দুশ্চিন্তাও কম নয়। ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দিনমজুর, ইটভাটায় কাজ করি। এ অবস্থায় ছেলের পড়ালেখার খরচ কোথায় পাব, তা ভেবে কিনারা পাচ্ছি না। যদি সমাজের সচ্ছল, বিত্তবান বা কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসত, তাহলে আমি আমার ছেলেকে চিকিৎসক বানানোর লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে পারতাম।

এদিকে নিজে খেয়ে না-খেয়ে সন্তানকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়েছেন মা। অভাবের সংসারে সন্তানের সফলতায় আনন্দের সীমা নেই তার। তিনি বলেন, আজ আমাদের পরিবারে খুশির দিন। কিন্তু এই খুশির ভেতর দুশ্চিন্তাও আছে। কীভাবে মেডিকেলে ভর্তি করাব ছেলেকে? দরিয়ায় স্বামীর বাড়ি ভেঙে যাওয়ার ভয়ে বাপের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ছেলেকে মেডিকেলে ভর্তি করানোর সামর্থ্য আমাদের নাই। একটা দুধের গরু আছে। কিছু না পেলে শেষ পর্যন্ত গরুটা বিক্রি করে হলেও সন্তানকে ভর্তি করাব।

বিবির হাট রশিদিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুহিনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিরাজ আমাদের স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। সে অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী। তার মাধ্যমে আমাদের স্কুলের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি।

নোয়াখালী ন্যাশনাল মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. ওবায়দুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিরাজ মেধাবী ছাত্র হওয়ায় কলেজের বেতন মওকুফ করা হয়েছিল। ক্লাসে পড়ালেখায় তার অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল। যদি সে ভালো সুযোগ পায়, তবে সফল হতে পারবে।
 
এনএ