মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসে যে নারীর নাম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়, তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাঙালি সমাজ যখন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সময় বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারীসমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। আজ ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৪০তম জন্ম ও ৮৮তম মৃত্যুদিবস আজ।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ভাস্কর্য

১০ বছর আগে রংপুর জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিএম এনামুল হক রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে আনার প্রতিশ্রুতি দেন

দিবসটি নিয়ে নানা আয়োজন থাকলেও রোকেয়ার জন্মস্থানে তার অনুরাগীদের মন ভালো নেই। এ বছরও রোকেয়ার কবরে ফুল দিতে পারছে না রংপুরবাসীর। আরও একটি বছর পার হচ্ছে আজ। বেগম রোকেয়া উপমহাদেশের নারীসমাজকে কুসংস্কারের দেয়াল ছেদ করেছিলেন। গৃহবন্দী নারীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন আলোর মশাল। সেই মহীয়সী নারীর স্মৃতিবিজড়িত জন্মস্থান আজও পড়ে আছে অবহেলায়। উদ্যোগের অভাবে এখানে রোকেয়াচর্চা ও পর্যটন কেন্দ্রের দ্বারও রুদ্ধ।

রোকেয়া সাখাওয়াতের বাড়ির ভগ্নদৃশ্য

নানা বিষয়ে পায়রাবন্দ এলাকার মানুষের মনে হতাশা ও ক্ষোভ। ১০ বছর আগে রংপুর জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিএম এনামুল হক রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। শুধু তা-ই নয়, বেগম রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটিও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নেই এই মহীয়সী নারীর কোনো ভাস্কর্য। রোকেয়ার আদর্শে সমাজসংস্কারে মেয়েরা এগিয়ে গেলেও অবহেলিত রয়েছে গেছে তার জন্মস্থান পায়রাবন্দ।

১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০১ সালে তিনি এটি উদ্বোধন করেন

বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র

দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা শেষে আজ রংপুর নগরের শালবন ইন্দিরা মোড়ে বেগম রোকেয়ার অবয়ব ‘আলোকবর্তিকা’ উন্মোচন করা হবে। বেলা ১১টায় ভাস্কর অনীক রেজা ভাস্কর্যটি অবমুক্ত ঘোষণা করবেন। পরে দিনক্ষণ ঠিক করে রংপুর সিটি করপোরেশন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। এ বছর রংপুরবাসীর জন্য বেগম রোকেয়ার স্মৃতি রক্ষায় এই ভাস্কর্যটি বড় পাওয়া।

মরদেহ আনার ঘোষণা কালক্ষেপণ

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাকিস্তান থেকে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মরদেহ চাঁপাইনবাবগঞ্জে আনার পর রংপুর অঞ্চলের মানুষ রোকেয়ার মরদেহটিও পায়রাবন্দে এনে সমাহিত করার জোরালো দাবি তুলেছিল। ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া মেলায় রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক দাবিটির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

স্মৃতিকেন্দ্রের ভেতরের পুকুর

২০১০ সালে একই স্থানে বিএম এনামুল হক বলেছিলেন, মরদেহ পায়রাবন্দে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরে আবেদন করা হয়েছে।  ২০১১ সালের রোকেয়া দিবসের আগে তার মরদেহ পায়রাবন্দে আসবে। এ ঘোষণায় সেদিন পায়রাবন্দবাসী আনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু নয় বছর পূর্ণ হলো, কিন্তু এ ব্যাপারে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন। অথচ বিগত দিনে প্রতিশ্রুত ঘোষণার বাস্তবায়নের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে একাধিক নারী সংগঠন সভা, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠকসহ নানা কর্মসূচি পালন করে মরদেহ আনার দাবিটি সরকারের কাছে জানিয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি।

নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তার গ্রন্থাবলির অনুবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা, সংস্কৃতিচর্চা এবং স্থানীয় যুবাদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে ২০০১ সালে স্মৃতিকেন্দ্র চালু করা হয়

অবহেলায় রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র

১৯ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি। আইনি জটিলতা কাটিয়েও সরকারি উদ্যোগের অভাবে এটি অবহেলায় পড়ে আছে। অথচ নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তার গ্রন্থাবলির অনুবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা, সংস্কৃতিচর্চা এবং স্থানীয় যুবাদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে ২০০১ সালে স্মৃতিকেন্দ্রটি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এ নিয়ে পায়রাবন্দবাসীর মনে ক্ষোভ জমে আছে। ৩ একর ১৫ শতক জমির ওপর নির্মিত কেন্দ্রটি দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় আসবাবসহ বিভিন্ন উপকরণ নষ্ট হচ্ছে।

বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র

জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০১ সালে তিনি এটি উদ্বোধন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রথমে কেন্দ্রের দায়িত্বভার নিলেও তিন বছর পর বাংলা একাডেমি এটির দায়িত্ব পায়। ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলা একাডেমির কাছ থেকে এটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলা একাডেমির অধীনে স্মৃতিকেন্দ্রটি হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করা হয়। পরে বাংলা একাডেমির কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু এটি চালুর ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বিশ্বব্যাপী বিবিসির জরিপে বিশ্বসেরা ২০ নারীর তালিকায় ৬ নম্বর স্থান বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের

পায়রাবন্দের মানুষের আক্ষেপ

নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী বিবিসির জরিপে বিশ্বসেরা ২০ নারীর তালিকায় ৬ নম্বর স্থান বেগম রোকেয়ার। অথচ সেই নারীর দেহাবশেষ প্রতিবেশী দেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে বছরের পর বছর গুনতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ঘোষণা দিয়েছিলেন রোকেয়ার কবর পায়রাবন্দে আসবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি এখন ফাইলবন্দি।

বেগম রোকেয়ার বাড়ির চিহ্ন

অন্যদিকে পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসমত আরা বলেন, আমরা যাকে নিয়ে গর্বিত, তার কবর এই মাটিতে হবে। এ নিয়ে আশায় বুক বেঁধে আছি। প্রতিবছর রোকেয়া দিবসে তার কবরে শ্রদ্ধা জানাব। কিন্তু সেই আশায় বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। এটি বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই।

বেগম রোকেয়ার ভাতিজি রনজিনা সাবের বলেন, সরকার চাইলে সবকিছুই সম্ভব। আমাদের এই সামান্য দাবিটা সরকার পূরণ করতে পারছে না? অন্যদের মরদেহ যদি আনা যায়, তবে কেন রোকেয়ার মরদেহ আনা হচ্ছে না? আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে? আমরা রোকেয়ার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে চাই।

হচ্ছে না রোকেয়া মেলা

রংপুর জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বিগত বছরগুলোয় যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালিত হলেও এবার তিন দিনের মেলার কার্যক্রম স্থগিত করেছে জেলা প্রশাসন। করোনাকালীন কারণে উন্মুক্তভাবে জনসমাগম যাতে না হয়, সেদিক বিবেচনায় তিন দিনব্যাপী রোকেয়া মেলা বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিবস পালন উপলক্ষে তার জন্মভূমি পায়রাবন্দে রাখা হয়েছে এক দিনের আংশিক কর্মসূচি। এর মধ্যে রয়েছে সকালে রোকেয়ার স্মৃতিস্তম্ভে নিজ নিজ দায়িত্বে পুষ্পমাল্য অর্পণ, স্থানীয় জামে মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ভিডিও কন্ফারেন্সের মাধ্যমে রোকেয়া দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠান্য।

তার বাড়িসংলগ্ন প্রাচীর

 এদিকে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের উপপরিচালক আব্দুল্যাহ আল-ফারুক জানান, এ বছর করোনার কারণে মেলা না হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে রোকেয়া দিবস পালন করবেন তারা।

এনএ