ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমের তপ্ত দুপুর। ঘড়ির কাঁটা তখন ১২টার ঘরে। প্রখর সূর্যের তাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এমনি বৈরী পরিবেশে তেল ভাঙার ঘানির ভারী জোয়াল নিয়ে ঘুরছেন চান মিয়া-ফিরোজা বেগম দম্পতি। ৪০০ কেজি ওজন তখন কাঠের কাতলাতে (কাঠের দণ্ড)। 

গত ৪৫ বছর ধরে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কুশমাইল কড়ইতলা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব এ দম্পতি এভাবেই গরুর বদলে নিজেরাই ঘানি টেনে সরিষা ভাঙা তেল বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন।

বয়সের ভারে আগের মতো আর শক্তি নেই শরীরে তাদের। তবে এবার সেই কষ্ট লাঘব হতে চলেছে তাদের। কারণ, ঘানির জোয়াল টানার জন্য মিলেছে একটি ষাঁড়।

একই গ্রামের তারা মিয়া ও কমলা বেগম দম্পতিও একই পেশায়। তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। দুই ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছেন। তারা মিয়ার জমিজমা না থাকায় একমাত্র সম্বল ভিটাবাড়িটুকুই। বংশের সবাই এ পেশা ছেড়ে দিলেও রয়ে গেছেন তিনি।

সরেজমিনে তারা মিয়ার বাড়িতে দেখা যায়, অনেক যত্ন নিয়ে গরুকে খাওয়াচ্ছেন স্ত্রী কমলা বেগম। গ্রামের এমন দৃশ্য অনেকের কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও কমলা বেগমের কাছে এ এক অন্য রকম অনুভূতি। কেননা, কয়েক দিন আগে তার কাছে এই গরুটিই ছিল একমাত্র সোনার হরিণ।

স্বামী-সন্তানকে নিয়ে অভাবের সংসারে খাবার জোটাতে ৩২ বছর ধরে টেনে চলেছেন ঘানি। তবে সম্প্রতি পাল্টে গেছে সেসব দৃশ্যপট। কড়ইতলা গ্রামের এ দুই পরিবারের ঘানি টানার এমন কষ্টের চিত্র উঠে আসে গণমাধ্যমে। পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ান সরকারি দফতরসহ বিত্তবানরা। তাতেই ঘুরে যায় তাদের ভাগ্যের চাকা।

জানা গেছে, সম্প্রতি দুই পরিবারের ঘানি টানার খবর কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে নজরে আসে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হকের। পরে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল সিদ্দিককে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তর ও প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে একটি গরু কিনে সেটি উপহার দেন তারা মিয়া-কমলা বেগম দম্পতিকে। এদিকে একটি বকনা গরু উপহার দিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের ময়মনসিংহ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আব্দুল মজিদ।

এ ছাড়া দরিদ্র বৃদ্ধ চান মিয়া, তার স্ত্রী ফিরোজা বেগমকে সহযোগিতা করতে সিরাজগঞ্জ থেকে ছুটে আসেন সামাজিক সংগঠক দ্য বার্ড সেফটি হাউসের চেয়ারম্যান মামুন বিশ্বাস। তিনি তার প্রবাসী এক বোনের সহযোগিতায় এ দম্পতিকে উপহার দেন একটি ষাঁড় ও খাদ্যসামগ্রী।

জীবনসংগ্রামের এতটা পথ পাড়ি দিলেও এর আগে সহযোগিতা মেলেনি কখনো। তবে শেষবেলায় এমন উপহারে আপ্লুত পরিবার দুটি। এখন তাদের আর কাঁধে নিতে হবে না ঘানির জোয়াল। উপহারের গরুতেই ভাগ্যবদলের স্বপ্ন এখন তাদের চোখেমুখে।

ফিরোজা বেগম বলেন, বিয়ের পর থেকেই সংসারের ঘানি টানা শুরু হয়েছে। সারাজীবন এভাবেই কষ্ট করেছি। রাত হলেই সারা শরীর ব্যথা করে। এখন আর ঠিকমতো চলাফেরাও করতে পারি না। এই উপহার পেয়ে এখন আমাদের কষ্ট অনেক কমে গেল।

ফিরোজার স্বামী চান মিয়া বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘানি টেনে যে দু-এক কেজি তেল বের হয়, তা ফুলবাড়িয়া বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করি। একসময় পাঁচ থেকে ছয় কেজি তেল বের করতে পারলেও এখন আর শরীর চলে না। তবে গরুটা পেয়ে আমি খুবই খুশি হয়েছি। এটি দিয়েই ঘানি টানাব এখন।

তারা মিয়ার স্ত্রী কমলা বেগম বলেন, কখনো গরু কেনার সামর্থ্য ছিল না। এখন সাংবাদিক ভাইদের কারণে দুইটা গরু পেয়েছি। এতে আমাদের শরীরের ওপর থেকে কষ্ট কমে গেল। গরু দুটি লালন-পালন করব। এদের নিয়েই এখন আমাদের স্বপ্ন।

জীবনসংগ্রামী এই দুই পরিবারের ভাগ্যবদলের পেছনে যিনি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি হলেন স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হালিম। তিনি পত্রিকার পাতায় তুলে ধরেছেন তাদের নিদারুণ কষ্টের চিত্র। জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে এ সাংবাদিক বলেন, একটি ছেলে মেসেঞ্জারে আমাকে একটি ছবি দেয়। সেই ছবির সূত্র ধরেই একদিন সকাল ছয়টায় সেই গ্রামে যাই। এরপর সেই দুই পরিবারের সদস্যরা যে গরুর বদলে নিজেরাই ঘানি টানছেন, সেটি দেখে আমার নিজেরই খুবই কষ্ট লেগেছে। এরপর তাদের সেই সংগ্রাম তুলে ধরি পত্রিকায়।

তিনি আরও বলেন, খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই অনেকেই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দুই পরিবার তিনটি গরু পেয়েছেন এবং অনেকে তাদের টাকা ও খাদ্যসামগ্রীও উপহার দিয়েছেন। আমি মনে করি, এখন তারা এই গরুর মাধ্যমে অনেকটা উপকৃত হবে, স্বাবলম্বীও হবে। তাদের আর ঘানি টানা লাগবে না, ঘানি টানার যে দুর্বিষহ কষ্ট, তা আর তাদের করা লাগবে না।

এনএ