নেত্রকোনায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ইটভাটা

সরকারি নিয়ম-নীতির কোনো রকম তোয়াক্কা না করেই নেত্রকোনায় যত্রতত্র গড়ে উঠছে অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা। মুনাফালোভী এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব ইটভাটা গড়ে তুলছেন বলে জানা গেছে। এতে চরম হুমকিতে পড়েছে জেলার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য।

জেলার বিভিন্ন জনবসতিপূর্ণ এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন ও ফসলি জমিতে এসব ইটভাটা গড়ে উঠায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও।

সরকারি অনুমোদন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধ এসব ইটভাটার কার্যক্রম চলে আসায় ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, গ্যাস ও ধুলায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন এলাকার লোকজন। এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন হওয়াসহ হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বিনষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ।

 
স্থানীয়দের অভিযোগ, অবৈধ ইটভাটাগুলো অবাধে পরিচালিত হয়ে আসলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন এসব অনিয়ম দেখেও দেখছেন না। তবে জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অচিরেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিকে ইটভাটার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক, নির্দিষ্ট এলাকায় ইটভাটার জায়গা ও ভাটার সংখ্যা নির্ধারণ, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা চালালে দুই বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান সংযোজন করে ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে সংশোধনী এনে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা (নিয়ন্ত্রণ) সংশোধন আইন, ২০১৯’ বিল সংসদে পাস করা হয়।

নতুন এ আইনের ধারা-৪ এ সংশোধন এনে বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ইট ভাটা যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট থেকে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করতে পারবে না।

কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ-ধর্মপাশা সড়কে কংস নদীর ব্রিজ সংলগ্ন সামাইকোনা গ্রামে মোহনগঞ্জ পৌর এলাকার মৃত রাধাচরণ রায়ের ছেলে বিপ্লব রায় অবৈধভাবে নদী ভরাট করে ‘ডিসিএস’ ইটভাটা স্থাপন করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। নদী ভরাট করে এ ইটভাটাটি পরিচালিত হওয়ায় নদীর নাব্য হারিয়ে যাচ্ছে এবং স্থানীয় পরিবেশ ও জলবায়ু দূষণের ফলে জনস্বাস্থ্য চরম ঝুঁকিতে পড়েছে।

একই এলাকার সামাইকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ‘একিউসি’ ইটভাটা। এ ইটভাটা পরিচালনা করছেন পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার দশধরী গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরীর ছেলে আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী। এছাড়া কোনো ধরনের সরকারি অনুমোদন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় ‘এবিএম’, ‘এএসটি’, ‘সনি ও এপেক্স’ ইটভাটা চলছে। পুরো জেলায় এ রকম ৩৬টি অবৈধ ইটভাটা চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

‘ডিসিএস’ ইটভাটা সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা খাইরুল ইসলাম বলেন, বসতবাড়ির পাশে ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় আমরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছি। ধোঁয়ার কারণে গাছের ফল-ফলাদিও কমে গেছে। আবার নদী ভরাট করে যেভাবে দখল করা হচ্ছে তাতে নদীর নাব্যও হারিয়ে যাচ্ছে।

সামাইকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমানের সঙ্গে তার স্কুল সংলগ্ন ‘একিউসি’ ইটভাটা নিয়ে কথা হলে তিনি জানান, ইট ভাটাটি স্কুল সংলগ্ন হওয়ায় ভাটার কালো ধোঁয়া ও কালিতে কোমলমতি শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বসবাসকারীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয় আবু তালেব নামে এক ব্যক্তির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের পর জেলা প্রশাসন ভাটাটি বন্ধের জন্য মালিককে লিখিতভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপরও অদৃশ্য শক্তির বলে ইটভাটার কার্যক্রম চলছে।

এ নিয়ে জেলার মোহনগগঞ্জ উপজেলার ‘ডিসিএস’ ইটভাটার মালিক বিপ্লব রায়ের সঙ্গে কথা হলে নদী ভরাট করার কথা তিনি অস্বীকার করেন।

জেলার কেন্দুয়া উপজেলার ‘এবিএম’ ও ‘এএসটি’ ব্রিকসের মালিক সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, অন্যান্য অবৈধ ইটভাটা যেভাবে চালাচ্ছে। আমরাও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সেভাবেই ইটভাটা চালাচ্ছি।

এসব বিষয়ে কথা হলে নেত্রকোনা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাবিকুন্নাহার বলেন, নেত্রকোনায় ২৪টি ইটভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া আরও কিছু অবৈধ ইটভাটাও চলছে বলে শুনেছি। জনবল সংকটের কারণে দায়িত্ব পালন করতে আমাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া যে সব ইটভাটার কার্যক্রম চলমান রয়েছে, সেগুলোর ব্যপারে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান বলেন, প্রত্যেক ইটভাটাকে লাইসেন্স নবায়ন করাসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লাইসেন্স নবায়ন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে ব্যর্থ হবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এমএসআর