লক্ষ্মীপুরে টমেটোর বাম্বার ফলন হলেও নেই সংরক্ষণাগার

লক্ষ্মীপুরে এবার ৫১০ হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার মেট্রিক টন টমেটো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে প্রথম থেকে মৌসুমের শেষ পর্যন্ত গড়ে ৩০ টাকা দরে এ টমেটোর দাম প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। তবে উৎপাদিত সবজির সঠিক দাম পেতে সরকারিভাবে একটি হিমাগার স্থাপনের দাবি কৃষক ও সচেতন মহলের।

এদিকে টমেটোর বাম্বার ফলন হলেও সংরক্ষণের অভাবে দাম নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা। প্রথম দিকে দাম ভালো পাওয়া গেলেও উৎপাদন বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কমতে থাকে। এর সঙ্গে কৃষকের মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আতঙ্কও রয়েছে।

এ ছাড়া আবাদি জমি ও উৎপাদিত ফসল রক্ষায় কীটনাশক-সারের ব্যবহারের পরামর্শ কৃষকরা কৃষি বিভাগ থেকে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের নির্দেশনা অনুযায়ী সারা-কীটনাশক ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক।

সম্প্রতি সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের সুতার গোপ্টা ও মিয়ারবেড়ি এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র জানায়, লক্ষ্মীপুরে ৫১০ হেক্টর জমিতে টমেটোর আবাদ করা হয়। এর মধ্যে জেলা সদর ১৫০ হেক্টর, রায়পুরে ১৬৫ হেক্টর, রামগঞ্জে ৫০ হেক্টর, রামগতিতে ১০০ ও কমলনগর উপজেলায় ৪৫ হেক্টর জমিতে টমেটোর চাষ হয়। এ বছর ৪০ হেক্টর বেশি জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। জেলায় ১২ থেকে ১৩ হাজার মেট্রিক টন টমেটো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সাড়ে ১৫ হাজার মেট্রিক টন টমেটো উৎপাদন হবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গড়ে ৩০ টাকা কেজি দরে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার টমেটো বিক্রি করতে পারবেন কৃষকরা।

মানিক রতন, সুফলা, অন্যান্য ও রুমা বি-৮ হলো উৎপাদিত এসব টমেটোর জাত। এ ছাড়া কয়েকজন শৌখিন কৃষক বিজলি-১১ জাতের উচ্চফলনশীল টমেটোর চাষ করেন। এ জাতের একটি গাছে ৩৬ কেজি টমেটো উৎপাদন হয়। লক্ষ্মীপুরে নভেম্বর মাসে টমেটোর চারা রোপণ করা হয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত কৃষক টমেটো সংগ্রহ করেন।

এ জেলায় একটি হিমাগার (কোল্ডস্টোরেজ) ছিল। তবে সেটা ব্যবহার অনুপযোগী। এটি সংস্কারেও নেই কোনো উদ্যোগ। জেলা প্রশাসনের মাসিক সভায় হিমাগারের বিষয়টি কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কৃষকের উৎপাদিত আলু, টমেটো, সিম, বেগুন, কাঁচা মরিচ, ক্যাসিকাম ও ড্রাগন ফল যেহেতু পচনশীল, তাই ন্যায্যমূল্য পেতে সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। সংরক্ষণ না করতে পারায় কম দামেই এসব বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষক। এ জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে হিমাগার স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

কয়েকজন কৃষি দিনমজুর জানান, তারা ফসলি খেতে সকাল সাতটা থেকে বেলা একটা ও বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। এর মধ্যে পুরুষ শ্রমিক, নারী শ্রমিক ও শিশু শ্রমিকদের পৃথক শ্রমমূল্য দেওয়া হয়। তবে কেউই শ্রমের ন্যায্যমূল্য পান না বলে দাবি তাদের।

সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে কৃষক তাদের উৎপাদিত সবজির সঠিক দাম পেতেন। কৃষকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও এ জেলায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য সারা বছর পাওয়ার লক্ষ্যে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে হিমাগারের জন্য প্রস্তাব দিয়েছি।

মো. বেলাল হোসেন খান, উপপরিচালক, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

সদর উপজেলার মিয়ারবেড়ি এলাকার কয়েকজন জানান, প্রতিবছরই তারা টমেটো চাষ করেন। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও ভালো। মৌসুমের শুরুতে উৎপাদন কম হলেও দাম ভালো থাকে। উৎপাদন বাড়তে শুরু করলে দামও কমতে থাকে। মৌসুমের শেষে পানির দরে টমেটো বিক্রি করতে হয়। এতে ফসল উৎপাদনে খরচের সঙ্গে আয়ের পরিমাণ কাছাকাছি চলে আসে। লাভ একেবারেই কম হয়। এ এলাকায় সংরক্ষণের জন্য কোনো হিমাগার নেই। গাছ থেকে টমেটো সংগ্রহের পরপরই বিক্রি করে দিতে হয়। দ্রুত বিক্রি না করলে পচে যায়। এতে বাধ্য হয়েই কম দামে বিক্রি করতে হয়।

সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া বলেন, মৌসুমভেদে ভবানীগঞ্জে টমেটোসহ প্রচুর সবজি উৎপাদিত হয়। কিন্তু এসব সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থা নেই। কৃষক বাধ্য হয়ে তা কম দামে বিক্রি করে দেন। এতে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক। এ জেলায় উৎপাদিত সবজি সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে হিমাগার স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি।

এক শিশু শ্রমিক টমেটো স্তূপ করছে

লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. বেলাল হোসেন খান বলেন, সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে কৃষক তাদের উৎপাদিত সবজির সঠিক দাম পেতেন। কৃষকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও এ জেলায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য সারা বছর পাওয়ার লক্ষ্যে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে হিমাগারের জন্য প্রস্তাব দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। ৩৩ শতাংশ লোক নিয়ে পুরো জেলায় কাজ করতে হয়। এ জন্য কৃষকের ধারে ধারে গিয়ে পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী এর সুযোগও নেই। এখনকার কার্যক্রম গ্রুপপদ্ধতির মাধ্যমে হচ্ছে। এতে নির্দিষ্ট কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও তাদের ফসলি খেত পর্যবেক্ষণ করা হয়। পরে অন্য কৃষকদের ওই সব ফসলি খেত পরিদর্শন ও পরামর্শ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া যেসব ইউনিয়ন পরিষদে কৃষি বিভাগ আছে, সেখানে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য উপস্থিত থাকেন বলে জানান তিনি।

এনএ