মাঠজুড়ে শোভা পাচ্ছে তেলজাতীয় শস্য পেরিলা

বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে আশা দেখাচ্ছে তেল ফসল ‘গোল্ডেন পেরিলা’। এর অন্য নাম ‘সাউ পেরিলা-১। এ বছর জেলার গোদাগাড়ীতে পরীক্ষামূলক চাষ হয়েছে এ ফসল। সফলতাও পেয়েছেন চাষিরা। আগামীতে বরেন্দ্রজুড়ে পেরিলা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন কৃষি দপ্তর।

নতুন ফসল হিসেবে এবার পেরিলার পরীক্ষামূলক চাষ করেন গোদাগাড়ী পৌর এলাকার লালবাগ রামনগর মহল্লার বাসিন্দা শাহাদাত হোসাইন। তিনি জানান, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার ফেসবুকে পোস্টে তিনি উপজেলায় পেরিলার গবেষণা প্লট বিষয়ে জানতে পারেন। যোগাযোগ করার পর তিনি সেই সুযোগ পেয়েও যান। পরে পেরিলা বীজ, সার ও কীটনাশকসহ সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে কৃষি দপ্তর। 

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এই যুবক জানান, তিনি সাত কাঠা জমিতে পেরিলা চাষ করেছেন এবার। তা থেকে বীজ পেয়েছিলেন ৯ কেজি। তেল হয়েছে এক লিটার ৮০০ গ্রাম। পুরো তেল উপজেলা কৃষি দপ্তর সংগ্রহ করেছে। এই সাফল্য তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আগামীতে বড় পরিসরে পেরিলা চাষ করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

শাহাদাত আরও জানান, তার পেরিলা চাষ দেখে স্থানীয় কৃষকরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।  চাষের আগ্রহ নিয়ে অনেকেই তার সঙ্গে যেগাযোগও করেছেন। এখনও অনেকে যোগাযোগ করছেন।

পেরিলা চাষে তেমন বাড়তি যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন নেই জানিয়ে তরুণ এই কৃষি উদ্যোক্তা জানান, তিনি বীজতলায় বীজ বপন করেন। এর এক মাসের মাথায় চারা তৈরি হয়। এরপর জমি তৈরি করে সাধারণত মরিচ কিংবা বেগুন চারা রোপণের মত করে সারিবদ্ধ করে পেরিলা চারা রোপণ করেন। 

শুধু শুয়োপোকা পেরিলার পাতা খেয়ে ফেলছিল। তাছাড়া কিছু গাছে ছত্রাকের আক্রমণে কাণ্ড পচে যায়। এই দুই বালাই নিয়ন্ত্রণে তিনি কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ মেনে কীটনাশক প্রয়োগ করেন। এরপর আর আক্রমণ আর হয়নি।

গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, দেশের ১৪টি অঞ্চলে একযোগে পেরিলার গবেষণা প্লট ছিল। বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া এবং গোদাগাড়ী পৌর এলাকার লালবাগ রামনগর এলাকায় দুটি প্রদর্শনী প্লট ছিল পেরিলার। নতুন এই ফসল চাষে সাফল্য পাওয়া গেছে। 

তিনি আরও জানান, পেরিলার চারা আগস্টে জমিতে রোপণ করতে হয়। কিন্তু গোদাগাড়ীতে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে রোপণ করেছিলেন তারা। আর ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে তোলা হয় ফসল।এরপর স্থানীয় সরিষা ভাঙানোর মেশিনে পেরিলার বীজ ভাঙানো হয়েছে। প্রতি কেজি পেরিলায় তেল পাওয়া গেছে ৪০০ গ্রামের মত। বাজারে প্রতি লিটার পেরিলার তেল ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এটি আশা জাগানিয়া খবর।

আগামীতে পেরিলা সম্প্রসারণের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা সব তেল ফসলের প্রদর্শনী প্লট করি। এর আওতায় কিভাবে পেরিলা আনা যায় সেটি চিন্তাভাবনা চলছে। যত দ্রুত সম্ভব এর চাষ ছড়িয়ে দেবেন কৃষকদের মাঝে।

 পেরিলাক্ষেত পরিদর্শন করছেন কৃষি কর্মকর্তারা

জানা গেছে, পেরিলার বৈজ্ঞানিক নাম Perilla frutescens। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে পেরিলার চাষ হয়। বাংলাদেশে যে পেরিলা চাষের জন্য অভিযোজিত হয়েছে সেটি কোরিয়ান পেরিলা।

সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি জাতীয় বীজ বোর্ড ‘সাউ পেরিলা-১’ নামে পেরিলার নতুন জাতের নিবন্ধন পায়। পেরিলার এই জাতটি সারাদেশে উৎপাদনক্ষম। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পেরিলা চাষ উপযোগী। হেক্টর প্রতি প্রায় দেড় টন ফলন পাওয়া যায়।

পেরিলা একটি ভোজ্যতেল ফসল যার শতকরা ৬৫ ভাগই ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। পেরিলার তেল বিশেষত হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও ত্বকসহ ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধে বেশ কার্যকর।

এর আগে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এইচ এম এম তারিক হোসাইনের অধীনে পেরিলা নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করেন কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম মজুমদার।

তিনি বলেন, মূল জমিতে পেরিলার জীবনকাল ৭০ থেকে ৭৫ দিন। এটি সহজেই চার ফসলি জমিতে চাষের আওতায় আনা সম্ভব। পেরিলার প্রতিটি পুষ্পমঞ্জুরিতে ১০০ থেকে ১৫০টি বীজ পাওয়া যায়। ফলে অন্য তেল ফসল থেকে এর উৎপাদনমাত্রা অনেকাংশে বেশি।

গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ড. এইচএম তারিক হোসাইন বলেন, মুলত চীন, কোরিয়া ও থাইল্যান্ডে পেরিলার বহুল প্রচলন রয়েছে। চাইনিজ, কোরিয়ান ও থাই রেস্টুরেন্টগুলো সবজি হিসেবে পেরিলার পাতা ব্যবহার করে। দেশীয় এমন রেস্টুরেন্টগুলো বিদেশ থেকে পেরিলার পাতা আমদানি করে।

তিনি আরও বলেন, পেরিলার বীজ থেকে যে তেল উৎপাদন হয় তা অত্যন্ত উচ্চমূল্যের। পেরিলার ফুলে প্রচুর মৌমাছি বসে। ফলে বাণিজ্যিক মধু চাষেও সম্ভাবনা দেখাচ্ছে পেরিলা।

এসপি