ভারতের উজান থেকে তিস্তায় ধেয়ে আসা ঢল থেমেছে। নামতে শুরু করেছে তিস্তার পানি। নদীর কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও আবার কোমর পর্যন্ত। এখন আকস্মিক বন্যার ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ছে। কোথাও পড়ে আছে বিধ্বস্ত বাড়ি-ঘর। পানির তোড়ে বালুতে চাপা পড়েছে ফসলি খেত। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, বাঁশের সাঁকো সবই লণ্ডভণ্ড। বিবর্ণ তিস্তায় পানি কমায় স্বস্তি ফিরলেও কান্না থামেনি নদীপারের মানুষদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, নদী তীরবর্তী রংপুরের গঙ্গাচড়ার নিম্নাঞ্চল থেকে পানি সরে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি খেত উঁকি দিচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও এখনো পানিতে ডুবে শীতকালীন সবজির খেতসহ মিষ্টি কুমড়া, আগাম আলু ও ধানখেত। স্রোতের কাছে হার মানা গাছগাছালিও পড়ে আছে। 

স্থানীয় কৃষকেরা জানায়, কিছু খেত থেকে পানি সরে গেলেও এসব খেতে ফসল আবাদ নিয়ে শঙ্কিত তারা। পানি সরে যাওয়ার পরে কিছু কিছু ফসলে পচন দেখা দিয়েছে। ফলে চরের চাষিরা ফসলে এবারও সফল হতে না পারার দুশ্চিন্তায় আছেন।

পানি কমে আসাতে সকালে ধান কাটতে কাস্তে হাতে চরের ফসলি খেতে গিয়েছিল মোহসীন আলী। লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের পূর্ব ইচলি গ্রামে তার বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে ধানের জমির পানে চেয়ে তার চোখ বেয়ে পানি ঝড়েছে। বিস্তৃণ ধানের জমি কাঁদা, বালু আর পলিতে চাপা পড়ে আছে। স্বপ্নঘেরা ধানের শীষ দেখে ইস্ শব্দটি মোহসীন আলীর বুকের ভেতরে হানা দিয়েছে বারবার। 

এই ধানচাষি বলেন, এবার বানের পানিতে সর্বনাশ হয়েছে। একদিনের পানিতে এরকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এর আগে কখনো হয়নি। কতদিনে কীভাবে নুয়ে পড়া ধান বালু সরিয়ে কাটাব, তা ভেবে পাচ্ছি না। প্রতি বছর আমরা কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

একই ইউনিয়নের কেল্লারহাট গ্রামের কৃষক নাছিমুুদ্দী বকস বলেন, হামার আবাদি জমি সোগ তলে গেচলো। এ্যালা বানের পানি কমাতে ধানের শীষ দেকা যাওচে। কিন্তু পুরো খেত বালুর চাপাত তলোত পড়ি আছে। আলু, শাক-সবজি, কুমড়ার অবস্থা আরও খারাপ। ভারত হামার শ্যাষ করিল বাহে। হঠাৎ এদোন করি পানি ছাড়লে হামরা বাঁচমো ক্যামন করি? এই অসময়ে বানোত হামার মেলা ক্ষয়ক্ষতি।

তিস্তার কোলঘেঁষা শংকরদহ গ্রামের কৃষক জয়নাল মিয়া বলেন, ‌‌বাড়ির কাছের চরোত একনা আগাম আলু আর মিষ্টি কুমড়া নাগাচনু (চাষ করা) বাহে। শীতের সময় নয়া আলু তুলি বেশি দাম পাই, কিন্তু হঠাৎ বানোতে মোর সোগ আশা শেষ। এ্যলা আবাদসুবাদ (চাষাবাদ) সোগে বালুপানিত তলে আছে। পানি কমার দুইদিন পর বসতভিটাত আসছি। কিন্তু হামার থাকার ঘর কোনাও ভাঙ্গি গেইছে।

কৃষক মোহসীন, নাছিমুদ্দি ও জয়নালের মতো নদীপারের অনেক চাষির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাদের হাড়ভাঙা কষ্ট ও ঋণের টাকায় শুকনা তিস্তার বুকে সবুজ খেত জেগে উঠতে শুরু করেছিল। কিন্তু গত ১৯ অক্টোবর মঙ্গলবার রাতে ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়ায় হু হু করে পানি ঢুকে পড়ে ভাটিখ্যাত বাংলাদেশের উত্তরে তিস্তা অববাহিকায়। 

এতে রংপুরের গঙ্গাচড়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে দেখা দিয় বন্যা। হঠাৎ সৃষ্ট বন্যায় বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় ফুলেফেঁপে উঠেছিল তিস্তা। অবশ্য এর দুদিন পরই পানি কমতে শুরু করে।

গঙ্গাচড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবার তিস্তা বেষ্টিত নিম্নাঞ্চল ও নদীর বুকে জেগে ওঠা চর এলাকায় ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হয়েছে। এর পুরোটাই আকস্মিক এ বন্যায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া ২৪ হেক্টর জমিতে আগাম জাতের আলু ও ৩৫ হেক্টর জমিতে মিষ্টি কুমড়া এবং ধান ১ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। তবে আকস্মিক বন্যার পানির স্রোতে এসব ফসলের বেশির ভাগ খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, পানি কমে আসাতে এখন ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমিগুলো একটু একটু দেখা যাচ্ছে। তবে এখনো ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। যেভাবে পানির স্রোত ছিল, তাতে ফসলের ক্ষতির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করা হবে।

এমএএস