নিরাময় কেন্দ্রে টর্চার সেল, রাতে আসে কান্নার শব্দ
রংপুরে মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে উদ্ধার হওয়া ভুক্তভোগীরা
মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য রংপুরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। কিন্তু এসব চিকিৎসাকেন্দ্রে নেই পর্যাপ্ত অভিজ্ঞ চিকিৎসক বা কর্মী। পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণও নেই। ন্যূনতম মান বজায় রেখে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার নামে চলছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নজরদারির অভাবে এসকল কেন্দ্র হয়ে উঠছে রোগী পেটানোর ‘টর্চার সেল’।
এমন একটি টর্চারসেলের সন্ধান মিলেছে রংপুর নগরের মেডিকেল পূর্ব গেট এলাকায়। প্রধান মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নামে বিশেষায়িত এই চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে ভেসে আসে রোগীর কান্নার আওয়াজ। কখনও কখনও রাতে তাদের গলা ফাটানো কান্নায় ঘুম ভেঙে যায় স্থানীয়দের।
বিজ্ঞাপন
বুধবার (২৭ জানুয়ারি) মধ্যরাতে এমন কান্নার আওয়াজ শুনে নিরাময় কেন্দ্রের কাছে জড়ো হয়েছিল এলাকার কয়েকজন। কিন্তু তাদের কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি নিরাময় কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। পরে বাধ্য হয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং পুলিশে খবর দেন তারা।
প্রধান মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ স্থানীয়রা প্রবেশ করলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। সুস্থ্ হয়ে বাড়ি ফেরার আশায় ভর্তি হওয়া রোগীদের ওপর চলছিল শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মহড়া। যে পাশবিকতা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করতে থাকেন ভারসাম্যহীন মাদকাসক্ত রোগীরা।
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে স্থানীয়রা জানান, নিরাময় কেন্দ্রটিতে প্রতিদিনই রোগীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও সেখানকার সীমাহীন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, ভুক্তভোগীদের অসহায়ত্ব আর ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। শুধু তাই নয়, রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা আদায় করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নিজেরাই নিরাময় কেন্দ্রের ভেতরে মাদক সেবন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ভেতরে চিকিৎসাসেবা প্রদানের আড়ালে যে আলাদা টর্চার সেল রয়েছে, তা তাদের অজানা ছিল।
এদিকে, ওই নিরাময় কেন্দ্রে থাকা রোগীদের অভিযোগ, প্রতিদিনই তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। কেন্দ্রের ইনচার্জ আকিল ও মোহন মিলে তাদের এসএস পাইপ দিয়ে পায়ে ও ঘাড়ের মধ্যে চেপে ধরে মারধর করে। ইলেকট্রিক শক দেওয়া ছাড়াও বিবস্ত্র করে শরীরের বিভিন্ন অংশে মরিচের গুঁড়া লাগিয়ে দেন। তিনবেলা ঠিকমতো খাবার দেয় না। এই শীতের মধ্যে তিনটা রুমে কখনও চল্লিশজন, কখনও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন একসঙ্গে মেঝেতে থাকেন। রাত হলেই কাউকে না কাউকে মারধর করা হয়। আলাদা রুমে ডেকে নিয়ে ইচ্ছেমতো পেটান কেন্দ্রটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
এখানে কয়েক মাস ধরে চিকিৎসাধীন রয়েছে সবুজ (ছদ্মনাম)। দশ বছর আগে শখের বশে বন্ধুদের আড্ডায় প্রথম গাঁজা সেবন করেছিলেন এই যুবক। এরপর প্রায়ই সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সবুজের ঠোঁট গাঁজায় ডুবে থাকত। এভাবেই নিয়মিত তিনি গাঁজা সেবনের সঙ্গে সঙ্গে হিরোইন ও ইয়াবায় মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন। হয়ে উঠেন মাদকাসক্তদের একজন। তার বাবা-মা তাকে মাস চারেক আগে এই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করান।
সবুজ বলেন, মারধর করা, ঘুষি দেওয়া এবং শাস্তি হিসেবে না খাইয়ে রাখা হয়। কখনও কখনও রাতে দাঁড় করিয়ে রাখে। খাবারের কোনো নিয়ম নেই। পঁচাবাসী খাবার জোর করে খাওয়ানো হয়। শুধু কথায় কথায় মারধর আর ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোই এখানকার চিকিৎসা পদ্ধতি।
তিনি আরও বলেন, আসক্তির কারণে অস্থির হয়ে উঠলে কর্মীরা আমাকে লাঠি দিয়ে পেটান। গোপনাঙ্গে মেরে জখম করে দেয়। কিল ঘুষি তো আছেই। মাঝে মাঝে এই অমানবিক আচরণ সহ্য করতে আমার মতো অনেকেই গলা ছেড়ে চিৎকার দেয়। কেউ আমাদের বাঁচাতে আসে না। সবাই মনে করে এখানে চিকিৎসা হচ্ছে।
এ কেন্দ্রে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা আব্দুর রহিমের মনে গভীর দাগ ফেলেছে। তার ভাষায়, তার সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা হয়েছে। কারণে অকারণে তাকে একজন ‘অপরাধী’র মতো মারধর করা হয়।
মাদকাসক্ত আব্দুর রহিম বলেন, কাউন্সিলিং করার নামে আমাদের ওপর কোনো কারণ ছাড়াই অমানবিক আচরণ ও নির্যাতন করা হয়। কখনও কখনও সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখে। ঘুম ধরলে চোখে মরিচ লাগিয়ে দেয়। খাবার দাবার ঠিক নেই। বরং আমাদের দিয়ে রান্না করানোসহ এখানকার সব কাজ করে নেয়। কিন্তু খাবারের বেলা সকালে গরম পানির সঙ্গে ভাত আর দুপুরে আলু ভর্তা ডাল দিয়ে ভাত দেয়। খাবারের মান খুবই খারাপ এবং অস্বাস্থ্যকর।
নাম না প্রকাশের শর্তে আরেক রোগী বলেন, আমাকে আকিল ও মোহন শুধু মারে। মুখে গামছা দিয়ে চেপে ধরে, হাত-পা বেঁধে রাখে। কখনও কখনও রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জোরপূর্বক গোসল করতে বাধ্য করে। প্রায়ই শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারতে মারতে জখম করে দেয়। এখানে মারধর করার জন্য একটা টর্চার সেল রয়েছে। আমরা ভীষণ অসহায়। কান্নাকাটি করি, কিন্তু কেউ তো ভেতরের অবস্থাটা দেখেন না। এ ধরনের চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ হওয়ার আগেই মানসিক নির্যাতনে আমার মৃত্যু হবে। আমি বাড়ি ফিরতে চাই।
মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র থেকে বিপর্যয় ও আসিফ নামে দুইজনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে কেন্দ্রের পরিচালক আদিব বসুনিয়া, ইনচার্জ আকিল, কর্মচারী মোহনসহ অন্যরা ঘটনার সময় পালিয়ে যায়। তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিদর্শক তাহেদুল আলম সোহাগ বলেন, আমরা একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পেয়ে নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে রোগীদের ওপর নির্যাতনের সত্যতা পেয়েছি। এখানকার খাবারের মান খুবই খারাপ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং বেশ কিছু অব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করেছি।
তিনি আরও বলেন, মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি অনুমোদনপ্রাপ্ত। তবে রোগী ও স্থানীয় এলাকাবাসীদের পক্ষ থেকে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে এই নিরাময় কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বুধবার দুপুরের মধ্যে নিরাময় কেন্দ্রটি সিলগালা করার পাশাপাশি তাদের লাইসেন্স বাতিলের জন্য আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এছাড়া এখানে যে সকল রোগী ভর্তি রয়েছে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।
রংপুর জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (নেজারত শাখা, ফরমস, স্টেশনারি অ্যান্ড লাইব্রেরি শাখা) মোহাম্মদ রায়হানুল ইসলাম বলেন, আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এখানে এসে রোগীদের ওপর নির্যাতনের আলামত পেয়েছি। রোগীদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ২৯ জন রোগীর মধ্যে ১৯ জনকে তাদের স্বজন ও অভিভাবকদের উপস্থিতিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ১০জন এখন পুলিশের হেফাজতে থাকলেও সকালে তাদের পরিবারের লোকজনের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
তিনি আরও বলেন, মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার নামে যেভাবে রোগীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা খুবই স্পর্শকাতর। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, মানুষ সুস্থ হওয়ার জন্য এসে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হবে এটা ভাবা যায় না। আজকের ঘটনা থেকে আমরাও সজাগ হয়েছি। এখন অন্য সব মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি