সরকারি গুদামে চাল দিতে এবার চুক্তি করেননি মিলমালিকরা

গত বছরের ৭ নভেম্বর শুরু হয়েছে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রম। ডিসেম্বরে কৃষক ফরিদ মিয়া তিন টন ধান দিয়ে এবারের সংগ্রহ অভিযান শুরু করেন। এরপর তিনি আরও এক টন ধান দেন খাদ্যগুদামে। এ-ই শেষ। আর কোনো কৃষক ধান দেননি গুদামে।    ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে তাই মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান।

আমন ধান সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পথে। ব্যর্থ হতে চলেছে চাল সংগ্রহ অভিযানও। সরকারি গুদামে চাল দিতে এবার চুক্তিও করেননি মিলমালিকরা। গত বছর চুক্তি অনুযায়ী চাল না দেওয়ায় জরিমানা গুনতে হয়েছে ৯ চাতাল-মালিককে।

বোয়ালমারী সরকারি খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আমন মৌসুমে উপজেলার কৃষকদের কাছ থেকে ৪৭৮ মে. টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। দাম ধরা হয়েছিল ২৬ টাকা কেজি বা ১ হাজার ৪০ টাকা মণ। আর মিলারদের কাছ থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যে ৩৭ টাকা কেজি দরে সেদ্ধ চালের বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ১৯৫ মে. টন এবং ৩৬ টাকা কেজি দরে আতপ চালের বরাদ্দ ছিল ৩০৩ মে. টন।

এই ধান-চালের সংগ্রহের সময় শুরু হয়েছে ২০২০ সালের ৭ নভেম্বর থেকে এবং চলবে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে এ পর্যন্ত মাত্র চার টন ধান সরবরাহ করেছেন একজন কৃষক কাম ব্যবসায়ী। আর যে কোনো কৃষক ধান দেবেন, সে সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে। কৃষকদের ধান সরবরাহ সহজীকরণের জন্য এবার লটারি সিস্টেমও তুলে দেওয়া হয়েছে।

সোতাশী গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া ধান মণপ্রতি ১ হাজার ৪০ টাকা হলেও উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত। তারপরও গুদামে ধান দিলে ব্যাংক থেকে টাকা তোলা, শ্রমখরচসহ নানা ঝক্কি-ঝামেলা। এসব কারণেই এবার গুদামে ধান দিচ্ছেন না কৃষকরা।

বোয়ালমারী উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ধানের মূল্যবৃদ্ধির কথা। তিনি বলেন, সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে স্থানীয় বাজারে ধানের দাম বেশি। এ ছাড়া বাজারে যে ময়েশ্চারের ধান বিক্রি করতে পারে গুদামে সেই ময়েশ্চারের ধান নেওয়া হয় না। গুদামে নির্দিষ্ট ময়েশ্চার, চিটামুক্ত এবং সরকারি নিয়মনীতি মেনে ধান নেওয়া হয়।

চাতাল কল

অন্যদিকে গত ইরি-বোরো মৌসুমে ১৫টি চালকল চাল সরবরাহের চুক্তি করলেও এবার আমন মৌসুমে গুদামে চাল প্রদানের জন্য চুক্তি করেনি কোনো মিলমালিক। অতএব এ মৌসুমে এক ছটাক চালও সংগ্রহ হচ্ছে না, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। গত ইরি-বোরো মৌসুমে চুক্তিবদ্ধ যেসব চালকল নির্ধারিত বরাদ্দের ৮০ ভাগের কম চাল সরবরাহ করেছে, তাদের জরিমানা করেছে খাদ্য বিভাগ। জরিমানার টাকা জমা না দিলে জামানতের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না, এ অবস্থায় মিলমালিকরা জরিমানার টাকা ব্যাংকে জমা দেন।

মেসার্স রিফাদ রাইস মিলের মালিক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, জরিমানার নির্দিষ্ট টাকা স্থানীয় সোনালী ব্যাংকে জমা দিয়ে জমা স্লিপসহ জামানতের টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করতে হয়েছে।

উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা যায়, ৯টি রাইচ মিলকে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩১৬ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে সহস্রাইলের সেলিনা নার্গিস রাইচ মিলকে ১১ হাজার ৯০২, সাতৈরের ফরিদ ইসলাম শেখ রাইচ মিলকে ৩১ হাজার ৭৫২, সৈয়দপুরের হাবিবুর রহমান রাইচ মিলকে ৪১ হাজার ৪৯৪, সোতাশী রাইচ মিলকে ১০ হাজার ২৩৮, চতুলের দ্বীপ ট্রেডার্সকে ১৮ হাজার ৩৮২, ছোলনার খন্দকার রাইস মিলকে ১৭ হাজার ৬৪৭, পোয়াইলের রিফাদ রাইস মিলকে ২১ হাজার ৯৬৭, সহস্রাইলের সিকদার এন্টাপ্রাইজকে ২১ হাজার ৬০০ এবং গুনবহার কে এইচ ট্রেডার্সকে ২২ হাজার ৩৩৪ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

চাল সংগ্রহের শুরুতেই চাল নিয়ে নিলে তারা বরাদ্দের সম্পূর্ণ চাল দিতে পারতেন। কিন্তু নানা অজুহাতে প্রথম দিকে চাল নেয়নি খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষ। পরে তারা লোকসান দিয়ে গুদামে চাল দিয়েছেন। আবার জরিমানাও দেওয়া লাগল।

শাহিন শিকদার, মিলমালিক

তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারি দামের চেয়ে বাজারদর কিছুটা বেশি থাকায় মিলমালিকরা চাল দেননি। তারা অপেক্ষায় ছিলেন চালের বাজারমূল্য হ্রাস পায় কি না। বাজারমূল্য হ্রাস না পেলেও মিলমালিকরা চাল সরবরাহ করেছেন। হয়তো সবাই শতভাগ দিতে পারেননি। অনেক মিলার লোকসান দিয়ে চাল দিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন।

এ ব্যাপারে বিকাশ অ্যাগ্রো ফুডের মালিক বিকাশ সাহা বলেন, ইরি-বোরো মৌসুমে লোকসান দিয়ে হলেও বরাদ্দ পাওয়া দুই হাজার মে. টন চাল গুদামে সরবরাহ করেছিলেন। বারবার তো আর লোকসান দেওয়া যায় না। এখন ধানের বাজারমূল্য অনেক বেশি। এক কেজি মোটা চালের উৎপাদন খরচ ৪৫ টাকার ওপরে পড়ে যায়। সেখানে সরকারি মূল্য ৩৭ টাকা। ধান উৎপাদন কম হওয়ায় ধানের দাম বেড়ে গেছে। সে জন্য চালের দামও বেশি। এ জন্য এবার মিলমালিকরা চাল সরবরাহের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেনি। সরকার যদি বাজারমূল্য সমন্বয় করে ধান-চালের দাম নির্ধারণ করে, তাহলে ধান-চাল দুটোই সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।

বোয়ালমারী উপজেলা ধানচাল ক্রয় কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ বলেন, সরকারি দামের চেয়ে বাজারমূল্য বেশি হওয়ায় কৃষকরা গুদামে ধান দিতে উৎসাহী নন। তারপরও ইতিমধ্যে ধান ক্রয় উদ্বোধন করা হয়েছে। এখনো সময় আছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হয়তো ধান কেনা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী।

আর মিলমালিকরা চুক্তি না করলেও সমস্যা নেই। উপজেলা খাদ্য বিভাগ বাজার মনিটরিং করছে। সে হিসাব অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া সরকার বাইরে থেকে চাল আমদানি করছে বলেও জানান ইউএনও।

বি কে সিকদার সজল/এনএ