গুদামে মজুতকরা চাল

বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগে চাল আমদানিতে শুল্ক ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ থাকলেও তা কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

রোববার (২৭ ডিসেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে (অনলাইনে) খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এ তথ্য জানান।  

খাদ্যমন্ত্রী বলেন, বেসরকারিভাবে চালের আমদানি শুল্ক কমানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিয়েছেন। বৈধ আমদানিকারকরা বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্রসহ আগামী ১০ জানুয়ারির মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করবেন।

পরবর্তীতে একটি নীতিমালার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে খাদ্য মন্ত্রণালয় চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।

নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হবে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার

সরকারিভাবে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি ও জিটুজি পদ্ধতিতে চার লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হচ্ছে বলেও জানান মন্ত্রী। 

উল্লেখ্য, গত বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। মিল মালিকরা খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি করেও চালের বাড়তি দরের কারণে অনেকেই গুদামে চাল দেননি। সেইসঙ্গে করোনা মহামারি ও চার দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে খাদ্যশস্য বিতরণের কারণে সরকারের মজুত করা চালও দ্রুত কমছে। সরকারের মজুত খাদ্যের পরিমাণ কমায় এর সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, বর্তমানে সরকারের গুদামে সাত দশমিক ৮৮ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে চাল পাঁচ দশমিক ৫৬ লাখ টন ও গম দুই দশমিক ৩৩ লাখ টন। অথচ মাত্র এক মাস আগে ৫ নভেম্বর খাদ্যশস্যের মজুত ছিল ১০ লাখ তিন হাজার ২০ টন। অর্থাৎ এক মাস ৯ দিনের ব্যবধানে মজুত খাদ্যশস্য থেকে দুই লাখ ১৫ হাজার ২০ টন খাদ্যশস্য কমেছে।

খুচরা দোকানে চাল

গত বছর এই সময়ে সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মোট মজুত ছিল ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ৮৪০ টন। এর মধ্যে চাল ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৭৩০ টন এবং গম তিন লাখ ৫৮ হাজার ১১০ টন। এই হিসাবে গত প্রায় এক বছরের ব্যবধানে সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত কমেছে ৮ লাখ ৮ হাজার ৮৪০ টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেয়া তথ্য মতে, এবার রোপা ও বোনা আমন মিলিয়ে ৫৯ লাখ এক হাজার ৮১৫ হেক্টর জমিতে এক কোটি ৫৫ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৪ টন ধান উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বন্যার কারণে ৫৪ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমির রোপা আমন ও ৫০ হাজার ৯৫৮ হেক্টর জমির বোনা আমন সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বাড়ে ধানের দাম। চলতি আমন মৌসুমে কাঁচা ধানের মণ বিক্রি হয় এক হাজার ৫০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। ধানের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চালের দাম। সরকার যে দরে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে তাতে মিল মালিকরা চাল সরবরাহে রাজি নন। ইতোমধ্যে অনেক মিল মালিক তাদের অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন।

একদিকে সরকারের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হয়েছে, অন্যদিকে খাদ্যশস্য বিতরণের পরিমাণ বেড়েছে। করোনা মহামারি ও কয়েক দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সরকার চাল বিতরণ করেছে ২৭ দশমিক ৭৭ লাখ টন। যা আগের বছরে ছিল ২৫ দশমিক ৯৪ লাখ টন। ফলে খাদ্যশস্যের মজুত দ্রুত কমছে। অন্যদিকে বাজারে চালের দাম বাড়ছে।

বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে সরু চাল, নাজিরশাইল/মিনিকেট ৫৬ থেকে ৬২ টাকা, মাঝারি মানের চাল পাইজাম/লতা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ও মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা সপ্তাহের ব্যবধানে চালের মানভেদে কেজিতে দুই থেকে চার টাকা বেশি।

সবকিছু বিবেচনা করেই চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চলতি মাসেই ভারত থেকে এক লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকারের ক্রয় কমিটি। সরকারের মজুত বাড়াতে প্রাথমিকভাবে দুই লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। তবে পরিকল্পনা রয়েছে কমপক্ষে ৫-৬ লাখ টন চাল আমদানির।

শুল্ক কেন কমাতে চায় সরকার 
চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। চাল আমদানিতে সরকার যে শুল্ক কমানোর কথা ভাবছে সেখানেই তা বলা হয়েছিল। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, কারসাজি ঠেকাতে ও চালের বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে প্রয়োজন মতো চাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে।  

ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, এ বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে এবং কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। তা সত্ত্বেও চালের বাজার অস্থিতিশীল করা হলে এবং চালকল মালিকরা সরকারের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী সরকারি খাদ্যগুদামে সঠিক সময়ের মধ্যে চাল সরবরাহ করতে গড়িমসি করলে কৃষকের স্বার্থ ও চালের বাজার দর উভয়ের মধ্যে সমন্বয় করে প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে প্রয়োজনমতো চাল বিদেশ থেকে আমদানি করার কথা ভাবছে সরকার। 

চালের বাজারের অবস্থা কী 
বছরজুড়েই চালের বাজারে অস্থির থেকেছে। বর্তমানে আমনের ভরা মৌসুমেও মোটা চালের কেজি ৫০ টাকায় পৌঁছেছে। চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। 

কেজিপ্রতি মিনিকেট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, নাজিরশাইল ৫৬ থেকে ৬০ টাকা, চিনিগুড়া ৮৮ থেকে ৯৫ টাকা, কাটারি ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব চালেও কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে প্রায় ৩ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত।

বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ায় সরকারের আমন সংগ্রহ কর্মসূচি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে কমছে সরকারি মজুতও। খোদ সরকারি সংস্থা টিসিবির বাজারদরের তালিকাতেই দেখা যাচ্ছে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বিভিন্ন জাতের চালের দাম এখন ১৭ থেকে ৪৮ শতাংশ বেশি। 

এসএইচআর/এফআর/এনএফ