কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেই। তারপরও ব্যাংকের নামে চলছে প্রতিষ্ঠান। সমবায় অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একের পর এক শাখা খুলছে স্মল ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড বা এসটিসি ব্যাংক নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে আইন লঙ্ঘন করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেটসহ সারা দেশে ৩০০টির বেশি শাখা খোলা হয়েছে। সমবায় অধিদপ্তরের বিধিবিধান লঙ্ঘন করে চলছে অর্থ লেনদেন। চাকরি দেওয়ার নামে করছে অর্থ আত্মসাৎ, গ্রাহকের সঙ্গে করছে নানা প্রতারণা। 

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সম্প্রতি করা এক বিশেষ অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির এসব অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে। তাই অবৈধ এ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ ঘোষণা করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত সংস্থাটি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে বিএফআইইউয়ের প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে বিএফআইইউ একটি তদন্ত করেছে। আইন অনুযায়ী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাতে পারবে না এসটিসি ব্যাংক। তদন্ত প্রতিবেদটি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরকে (সমবায় অধিদপ্তর) জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, সমিতির কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত গ্রামের সহজ সরল হতদরিদ্র মানুষের কাছ থেকে অবৈধভাবে খোলা শাখা অফিসে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে আসছে। সমিতির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। স্মল ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন নিয়েও জটিলতা রয়েছে। সমিতিটি ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই নিবন্ধিত হলেও প্রকৃতপক্ষে সে সময়ের সদস্যদের কোনো অস্তিত্ব নেই। যারা ব্যবস্থাপনা কমিটি বলে দাবি করেন তারাও দুটি গ্রুপে বিভক্ত। দুটি ব্যবস্থাপনা কমিটির একটি আতিকুর রহমান গংয়ের পক্ষ; যার প্রধান কার্যালয় ৯৩, লিলি প্লাজা (৩য় তলায়), মৌচাক, ঢাকা। অপর পক্ষ আবুল হাসান গংয়ের। এদের প্রধান কার্যালয় এইচ এম সিদ্দিক ম্যানশন, ফকিরাপুল, ঢাকা। সুতরাং সমিতিটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এসব অবৈধ শাখা বন্ধের নির্দেশ দেয় সমবায় অধিদপ্তর। এছাড়াও অনেক জেলায় স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় কিছু অবৈধ শাখা বন্ধ করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই চলছে এসটিসি ব্যাংক। এমনকি লোভনীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রচারণাও চালাচ্ছে তারা। চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের মে মাসে রাজশাহী মহানগরীর বর্ণালী মোড়ে মরিয়ম আলী টাওয়ারের চতুর্থ তলায় ব্যাংকটির আঞ্চলিক শাখা অফিস খুলে ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিক পরিচালনার কথা বলে সঞ্চয়, ডিপিএস ও চলতি হিসাবসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে এসটিসি। তবে নাম ব্যাংক আর অনুমোদন সমবায় অধিদফতর হওয়ার খবরে শাখাটি চালু হওয়ার পর থেকেই স্থানীয়দের মাঝে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। এর বাইরে নগরীর সাগরপাড়ায় এসটিসি ব্যাংক লিমিটেডের রাজশাহী শাখা ও বিভাগীয় কার্যালয়, পবা থানার পাশে নওহাটা শাখা অফিস, বানেশ্বর ফাতেমা হক প্লাজায় (৩য় তলায়) বানেশ্বর শাখা অফিস, মোহনপুরের কেশরহাটে একটি শাখা অফিস, তানোর পৌরশহরের চেয়ারম্যান প্লাজার দ্বিতীয় তলায় তানোর শাখা অফিস, বাগমারার ভবানীগঞ্জ বাজারের গোডাউন মোড়ে ভবানীগঞ্জ শাখা অফিসসহ রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অবাধে ব্যাংকের মতোই শাখা প্রশাখা খুলে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এসটিসি ব্যাংক সমবায় অধিদফতর থেকে সমবায় সমিতি হিসেবে শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জ জেলায় কাজ করার অনুমতি নিয়েছে। সংশোধিত উপ-আইন অনুযায়ী কর্ম এলাকার বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করা সমবায় সমিতি বিধিমালা ২০০৪ এর ১২(২) এর পরিপন্থী। এছাড়া সমবায় আইন ২০০১, সংশোধিত ২০০২ ও ২০১৩ এর ২৩(১) ধারা অনুযায়ী কোনো সমবায় সমিতি তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শাখা অফিস খুলতে পারবে না এবং সমবায় সমিতি আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী সদস্য ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ বা ঋণ প্রদান করতে পারবে না। কিন্তু এ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেও সমবায় সমিতির নামের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহার করে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

রাজধানীর মৌচাকে অবস্থিত ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বর্তমানে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। প্রধান কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মালিকদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং আইনি জটিলতার কারণে বেশ কয়েক মাস ধরে কার্যক্রম বন্ধ আছে। তবে নতুন করে শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তরের অধীনে নিবন্ধিত। বিস্তারিত জানতে ব্যাংকের ওয়েবসাইট এবং চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।

ব্যাংকটির ওয়েবসাইট ও প্রসপেক্টাস ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির ৩০০-এর বেশি শাখা রয়েছে। তবে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৪৪টি শাখার। এসব শাখার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। দৈনিক সঞ্চয় প্রকল্প, মুদারাবা মাসিক সঞ্চয়, মুদারাবা শিক্ষা সঞ্চয়, মুদারাবা হজ সঞ্চয় নামে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা ব্যাংকের মতো আমানত নিচ্ছে। এছাড়া সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের শেয়ারও বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব শেয়ারের নাম দেয়া হয়েছে- অংশীদার, নিকট, আস্থা, বিশ্বাস, প্রিয়, আমার ও আপন।

ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এসটিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমানসহ পরিচালকের সংখ্যা মোট সাতজন। বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজনের কোনো ছবি প্রাকাশ করেনি কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে গ্রাহক আকৃষ্ট করতে ওয়েবসাইটের প্রথম পাতায় লেখা রয়েছে, ‘২০১৯ সাল থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে এসটিসি ব্যাংক লিমিটেড। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেব শক্ত ও স্থিতিশীল ভূমিকা রাখছে তারা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যাপক পরিসরে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে এসটিসি ব্যাংক। সীমিত বন্ধক দিয়ে গৃহ ঋণ, আশ্চর্যজনক পুরষ্কার (সুদহার), কর্তব্যনিষ্ঠ ও অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা দিয়ে আসছে তারা।’

এসব বিষয়ে এসটিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি তিনি। উত্তর দেননি ক্ষুদে বার্তারও।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমবায় অধিদপ্তরের যুগ্ম-নিবন্ধক ( ব্যাংক-বীমা ও কৃষি ঋণ) জেবুন নাহার বলেন, ‘তারা যে নাম ব্যবহার করেছে তা সমবায় ও ব্যাংক কোম্পানি আইনের কোনোটাই সমর্থন করে না। তাছাড়া তাদের অসঙ্গতিগুলো আমরা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদককে জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করছে। এটার ওপর অনেকগুলো মামলাও চলছে।

এসআই/এনএফ