শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা/ ফাইল ছবি

শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার একটি গাইডলাইন তৈরি করে মার্চ মাস থেকে ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে গণস্বাক্ষরতা অভিযান। এক্ষেত্রে প্রথমে নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস; এরপর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি তারপর এর নিচের শ্রেণিগুলো খুলে দেওয়া যেতে পারে।

গণস্বাক্ষরতা অভিযানের সুপারিশে বলা হয়েছে, এলাকা হিসেবে প্রথমে যেসব জেলা বা উপজেলায় করোনার সংক্রমণ কম সেসব এলাকাকে প্রাধান্য দেওয়া। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকারকে এখনই একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে।

মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) শিক্ষা বিষয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মোর্চা গণস্বাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত ‘এডুকেশন ওয়াচ’ তাদের এক প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করেছে।

অনলাইন মাধ্যমে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, প্রধান গবেষক ড. মনজুর আহমেদ, পরিসংখ্যান গবেষক ড. সৈয়দ শাহাদাৎ হোসেন, গবেষক মোস্তাফিজুর রহমান গবেষণার বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন।

সংস্থাটি ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে বলছে, মহানগরের বাইরে গ্রামের স্কুলগুলো খুলে দেওয়া যেতে পারে। মার্চ মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বিভাগীয় পর্যায়ের মহানগরের স্কুলগুলো ধাপে ধাপে খুলে দেওয়া যেতে পারে।

সেক্ষেত্রে প্রথমে নিম্ব মাধ্যমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার পর প্রাথমিকের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি খোলা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে নিচের ক্লাসগুলো খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর স্বাস্থ্য সুরক্ষার শর্তগুলো যেমন- স্কুলে শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের মাস্ক পরা, স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ, টয়লেট, ক্লাসরুম, বেঞ্চ স্যানিটাইজ ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে প্রতিটি ক্লাসে একাধিক শিফট করা বা বিকল্প দিনে ক্লাসে উপস্থিতি কিংবা উভয়েই বিবেচনা করা যেতে পারে।

করোনায় হওয়া শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অন্তত দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পর্যায়ের জন্য নমনীয় ও পর্যায়ক্রমিকভাবে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষকদের মানসিক চাপ কমানো ও তাদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা উদ্যোগ নেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলা এবং শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সবাইকে নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রতিটি উপজেলার শিক্ষার্থী সংখ্যা বিবেচনা করে আনুপাতিক হারে অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করেছে গণস্বাক্ষরতা অভিযান।

স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে সবাই

গণস্বাক্ষরতা অভিযানের গবেষণায় বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত ক্লাসে ফিরে আসতে চায়। অন্যদিকে ৭৬ শতাংশ অভিভাবক, ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ৮০ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা স্কুলে খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে প্রাথমিক স্কুল খোলার ক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ও ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সর্তকতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।

এর মধ্যে ৮২ শতাংশ শিক্ষক স্কুল খুলে দেওয়ার আগে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি-মাস্ক ব্যবহার, স্যানিটাইজার ও সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছেন। ৯০ দশমিক সাত শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস তৈরিতে অভিভাবকরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

এদিকে, ৬২ শতাংশ শিক্ষক সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা এবং ২০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষা ছাড়া পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন চেয়েছেন। আর করোনার কারণে স্থগিত হওয়া পরীক্ষা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।

করোনায় শিক্ষায় ক্ষতির পুনরুদ্ধারে ১২ সুপারিশ

করোনায় প্রায় এক বছর শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারের পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। এগুলো হলো- শিক্ষা ক্ষতি পুনরুদ্ধারের জন্য আগামী দুই বছরের পাঠ্যক্রম সংক্ষিপ্ত করে মূল দক্ষতার বিষয়গুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া। প্রাথমিকে বাংলা ও গণিত এবং মাধ্যমিকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত এবং বিজ্ঞান বিষয়ের ওপর জোর দেয়া।

পরীক্ষার জন্য সময় কমিয়ে ক্লাসরুমে বেশি সময় দেওয়া, পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাদ দিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে মূল বিষয়গুলোর ওপর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া। স্কুল পর্যায়ে পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে আনা, স্কুলে ছুটি কমিয়ে আনা, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা এবং শনিবার বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

অনলাইন/অফলাইন ডিজিটাল/দূর-শিক্ষণের একটি কমন প্লাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে। এতে শিক্ষকরা, শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুম, পাঠ ও দূর-শিক্ষণের পাঠের লিংক দিয়ে সহায়তা করা যেতে পারে। শিক্ষা এনজিওগুলোর সহায়তায় শিক্ষকদের সহায়তার জন্য শিক্ষা সহায়ক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এ জন্য অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।

শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক ও শ্রেণিভিত্তিক গাইডলাইন প্রণয়ন এবং সরবরাহ করে এই গাইডলাইনে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন, পিছিয়ে পড়া ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবস্থা, মিশ্রিত পাঠ ও অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রাখা। শিক্ষা পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বাস্তবায়নে জন্য শিক্ষকদের অতিরিক্ত কাজ করতে হবে। এ জন্য তাদের প্রণোদনা বা বিশেষ ভাতা প্রদান করা যেতে পারে। সব শিক্ষক, মাঠকর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনামূল্যে ‘করোনা’ ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে যে নির্দেশিকা হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের জন্য নমনীয়তা করতে হবে এবং জরুরি পরিস্থিতি ও আপদকালীন অবস্থা মোকাবিলার নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও স্থানীয় সরকার, এনজিও ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করতে হবে। ওয়ার্কিং গ্রুপ জাতীয় নির্দেশনাসমূহ স্থানীয়ভাবে বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করবে।

গণস্বাক্ষরতা অভিযান প্রতি বছর মাঠ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার তা সম্ভব হয়নি। মোবাইলফোনের মাধ্যমে আট বিভাগের আট জেলা থেকে ২১টি উপজেলা নির্বাচন করা হয়। প্রতিটি উপজেলা থেকে তিনটি করে এলাকা ক্লাস্টার (শহর, শহরতলী ও গ্রাম) নির্বাচন করে মোট দুই হাজার ৯৯২ জনের কাছ থেকে উত্তর সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৭০৯ জন শিক্ষার্থী, ৫৭৮ জন শিক্ষক, ৫৭৬ জন অভিভাবক, ৪৮ জন উপজেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক কর্মকর্তা এবং ১৬ জন জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক কর্মকর্তা ছিলেন।

এনএম/এফআর