করোনা মহামারি কখনই আসলে কেবল মানুষের সমস্যা না। মহামারির শুরুর দিক থেকেই পোষাপ্রাণী, বন্যপ্রাণীসহ অন্যান্য প্রাণীদের ওপর কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী নভেল করোনা ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে ভেবেছেন বিজ্ঞানীরা। কুকুর এবং বিড়াল এ ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে। করোনায় সংক্রমিত বিড়াল অন্য বিড়ালকে সংক্রমিত করতে পারে বলে মনে করা হয়, অন্তত গবেষণাগারে এমন ফলই উঠে এসেছে।   

বিশ্বের বহু খামারে বেজি জাতীয় আধা জলজ প্রাণী 'মিঙ্ক' করোনা প্রাদুর্ভাবের শিকার হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে লাখে লাখে তাদের হত্যা করা হয়েছে। আবার করোনা সংক্রমিত মিঙ্ক থেকে মানুষের শরীরে করোনা সংক্রমণ হয়েছে বলেও সন্দেহ করা হয়। আবার বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা মানুষ বা গৃহপালিত পশু থেকে করোনা ভাইরাস বন্যপ্রাণীদের মধ্যেও কোনোভাবে সংক্রমিত হতে পারে। আর তেমনটা যদি হয় তবে তা হবে ভাইরাসের এমন এক বিচরণক্ষেত্র যা নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে পড়বে অসম্ভব। 

তবে আশার কথা হলো এরই মধ্যে করোনার কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে গেছে। যদিও সবার তা পেতে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু কুকুর বা বিড়ালের মতো পোষা প্রাণী বা অন্যান্য পশুর জন্য কি করোনার ভ্যাকসিনের প্রয়োজন আছে? যদি জরুরিই হয় তবে কবে নাগাদ তা পাওয়া যাবে? 

পোষা প্রাণীদের ভ্যাকসিন এখনই নয় 
এটা এখনও পরিষ্কার না যে ঠিক কত সংখ্যক কুুকুর-বিড়াল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, যদিও তা মানুষের মতো একই হারে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবার করোনা আক্রান্ত প্রাণীদের যদি শারীরিক কোনো লক্ষণ থেকেও তাকে তবে তা খুবই সামান্য। 

প্রাণীদের শরীরে বিভিন্ন রোগের বিষয়ে নজর রাখা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইকোহেলথ অ্যালায়েন্সের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম কারেশ বলছেন, মানবশরীরে ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে কুকুর বা বিড়ালের খুব বড় একটা ভূমিকা নেই। আর সে কারণেই গণস্বাস্থ্যের দিকটি বিবেচনায় নিয়ে এখনই তাদের ভ্যাকসিন দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।  

গত বছরেরর শেষদিকে চীনে উৎপত্তি লাভ করা নতুন এই করোনাভাইরাসে এরইমধ্যে প্রাণ গেছে ১৭ লাখ ২৪ হাজারের বেশি প্রাণ। কয়েকটি ভ্যাকসিন যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশে অনুমোদন পেয়েছে। তবে এ ভাইরাসের নতুন একটি ধরন বৈশ্বিক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। নতুন এ ধরনের সাথে ভ্যাকসিনগুলো পেরে উঠবে কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ভ্যাকসিনগুলো যদি কার্যকরী না হয় তবে কী হবে সে প্রশ্নও উঠে আসছে। অবশ্য করোনাভাইরাসের প্রচলিত ধরনটির চেয়ে নতুনটি অনেক দ্রুতগতিতে (৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক) ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হলেও এটি যে প্রচলিতটির বেশি মারাত্মক— তার কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যকভাবে প্রাণীদের ভ্যাকসিনের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার (ইউএসডিএ) এখনও প্রাণীদের জন্য কোভিড-১৯ এর কোনো ভ্যাকসিন অনুমোদন দিচ্ছে না। সংস্থাটি মনে করছে, এখনও যে তথ্য রয়েছে তাতে ভ্যাকসিনের খুব প্রয়োজন রয়েছে বলে কোনো ইঙ্গিত নেই। ইউএসডিএ মুখপাত্র জোয়েল হেইডেন বলছেন, কিন্তু লাইসেন্স ছাড়া টিকা কেউ বিক্রি বা বিতরণ  করতে পারবে না।      

অন্য প্রাণীদের কী হবে
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কাঠবিড়ালি থেকে শুরু করে ভেড়া বা তিমি পর্যন্ত বহু প্রাণীকে আক্রান্ত করতে পারে করোনা ভাইরাস। ইকোহেলথের সায়েন্স অ্যান্ড আউটরিচ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাথন এপসটাইন এসব প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রাখছেন শিম্পাঞ্জিকে। তিনি বলছেন, অতীতেও দেখা গেছে হিউম্যান রেসপাইরেটরি ভাইরাসগুলো শিম্পাঞ্জি এবং গরিলার জন্য মারাত্মক  ক্ষতির কারণ হয়েছিল এবং গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, নতুন এই করোনা ভাইরাস আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিপন্নপ্রায় এই প্রজাতিকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দেবে। 

উইলিয়াম কারেশ কালো পায়ের ফেরেটের মতো বিপন্নপ্রায় প্রাণীদের নিয়েও উদ্বিগ্ন। এরাও কোভিড-১৯ এর উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করা হয়। এছাড়া চিড়িয়াখানা বা অভয়ারণ্যে, যেসব জায়গায় ইতোমধ্যে বাঘ এবং অন্যান্য প্রাণীদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, সেসব জায়গায় থাকা শিম্পাঞ্জির মতো প্রাণীদের নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন।   

জনাথন এপসটাইন মিঙ্কদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন মিঙ্ক খামারে করোনা প্রাদুর্ভাবের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এসব জায়গাতেও ভাইরাসের রূপান্তরের সম্ভাবনা আছে এবং সেখান থেকে মানুষ তো বটেই প্রাণীজগতেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।   

মিঙ্ক হোক বা শিম্পাঞ্জি হোক সবক্ষেত্রেই এপসটাইন মনে করছেন এসব প্রাণীদের সাথে আমরা যেভাবে মেলামেশা করি সেক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আসতে হবে। সাধারণত এক জায়গায় একসাথে অনেক মিঙ্ক রাখা হয়; যা ভাইরাসের সংক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দিতে পারে। খামারে কি আমরা তাদের একইভাবে রাখবো তাহলে? আর এর জবাবে তিনি বলছেন, মানুষ করোনা ভাইরাসের টিকা পাক বা না পাক এই ভাইরাসের ঝুঁকিতে থাকা কোনো প্রাণীর কাছে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকের উচিত হবে বাড়তি সতর্কতা নেয়া। গরিলার সংস্পর্শে গেলে সবার উচিত মাস্ক পরে যাওয়া।

প্রাণীদের ভ্যাকসিন সহজেই পাওয়া যেতে পারে, ইতোমধ্যে হাতে থাকতেও পারে 
গেল সপ্তাহেই রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে তারা মিঙ্ক বা বিড়ালের মতো পোষা প্রাণীদের করোনার একটি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করার পথে।  এ ভ্যাকসিনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি, তবে দেশটির যে সরকারি সংস্থা এ ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে তারা জানিয়েছে, কয়েকমাসের মধ্যেই এ ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে।   

যুক্তরাষ্ট্রের ভেটেরিনারি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি জোয়েটিসও মিঙ্ক ও পোষা প্রাণীদের একটি ভ্যাকসিনের জন্য কাজ করছে। নোভাভ্যাক্স মানুষের জন্য ভ্যাকসিন যে উপায়ে তৈরি করেছিল, অর্থাত এ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের মোডিফায়েড ফর্ম ব্যবহার করে, জোয়েটিসও সেই পথ ধরেই এগোচ্ছে। সম্প্রতি কোম্পানি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে বিড়াল এবং কুকুর এই ভাইরাল মলিকিউল অথবা অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে  শক্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছে, তবে এটা এখনও পরিষ্কার নয় যে এটা সংক্রমণ থেকে তাদের সুরক্ষা দিতে পারবে কি-না। 

জোয়েটিসের সংক্রমণ রোগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জন হারডাহম বলছেন, মিঙ্ক ভ্যাকসিনের বিষয়ে তারা ইউএসডিএ-এর সাথে কথাবার্তা চালাচ্ছেন এবং দ্রুতই তারা কুকুর আর বিড়ালের ভ্যাকসিনের বিষয়েও এগিয়ে যাবেন। বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় কর্মরত পশুচিকিতসসকদের সাথে তারা কথা বলেছেন এবং সেখান থেকে ভ্যাকসিনের বিষয়ে তারা আগ্রহের কথাও জানিয়েছে বলে জানিয়েছেন হারডাহম। 

এদিকে অন্যান্য কিছু প্রাণীর জন্য কার্যকরী ভ্যাকসিন হয়তো এরইমধ্যে আমরা পেয়ে গেছি। মানুষের জন্য যেসব কোভিড ভ্যাকসিনের অনুমোদন বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ােলের অনুমতি দেয়া হয়েছে সেগুলো ইঁদুর বা বানরের জন্য কতটা নিরাপদ সেটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। এর অর্থ হলো এসব প্রাণীকে কিভাবে রক্ষা করতে হবে তা হয়তো ইতোমধ্যেই আমাদের জানা আছে। 

করোনার নতুন ধরন : কী বলছে বিশ্ব সংস্থা 
চলমান মহামারি পরিস্থিতিতে করোনার নতুন এই ধরনটির আগমন— বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে অভিযোজন বা মিউটেশন বলা হয়— চলমান মহামারি পরিস্থিতিতে এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার এবং এই ধরনটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। 

কারেশ বলছেন, বিভিন্ন প্রজাতির জন্য ভ্যাকসিসনের ধরনের বিষয়টা খুব সোজাসাপ্টা হওয়ার কথা।  একেক প্রজাতির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা একেক রকম। সুতরাং অ্যান্টিজেন লেভেলটা কখনও দ্বিগুণ কখনও তিনগুণ করতে হবে। কিন্তু ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মূল বিষয়গুলোতে কেনো পরিবর্তন আসার কথা না। 

পরবর্তী মহামারি নিয়ে ভাবা বোকামি নয় 
যাদের ভ্যাকসিন নেয়া হয়ে যাবে তারা কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত হলেও সার্স-সোভ-২ ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন এবং তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়েও দিতে পারেন। কোভিড-১৯  এর টিকা নেয়া অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। এর অর্থ হচ্ছে, আমাদের সবসময়ই সচেতন থাকতে হবে এবং নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির মধ্যে থাকতে হবে। কারেশ বলছেন, অনেকের মধ্যে একটা ধারণা আছে কোভিড-১৯ শেষ হয়ে যাবে। এমন হবে না। এ ভাইরাস থেকেই যাবে। তাই প্রাণীদের জন্যও এ ভাইরাসের ঝুঁকি থেকেই যাবে। 

বন্যপ্রাণী নিয়ে বাণিজ্য, বন উজাড় করা এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে মানুষ ও বন্য প্রাণীর দূরত্ব কমে আসার মতো বিষয়ের কারণে ভবিষ্যত মহামারি নিয়েও উদ্বিগ্ন এপসটাইন। তিনি বলছেন, সার্স-কোভ-৩ এর প্রাদুর্ভাবের বড় ধরনের আশঙ্কা রয়েছে।       

একইসঙ্গে তিনি চান বিজ্ঞানীরা একটি ইউনিভার্সাল করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন নিয়ে কাজে আরও শক্তি লাগাক, যেটা শুধু সার্স-কোভ-২ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেবে না, বরং একই গোত্রীয় অন্যান্য ভাইরাস থেকেও আমাদের সুরক্ষা দেবে। তিনি বলছেন, পৃথিবীতে আছে এমন সব ভাইরাস থেকে তো আমাদের সুরক্ষিত থাকতে হবেই, যে ভাইরাসের সাথে আমাদের এখনও পরিচয় নেই তাদের থেকে সুরক্ষার বিষয়েও আমাদের ভাবতে হবে। 

সায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখা থেকে অনুবাদ নাঈম ফেরদৌস রিতম।