অভিশংসন থেকে ট্রাম্পের রেহাই
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে অভিশংসনের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সিনেটে ভোটাভুটিতে ট্রাম্পের অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ৫৭ জন, আর বিপক্ষে ৪৩ জন। আর এতেই অভিশংসিত হওয়া থেকে উতরে গেছেন সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, কোনো প্রেসিডেন্টকে অভিশংসিত করতে হলে ১০০ সদস্যের সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে ট্রাম্পকে অভিশংসিত করতে হলে ৬৭ জন সিনেটরকে ভোট দিতে হতো। কিন্তু অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেন ৫৭ জন। আর বিপক্ষে ৪৩ জন। ১০ ভোট কম পাওয়ায় অভিশংসনের হাত থেকে সিনেটে দ্বিতীয়বারের মতো রক্ষা পেলেন ট্রাম্প। তবে সিনেটে ট্রাম্পের অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ৭ জন রিপাবলিকান সদস্য।
বিজ্ঞাপন
এদিকে সিনেটে খালাস পাওয়ার পর মুখ খুলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অভিশংসনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই দেওয়া এক বিবৃতিতে সিনেটের এই অভিশংসন শুনানির তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। তিনি তার অভিশংসন বিচারকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ডাইনি খোঁজার মিশন’ বলে অভিহিত করেন।
জো বাইডেনের ক্ষমতাগ্রহণের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতীক ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে সশস্ত্র হামলা ও সহিংসতা চালায় ট্রাম্প সমর্থকরা। এতে এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত হয় পাঁচ জন। সমর্থকদের চালানো এই হামলায় ট্রাম্প উস্কানি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আর এই অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হয়েছিলেন ট্রাম্প। এর মাধ্যমে লজ্জার বিরল এক ইতিহাসও গড়েছিলেন তিনি। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মাত্র দু’জন প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র এক বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প লজ্জাজনকভাবে দু’বার অভিশংসিত হন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের অভিযোগ হলো, নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতি হয়েছে বলে ট্রাম্প একের পর এক প্রমাণহীন অভিযোগ দিতে থাকেন। কিন্তু তার ওই অভিযোগ ছিল পুরোপুরি মিথ্যা। তারপর কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনের সময় ক্যাপিটল ভবনে যেতে সমর্থকদের উস্কানি দিয়েছেন ট্রাম্প। নির্বাচনে জালিয়াতির কথা শুনে সমর্থকরা আগে থেকেই উত্তেজিত ছিলেন। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল হামলার উস্কানি। এ কারণেই ক্যাপিটল ভবনে হামলা করে ট্রাম্প সমর্থকরা। শুধু তাই নয়, নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করতে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান দলীয় প্রতিনিধিকে চাপ প্রয়োগও করেছিলেন ট্রাম্প।
বৃহস্পতিবার সিনেটে বিচারের সময় ক্যাপিটলের দাঙ্গায় ট্রাম্পের উসকানি দেওয়ার অভিযোগের পক্ষে নতুন ভিডিও ফুটেজ প্রদর্শন করে ডেমোক্র্যাট শিবির। ট্রাম্প কীভাবে সেদিন সহিংসতা উসকে দিয়েছিলেন তার বিস্তারিত তথ্য ধাপে ধাপে সিনেটরদের কাছে ব্যাখ্যা করা হয়।
ডেমোক্র্যাটরা নিজেদের চূড়ান্ত বক্তব্যে বলেছেন, ট্রাম্প সম্পদ, জনগণ এবং গণতন্ত্রের ক্ষতি করেছেন। ট্রাম্প তার পদক্ষেপের জন্য কোনও ধরনের অনুশোচনা প্রকাশ করেননি জানিয়ে শুনানিতে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রতিনিধি টেড লিউ বলেন, অভিশংসন, দোষী সাব্যস্ত ও অযোগ্য ঘোষণা করা শুধুই অতীতের বিষয় নয়, এটি ভবিষ্যতের বিষয়ও। যে কারণে এটি নিশ্চিত করা দরকার যে, যাতে ভবিষ্যৎ কোনও কর্মকর্তা, কোনও প্রেসিডেন্ট একই ধরনের কাজ না করতে পারেন।
কংগ্রেসের কৌঁসুলি জো নিগুজ বলেছেন, ট্রাম্প অন্যান্য কিছু মানুষের মতো নন যিনি বিতর্কিত বক্তব্য দিতে পারেন। তিনি একজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন; যিনি সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেছেন; যারা সহিংসতার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তার বক্তৃতার পর সমর্থকরা ক্যাপিটলে দাঙ্গা করেছেন।
ডেমোক্র্যাটরা সিনেটরদের কাছে যে ভিডিও ফুটেজ উপস্থাপন করেছেন, তাতে দাঙ্গাকারীদের বলতে শোনা যায়- ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাওয়া অনুযায়ীই তারা ওয়াশিংটন ডিসিতে এসেছেন। শুনানিতে প্রতিনিধি পরিষদের কৌঁসুলি ডেভিড সিসিলিনি বলেন, কিছু দাঙ্গাকারী স্বীকার করেছেন যে, তারা ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে খুনের পরিকল্পনা করেছিলেন। এছাড়া আত্মগোপনে থাকা আইনপ্রণেতাদের বেইজমেন্ট সিল করে দিয়ে সেখানে গ্যাস ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছিলেন।
তিনি বলেন, আমাদের কেউই কখনও কল্পনা করতে পারিনি যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পাঠানো একদল দাঙ্গাবাজের কারণে আমরা মৃত্যুর ঝুঁকির মুখোমুখি হতে পারি। ক্যাপিটলে সেদিন দাঙ্গার সময় ভীত-সন্ত্রস্ত কর্মীদের জবানবন্দিও সিনেটে তুলে ধরেন তিনি।
তবে শুনানিতে ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালাতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের উস্কানি দিয়েছিলেন বলে ডেমোক্র্যাটদের আনা অভিযোগকে ‘ভয়ঙ্কর মিথ্যা’ বলে আখ্যায়িত করেন তার আইনজীবী মাইকেল ভ্যান ডার ভীন। শুক্রবার শুনানিতে বক্তব্য দেওয়ার সময় ওই আইনজীবী বলেন, (সাবেক) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্যাপিটলে হামলায় সমর্থকদের উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু এটা পূর্ব-পরিকল্পিত হামলা ছিল বলে বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। অর্থ্যাৎ, যেটা ঘটতে যাচ্ছে, সেটাতে আপনি উস্কানি দিতে পারেন না।
মাইকেল ভ্যান আরও বলেছিলেন, ‘ক্যাপিটলে হামলা চালাতে (সাবেক) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা বা সমর্থকদের সহিংস আচরণে তার উৎসাহ বা আহ্বান ছিল বলে যে দাবি করা হয়েছে তা পুরোপুরি অসঙ্গত এবং ভয়ঙ্কর মিথ্যা।’
তার এই দাবির যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ‘‘গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে সহিংসতা শুরুর পর সমর্থকদের উদ্দেশে ট্রাম্প টুইটারে দুটি বার্তা পোস্ট করেন। যার একটি হচ্ছে, ‘শান্ত থাকুন’ এবং অন্যটি- ‘কেউ সহিংসতা করবেন না, কারণ আমরা সুশৃঙ্খল দল’।’’
ট্রাম্পের ভাগ্য এতোদিন ঝুলে ছিল সিনেটের হাতে। মেয়াদ শেষ হওয়ায় সিনেটে অভিশংসিত হলেও হয়তো ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসতো না। তবে অভিশংসিত হলে প্রার্থী হতে পারতেন না ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। সর্বশেষ নির্বাচনে পরাজয়ের পরই ট্রাম্প অবশ্য ২০২৪ সালের জন্য নিজের প্রার্থিতার কথা জানান দিয়ে রেখেছেন। এখন সেই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতেই পারেন ট্রাম্প। আমেরিকার মানুষকে হয়তো এখনও অনেক কিছু দেওয়ার আছে তার!
সূত্র: বিবিসি
টিএম