মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করা হলে তার ‘গুরুতর পরিণতি’ হতে পারে বলে দেশটির সেনাবাহিনীকে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত  ক্রিস্টিনা স্ক্র্যানার বার্গনার।

সোমবার মিয়ানমারের সামরিক সরকারের উপপ্রধান সোয়ে উইনের সঙ্গে এক আলোচনায় তিনি এই সতর্কবার্তা দেন বলে আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মুখপাত্র ফারহান হক।

জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের যোগাযোগের জন্য বিশেষ অনলাইন চ্যানেলে সোমবার সোয়ে উইনের সঙ্গে কথা হয় ক্রিস্টিনা স্ক্র্যানার বার্গনারের।

রয়টার্সকে ফারহান হক বলেন, ‘জাতিসংঘের বিশেষ দূত মিয়ানমার সরকারের দ্বিতীয় প্রধান কর্মকর্তাকে বলেছেন, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন জনগণের মৌলিক অধিকার। এই অধিকারকে সম্মান করতে হবে এবং তাদের প্রতি প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করা যাবে না।’

ক্রিস্টিনা বার্গনারের কথার জবাবে সোয়ে উইন বলেন, আন্দোলনকারীরা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে এবং জনগণ তাদের ভয় পাচ্ছে।

এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘মিয়ানমারের অস্থির বা আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলোতে নিয়মিত সেনা টহল জারি থাকায় সেখানকার সাধারণ মানুষ খুশি এবং তারা নিশ্চিন্ত অবস্থায় রয়েছে।’

সোয়ে উইনের কথার উত্তরে ক্রিস্টিনা স্ক্র্যানার বার্গনার বলেন, ‘মিয়ানমারে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা বিশ্ব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কোনও প্রকার সহিংসতা হলে বা তাদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ করা হলে তার পরিণতি খুব গুরুতর হবে।’

গত বছর নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস জয় লাভ করে মিয়ানমারের নেত্রী সু চির নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি। নির্বাচনে পার্লামেন্টের ৮৩ শতাংশ আসনে জয় পায় দলটি।

মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী দেশটির পার্লামেন্টের মোট আসনের ২৫ শতাংশ এবং গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট করা; কিন্তু গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন দেশটির রাজনৈতিক দল এনএলডির বিপুল বিজয় সাংবিধানিক সেই হিসাব ওলট-পালট করে দেয়।

ফলে নির্বাচনের পর বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগির প্রশ্নে অস্বস্তি শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে। এর প্রেক্ষিতেই নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ভোটার তালিকা প্রকাশে নির্বাচন কমিশন বরাবর দাবি জানায় সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বলা হয়, নভেম্বরের নির্বাচনে দেশজুড়ে অন্তত ৮৬ লাখ ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে বলে তথ্য রয়েছে তাদের কাছে। এই তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য ভোটার তালিকা প্রয়োজন।

তবে নির্বাচন কমিশন সেই তালিকা প্রকাশ করেনি। সেনাবাহিনীর অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে দেশটির নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে বলেছে, যে অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়েছে তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।

এরপর গত ১ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলায় রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। দেশটির সেনাপ্রধান মিং অং হ্লেইং এর নেতৃত্বে সংঘটিত ওই অভুত্থানে বন্দি হন মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী সু চি এবং তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) বেশ কয়েকজন সদস্য। এদের মধ্যে সু চির মন্ত্রিসভার কয়েকজন মন্ত্রী, প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী ও পার্লামেন্ট সদস্যরাও রয়েছেন।

সেনাবাহিনীর অভুত্থানের অব্যবহিত পরই ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন মিয়ানমারের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাতে দেশটির বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় গণপ্রতিবাদে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীরা ‘অমঙ্গল দূর হবে’ বলে স্লোগান দেন এবং রীতি অনুযায়ী অমঙ্গল দূর করতে হাঁড়ি-পাতিল বাজান।

চলমান বিক্ষোভ ও অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে দেশটির রাজধানী নেইপিদো, প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনসহ অন্যান্য শহরের ৭০টি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, সামরিক সরকারের অধীনে তারা চিকিৎসাসেবা দেবেন না। পরে তাদের অনুসরণ করে ধর্মঘটে যান দেশটির সরকারি প্রশাসনের অন্যন্য দপ্তর ও সেবাখাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। ইতোমধ্যে আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক নারী মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে।

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ক্ষুব্ধ করেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলোকেও।  ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

সূত্র: রয়টার্স

এসএমডব্লিউ