মিয়ানমারে দুর্বৃত্তদের জয়, নির্যাতিতদের পক্ষে দাঁড়াবে কে?
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনালের মিং অং হ্লেইং
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। আটক করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট উহন মিন্টসহ দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চিকে। অভ্যুত্থানের কয়েকদিন পর থেকেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ। কিন্তু কোনো পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দেশটির শাসন ক্ষমতায় কী তবে সামরিক কর্মকর্তারা আবারও পাকাপাকি ভাবে বসে গেল?
এর জন্য হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দোষ দেওয়া যায়! কারণ অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের পরপরই কেন তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি! অথবা, সামরিক শাসকদের উৎসাহ দেওয়ার কারণে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও অভিযুক্ত করা যায়। অথবা, বার্মার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য হয়তো ট্রাম্পের পূর্বসুরী বারাক ওবামাকেও দোষারোপ করা যায়। তবে এগুলোর থেকে সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে- সামরিক জান্তা সরকারকে সমর্থন এবং মানুষের চেয়ে ব্যবসায়িক লাভকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় চীনকে অভিযুক্ত করা।
বিজ্ঞাপন
রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যুতে মিয়ানমারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। কিন্তু কাউকেই রক্ষা করা যায়নি। এমনকি করণীয় নিয়ে সীমাহীন বিতর্ক আর আলোচনা করেছে নিরাপত্তা পরিষদও। এছাড়া গণতন্ত্রপন্থী হিসেবে পরিচিত নোবেলবিজয়ী অং সান সু চির দিকেও উঠেছে অভিযোগের আঙুল। নোবেলবিজয়ী হিসেবে যে সুনাম তিনি অর্জন করেছিলেন, সেটাও এখন মোটামুটি ভাবে বিলীন হয়ে গেছে।
বিজ্ঞাপন
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই সেটাকে উল্টে দিয়ে হয়তো আবারও বেসামরিক শাসন পুনর্বহাল করা যেত না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নিয়েছে? সাম্পতিক ঘটনাবলীর আলোকে সবচেয়ে দ্রুত যে উত্তর পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে- খুব বেশি কিছু করেনি।
সন্দেহ নেই, মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেই রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তবে সেখানেও খুব বেশি কিছু করছে না তারা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই উভয় সংকট শুধু যে মিয়ানমারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, বিষয়টি আসলে তেমন নয়। সারা বিশ্বের যেখানেই এই ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়, সেখানেই আন্তর্জাতিক সম্পদায় মূলত উভয় সংকটে পড়ে যায়। আর এতে সারা বিশ্বেই মূলত ‘খারাপ লোকগুলো’ জিতে যাচ্ছে।
এটা সত্য যে, সারা বিশ্বের সামনে যুক্তরাষ্ট্র একটি বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। গত নভেম্বরের নির্বাচনে স্পষ্টতই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়লাভ করেছিল অং সান সু চির দল। তবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান মিং অং হ্লেইং নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলেন। একের পর এক মিথ্যা দাবি করে এবং সংবিধানকে অবজ্ঞা করে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মঞ্চ প্রস্তুত করেন।
ঘটনাটি খুব পরিচিত লাগছে? সম্প্রতি এই একই ধরনের অভিযোগে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন বিচার শেষ হয়েছে। চূড়ান্ত বিচারে তাকে অভিশংসিত করা হয়নি। তবে এ বিষয়ে মোটামুটি সবাই একমত যে- যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কংগ্রেসে জো বাইডেনের বিজয় অনুমোদনের দিন সেখানে হামলা করতে সমর্থকদের ট্রাম্প উসকে দিয়েছিলেন। সেদিনের সেই ঘটনায় নিহত হয় পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাঁচজন। এই ঘটনার প্রায় দুই মাস আগে থেকে নির্বাচনে জালিয়াতির প্রমাণহীন মিথ্যা অভিযোগ করে আসছিলেন তিনি। তবে এই ঘটনার পর প্রতিনিধি পরিষদে দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসিত হয়েছেন ট্রাম্প। মেয়াদ শেষে বিদায় নিয়েছেন ক্ষমতা থেকেও।
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানবিরেধী বিক্ষোভ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। কিন্তু সেনাপ্রধান মিং অং হ্লেইংকে বিচার বা জবাবদিহিতার আওতায় আনবে কে? এটাও সত্য যে, চীন একটা কৌশলপূর্ণ খেলা খেলছে। অভ্যুত্থানকে তারা সমর্থন দেয়নি। তবে মিয়ানমারে থাকা চীনের বিশাল অংকের বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীলতা দরকার। বেইজিং কখনোই আর মিয়ানমারকে ২০১১ সাল পূর্ববর্তী সময়ের মতো অস্থিতিশীল অবস্থায় দেখতে চায় না। আর সামরিক সরকার যদি মিয়ানমারকে স্থিতিশীল রাখতে পারে; তাতে বেইজিংয়ের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলো যদি মিয়ানমারের ওপর আগের সকল শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা আবারও বলবৎ করে; তারপরও লাভটা চীনেরই হবে। এতে মিয়ানমারের সামরিক জেনারেলরা আরও বেশি করে চীনের শি জিনপিংয়ের ওপর নির্ভরশীল হবেন।
এছাড়া মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আনা একটি নিন্দা প্রস্তাব ইতোমধ্যেই আটকে দিয়েছে চীন। একইসঙ্গে চীনের সমর্থন না থাকায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কোনো যৌথ বিবৃতিও দিতে পারেনি। যৌথ বিবৃতি দিতে হলে চীনের সমর্থন দরকার। কারণ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার কারণে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে চীনের।
ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলিয়ট প্রাসে-ফ্রিম্যান ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, ‘গ্যাসলাইটিং বা পেছন থেকে নিয়ামক হিসেবে কাজ করার মতোই এই বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে জেনারেলদেরকে চীন স্পষ্ট করে না হলেও জোরালো সমর্থনের আভাস দিচ্ছে। চীন এমনভাবে বিষয়টিকে বিবেচনা করছে যেন, এটা পুরোপুরি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অন্তত চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এভাবেই বিষয়টিকে চিত্রিত করছে।’
দ্য ডিপ্লোম্যাটের লেখক এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সম্পাদক সেবাস্টিয়ান স্ট্রাংগিও বিবিসিকে বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারকে দূরে ঠেলে রাখার বিষয়টি থেকে কৌশলগত ভাবে সুযোগ নেয় চীন। তার মানে এই নয় যে, সেনা অভ্যুত্থানে চীন খুশি। এনএলডির সঙ্গে বেইজিংয়ের বেশ ভালো বোঝাপড়া ছিল এবং অং সান সু চির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চীন অনেক বিনিয়োগও করেছে। এখন আবার সামরিক বাহিনীর ফিরে আসার মানে হচ্ছে- চীনকে নতুন করে মিয়ানমারের এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কাজ করতে হবে। এরা ঐতিহাসিকভাবেই চীনের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান।’
অবশ্য গত কয়েকদিন ধরে চীন বলে আসছে, নিষেধাজ্ঞা কিংবা আন্তর্জাতিক চাপ মিয়ানমারের পুরো পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করবে।
মিয়ানমারে এই সামরিক অভ্যুত্থানকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রথম পরীক্ষা বলেও বিবেচনা করা হচ্ছে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর ওয়্যার কলেজ’র স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রফেসর এবং ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসি’র পরিচালক আজিম ইব্রাহিম অবশ্য দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে চুক্তি সম্ভব। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বেইজিংয়ের বাণিজ্য স্বার্থকে স্বীকৃতি দিতে পারে। এর বিনিময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য বেইজিংকে অনুরোধ জানাতে পারে বাইডেন প্রশাসন। একইসঙ্গে সামরিক সরকারকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের (বেইজিংপন্থী হলেও আপত্তি নেই) কাছে ক্ষমতা দেখতে চাইবে ওয়াশিংটন।’
ইব্রাহিমের মতে, চীন শুধু মুখে মুখেই গণতন্ত্রের কথা বলে। রোহিঙ্গা গণহত্যায় অংশ নেওয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেনারেলদেরও শাস্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছে জিন পিং প্রশাসন। এমনকি স্বয়ং প্রেসিডেন্ট জিন পিংয়ের বিরুদ্ধেও চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। সে বিষয়েও কোনো জবাবদিহিতা নেই। চীনের প্রেসডেন্টকে কে জবাবদিহিতার আওতায় আনবে?
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিষয়েও একই কথা বলা যায়। বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা চেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগের পরও কোনো জবাবদিহিতা নেই। তিনি যেন দায়মুক্তি পেয়ে গেছেন। এই ঘটনার পর সারা বিশ্বে হইচই শুরু হলেও পুতিন তাতে কান দেননি। এমনকি নাভালনির মুক্তির দাবিতে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে রাশিয়াজুড়ে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করলেও পুতিনের কাছে এর পাত্তা নেই। এমনকি তিনি রাশিয়ার বিদ্যমান আইনও মানেন না। অবশ্য তার এই ধৃষ্টতা নতুন কিছু নয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের মানুষের পক্ষে আছে। কিন্তু এরপরও সামরিক শাসনই যেন দেশটির মানুষের নিয়তি। আবার রাশিয়ার নাভালনি ইস্যুতে দেশটির বিরোধীপক্ষ আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিলেও কিছু করতে পারেনি। একই অবস্থা চীনের হংকং নীতি আর জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর নীতি নিয়েও।
দিন দিন বিশ্বব্যাপী অপরাধের দায়মুক্তি আর জবাবদিহি না দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। একনায়কতন্ত্র বা কতৃত্ববাদ এখন ‘নিউ নরমাল’। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গণমাধ্যম ইকোনোমিস্টের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ৮ দশমিক চার শতাংশ মানুষ পুরোপুরি কার্যকর ও সক্রিয় গণতান্ত্রিক শাসনের অধীনে বাস করে। যেখানে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ বাস করে একনায়ক সরকারের অধীনে। দিনে দিনে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, আর এই সংখ্যাটা বাড়ছেই।
বিশ্বব্যাপী সামরিক শাসক ও একনায়কদের সংশোধন করতে পশ্চিমা রাজনীতিকরা চেষ্টার কমতি না রাখলেও ‘জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকা লোকদের কাছে’ যুদ্ধে একসময় তাদের হার মানতেই হয়। তাই ‘মিয়ানমারকে কারা হারিয়েছে?’ এটা আজকের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে- ‘(মিয়ানমারে) পশ্চিমা দেশগুলো কী পরাজিত হয়েছে?’
টিএম