বিশ্বজুড়ে লোকজন যখন বড়দিন উদযাপনের আয়োজনে ব্যস্ত, সে সময় যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) স্বাক্ষর করেছে একটি সমঝোতা চুক্তি; যা উভয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণ করবে। ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য ইইউ ছাড়ার পর থেকে নতুন নিয়মগুলো কেমন হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করতে উভয়পক্ষই আলোচনা করে চলেছে।

বর্তমান বৈঠকের আয়োজন ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে, এরপর টেলিফোনে চলবে আলাপ-আলোচনা।

ব্রেক্সিট চুক্তির যা জানা দরকার

আসন্ন দিনগুলোতে যুক্তরাজ্য এবং ইইউয়ের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, কাজ এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে নতুন নিয়ম অনুসরণ করা হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে এই সমঝোতা চুক্তিতে। এক হাজার পৃষ্ঠার এই চুক্তির লিখিত রূপটি এখনও প্রকাশিত না হওয়ায় আসলে কী কী অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে সেখানে; তা অনুপুঙ্খভাবে বলা যাচ্ছে না।

এখন পর্যন্ত যা জানা যাচ্ছে

>>কেউই সীমান্ত অতিক্রম করে পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য বা ইইউ— কোনও পক্ষই শুল্ক আরোপ করবে না।

>>পারস্পরিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্যের সীমা (কোটা) নির্ধারণ করা হবে না।

ইউরোপীয় কমিশন প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন বলেছেন, প্রতিযোগিতামূলক সেসব নীতিসমূহ – যেগুলো একপক্ষকে অন্যায় সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে, সেগুলো আরও স্পষ্ট করা হবে।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি, নিরাপত্তা এবং পরিবহনসহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যুক্তরাজ্য এবং ইইউর মধ্যকার সহযোগিতামূলক সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। আমরা আরও জানি, ইউরোপীয় দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য ইইউ সম্প্রতি যে ‘ইরাসমাস এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’ চালু করতে যাচ্ছে, তাতে অংশগ্রহণ করছে না ব্রিটেন। 

চুক্তিতে পৌঁছাতে এত সময় লাগল কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর হলো- অনেকগুলো বিষয় অমীমাংসিত ছিল।

যুক্তরাজ্যের নিকটতম এবং সর্ববৃহৎ ব্যবসায়িক অংশীদার হলো ইইউ। চুক্তিতে পারস্পরিক বাণিজ্যের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। 

গত বছর ২০১৯ সালে ইইউ এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬৬৮ বিলিয়ন পাউন্ড।

যুক্তরাজ্য যখন ইইউর অন্তর্ভূক্ত ছিল, উভয়পক্ষের কোম্পানি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্রিটেনের সীমান্তজুড়ে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারত কোনও প্রকার শুল্ক ছাড়াই।

এই চুক্তি না হলে, ইইউ এবং ব্রিটেনের ব্যবসায়ীদের শুল্ক পরিশোধ করতে হতো, ফলে পণ্য বা সেবার মূল্য বেড়ে যেতো। এছাড়া সীমান্তে তল্লাশি এবং নজরদারির কারণে পণ্য সরবরাহে বিলম্বও ঘটত।

ভবিষ্যতে যা হবে

যদিও ইতোমধ্যে উভয়পক্ষের মধ্যে যে সমঝোতা ও চুক্তি সম্পাদন হয়েছে, তা এখন অপেক্ষমাণ রয়েছে আইনে পরিণত হওয়ার।

আর সেক্ষেত্রে প্রয়োজন যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর পার্লামেন্টে এই চুক্তির বিস্তারিত পর্যালোচনা।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ও ইইউর প্রেসিডেন্টের বৈঠকে অনেক আলোচনার পর চুক্তিটি সম্পাদিত হতে যে সময় লাগল, তাতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ ইউরোপের সবগুলো দেশের কাগজপত্রে সম্মতিসূচক স্বাক্ষরের সময় বের করা সম্ভব নয়।

যদিও এ কারণে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে এই চুক্তি কার্যকর হওয়ার পথে কোনও বাধা নেই, কিন্তু দাফতরিক দলিলের আকার পেতে এই চুক্তির আরও বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

অবশ্য যুক্তরাজ্য সরকার বলেছে, এই চুক্তির বিষয়ে ভোট দিতে আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশের এমপিদের তলব করা হয়েছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে এর বিশদ এবং বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়।

এক কথায় বলতে গেলে, যুক্তরাজ্য সরকার এবং ইইউ কর্তৃপক্ষ উভয়েই ভারমুক্ত হলেও আগামী ১ জানুয়ারি থেকে যে পরিবর্তনগুলো আসবে, তার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য জনগণ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট সময় পায়নি।

ইইউ এবং ব্রেক্সিট কী

ইইউ হলো ইউরোপের ২৭টি দেশের মধ্যকার একটি ঐক্য এবং সহযোগিতামূলক সংগঠন বা মঞ্চ। ইইউর নাগরিকরা সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত দেশগুলোতে অবাধে যাতায়াত, বসবাস ও পেশাগত কাজ করতে পারেন এবং পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত পণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও বিক্রয় করতে পারে।

এজন্য এসব দেশের সীমান্তে তাদের তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয় না, কর পরিশোধেরও প্রয়োজন পড়ে না। ব্রিটেন হলো প্রথম ইউরোপীয় দেশ, যারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করেছে; ইইউ থেকে ব্রিটেনের এই বিচ্ছেদকে বলা হয় ব্রেক্সিট অর্থাৎ ব্রিটিশ এক্সিট।

ব্রিটেন ইইউর সদস্য হিসেবে থাকবে কিনা—  এ বিষয়ে জনগণের রায় জানতে ২০১৬ সালে গণভোটের ডাক দেয় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ৪৮ শতাংশ জনগণ ভোট দেয় ইইউয়ের সদস্যপদ বজায় রাখার পক্ষে, অন্যদিকে ৫২ শতাংশ ভোট পড়ে বিপক্ষে।

 সংখ্যাগরিষ্ঠের মত আমলে নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে যুক্তরাজ্য। ব্রেক্সিটের সুবাদে গত কয়েক বছরে অবশ্য অনেকগুলো নতুন শব্দ বা বাক্যাংশ অন্তর্ভূক্ত হয়েছে মানুষের প্রতিদিনের রুটিনে। যদিও সবসময় সেগুলো ব্যবহার করা হয় না, কিন্তু রাজনীতিবিদরা প্রায়ই করে থাকেন। এগুলোর কয়েকটি হলো—

>>ক্রান্তিকাল বা ট্রানজিশন পিরিয়ড: গত ১১ মাসের সময়সীমা ( যা ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে)। উভয়পক্ষের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমঝোতা ও চুক্তি সম্পাদনের জন্য এই সময়কালে যুক্তরাজ্য ইইউ এর নিয়ম মেনে চলেছে।

>>মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি: সম্প্রতি যে বিষয়টি নিয়ে সমঝোতা হলো ইইউ কর্তৃপক্ষ ও যুক্তরাজ্য সরকারের মধ্যে অর্থাৎ উভয়পক্ষের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের প্রসঙ্গে সম্মত হওয়া।

>>ডব্লিউটিও রুলস: যদি ইউরোপের কোনও দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক সম্পর্কে যেতে সম্মত না হয়, সেক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতি মেনে পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্যের পথ খোলা রয়েছে।

সূত্র: বিবিসি।

এসএমডব্লিউ/এসএস