গর্ভবতী স্কুলছাত্রী এবং কিশোরী মায়েদের স্কুলে যাওয়ার বিষয়ে তানজানিয়া সরকারের আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে সম্প্রতি দেশটির সরকারকে আদালত অব্দি টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশ্বে কয়েকটি দেশের মধ্যে পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজিনিয়া অন্যতম যেখানে এমন নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা হয়।    

একবছর আগের ডিসেম্বরে আফ্রিকার আরেক দেশ সিয়েরা লিওনের একটি আদালত দেশটির সরকারকে এই একই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আদেশ দেয়। এরপর পরিস্থিতি কতটা বদলেছে পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশে? 

মাস কয়েক আগে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল দেশটির ১৩ বছরের এক কিশোরী, যার নাম ফাতু (ছদ্মনাম)। এখন সে চারমাসের গর্ভবতী।   

এ বছরের আগ পর্যন্ত হলে ফাতুকে এতদিনে স্কুল ছেড়ে দিতে হতো এবং খুব সম্ভবত তাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু তেমনটা হয়নি। বরং সে এখনও স্কুলে যাচ্ছে এবং তার জীবনের লক্ষ্য বড় হয়ে সে নার্স হবে।   

মার্চে সিয়েরা লিওনের একটি আদালত গর্ভবতী মেয়েদের ও কিশোরী মায়েদের স্কুলে যাওয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তারও তিনমাস আগে ওই আইনকে বৈষম্যমূলক এবং শিশুদের শিক্ষার অধিকারের লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে রুল জারি করেছিল ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটসের (ইসিওডব্লিউএএস) আদালত; যা ওই অঞ্চলের শীর্ষ আদালত।  

কিশোরী গর্ভবতী সিয়েরা লিওনের দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। ২০১৩ সালে দেশটির ১৮ বছরের কম বয়সী কিশোরীদের ৩৫ শতাংশের বেশি সন্তানের মা হয়েছে। ২০১৪/১৫ সালের দিকে ওই অঞ্চলে এবোলা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। আর তখন কিশোরীদের সন্তান জন্ম দেওয়ার ওই হার কোনো কোনো অঞ্চলে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যায়। 

এবোলা মহামারির ধকল কাটিয়ে ওঠার সময়টাতে দেশটির সরকার গর্ভবতী মেয়েদের মূল ধারার স্কুলে যাওয়া ঠেকানোর নীতি হাতে নেয়। এর পেছনে যুক্তি ছিল- গর্ভবতী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া ঠেকানো না গেলে তা অন্য মেয়েদেরও একই কাজে উৎসাহিত করবে। সরকারি হিসেবে ২০১৫ সালে ৩ হাজার কিশোরী এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছিল, তবে কারো কারো হিসেবে ওই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।     

স্কুলে যাওয়ার পথ বন্ধ করা হলেও গর্ভবতী মেয়েদের ও কিশোরী মায়েদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়। সেখানে সপ্তাহে তিনদিন তাদের চারটি বিষয়ে পড়ানো হতো। ইসিওডব্লিউএএস গতবছরের ডিসেম্বরে ওই ব্যবস্থাকেও বৈষম্যমূলক আখ্যায়িত করে তা বিলুপ্তির নির্দেশ দেয়। 

গর্ভবতী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া ঠেকানোর অর্থ হলো তাদের উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বোর্ড পরীক্ষার মতো পরীক্ষাগুলোতে বসতে বাধা দেওয়া। ওই সব পরীক্ষা ছাড়া তারা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা চাকরির পরীক্ষাগুলোতে বসতে পারবে না।  

সরকারি ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সিয়েরা লিওন সরকারকে আদালতে টেনে নিয়ে গেছে যে সংস্থাগুলো তার একটি উইমেন এগেইনস্ট ভায়োলেন্স অ্যান্ড এক্সপ্লোয়েটেশন ইন সিয়েরা লিওন (ওয়েভস)। এ সংস্থার একজন কর্মকর্তা হান্নাহ ফাতমাতা ইয়াম্বাসু বলছেন, ওই মেয়েগুলোকে আমরা ব্যর্থ করিয়েছি। 

‘সবাই এবোলা কাটিয়ে ওঠা নিয়েই ভাবছিল। এই সময়ে কিশোরীদের ওপর যেসব সহিংসতা ঘটছিল তা আমরা কেউ খেয়াল করিনি।  কিন্তু আমরা শিক্ষা পেয়েছি। এবার আমরা মেয়েদের বলেছি, এবার আমরা তাদের কথা ভুলে যাবো না।’  

মানুষের মন-মানসিকতায় পরিরবর্তন 
বড় পরিসরে এবারে পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা। কারণ, সরকার সমস্যা চিহ্নিত করেছে।  নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে গত বছর প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস মাদা বায়ো জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। 

মার্চে গর্ভবতী মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সিয়েরা লিওনের শিক্ষামন্ত্রী ডেভিড মইনিনা সেনগেহ বলেছিলেন, এটা নতুন একটা শুরু। যেখানে সব শিশু সর্বজনীন শিক্ষার সুযোগ ও সহায়তা পাবে কোনো বৈষম্য ছাড়া। 

এর মধ্যে দিয়েই প্রথমবারের মতো পরীক্ষায় বসতে পেরেছে ১০০০ মেয়ে।  

তবে হান্নাহ ও ওয়েভসের মতো সংস্থাগুলোর জন্য যুদ্ধটা কেবল দেশটির রাজনৈতিক নেতাদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনা নয়, বরং দেশটির বৃহত্তম সম্প্রদায়ের মধ্যেও এ পরিবর্তন আনতে হবে। 

গর্ভবতী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্তটি অনেকেরই আবার বেশি পছন্দ হয়েছিল। মার্চে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়ার পর এক নারী বিবিসিকে বলেছিলেন, স্কুলে তিনি তার মেয়েকে কোনো গর্ভবতী মেয়ের পাশে বসতে দেবেন না।  

ফাতুর বাবা-মা ফ্রান্সিস ও আইয়ি খুশি কারণ, গর্ভাবস্থায়ই তাদের মেয়ে স্কুল চালিয়ে যেতে পারবে। তারা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এই বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে এবং তারা এখন ফাতুকে শিক্ষিত দেখতে চান, যেখানে একবছর আগেও তাদের চাওয়া ছিল কেবল মেয়েটার একটা বিয়ে দিতে পারা। 

কিন্তু তাদের আশপাশের সবাই ফাতুর এই স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারটিকে ভালো চোখে নেয়নি, এ নিয়ে মিশ্র একটা প্রতিক্রিয়া রয়েছে। 

বিবিসিকে তারা বলছেন, আমাদের মেয়েটার ওপর চালানো নির্যাতনের কথা ওয়েভস ও পুলিশকে জানানোর বিষয়টি কেউ কেউ ভালোভাবেই নিয়েছেন। কিন্তু এই অবস্থা নিয়ে আমার মেয়ে স্কুলে যাবে- এটা অনেকে ভালো চোখে দেখছে না।    

ফাতু নিজেই বলছে যে, তার জন্য এখন স্কুল চালানোটা একটু কঠিনই হয়ে গেছে। সে এখন অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায় আর ক্লাসে লম্বা সময় বসে থাকাটাও তার জন্য সুবিধাজনক নয়। তাই সে পুরোপুরি ক্লাস করাটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। 

বন্ধুরা এখন আর খেলতে নিতে চায় না তাকে, কারণ তারা মনে করে সে ভালোভাবে খেলতে পারবে না। 

সেই সঙ্গে সে এও বলছে যে, বাচ্চাটা হয়ে গেলে আমি আবার স্কুলে যেতে চাই। কারণ, আমি স্কুল শেষ করতে চাই ও শিক্ষিত হতে চাই। আমি বড় হয়ে নার্স হতে চাই। আমি চাই যখন আমার বয়স হয়ে যাবে তখন যেন অনেক মেয়ে আমার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারে ও আমি যেন নারীদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারি। 

ফাতুর স্কুলই বলছে, বাস্তবিক এবং মানসিক দুভাবেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্তটা ছিল অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত। প্রধান শিক্ষক নিজেই দেখেছেন ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের অনেকে তার সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করে এবং ক্লাসে অনেক শিক্ষকও তার প্রতি অযৌক্তিক আচরণ করেন। 

আবার গর্ভবতী হয়ে পড়া অনেকের আচরণের নেতিবাচক একটা দিকও তুলে ধরেছে ফাতু। সে বলছে, গর্ভবতী হয়ে যে মেয়েরা স্কুলে ফেরার সুযোগ পেয়েছে তাদের আচরণটা অনেক সময় বড়দের মতো হচ্ছে। আবার অনেকে ক্ষেত্রে তারা শিক্ষকদের তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেখাতে অনীহা দেখাচ্ছে। 

তানজানিয়ার কঠোর অবস্থান 
ইকুয়ালিটি নাও নামে যে সংস্থাটি সিয়েরা লিওনে এই মামলার জন্য এগিয়ে এসেছিল, তারা এখন তানজানিয়ায় তাদের যুদ্ধ শুরু করেছে। পূর্ব আফ্রিকার এই দেশ থেকে একই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে আফ্রিকান কোর্ট অন হিউম্যান অ্যান্ড পিপলস রাইটসে তারা গেল মাসে একটি মামলা ঠুকেছে। 

এই সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলছেন, কিন্তু সিয়েরা লিওনের চেয়ে তানজানিয়ার পরিস্থিতি ভিন্ন এবং এই মামলায় একই ধরনের রায় যে পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। 

তিনি বলছেন, সিয়েরা লিওনে ওই নীতি এসেছিল আগের সরকারগুলোর হাত ধরে এবং বর্তমান নেতাদের এটা নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু অন্যান্য দেশগুলো যেখানে এই নিষেধাজ্ঞা থেকে সরে আসছে সেখানে তানজানিয়া নতুন করে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।   

এক্ষেত্রে মূলত ২০১৭ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলির দেয়া একটি বক্তব্যকে ইঙ্গিত করছেন তিনি।  প্রেসিডেন্ট জন বলেছিলেন, আমি যতদিন প্রেসিডেন্ট আছি কোনো গর্ভবতী মেয়েকে স্কুলে ফিরতে দেবো না। পেটে বাচ্চা এসেছে, তো তোমাকে এবার থামতে হবে। 

এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে একসময় দেখা যাবে স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানের সব মেয়ে গর্ভবতী হয়ে যাবে- এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার জন্য তিনি মানুষের প্রশংসাও পেয়েছিলেন। এছাড়া অল্পবয়সী কোনো মেয়ে গর্ভবতী হলে তার জন্য দায়ী পুরুষের ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।

কিশোরী গর্ভবতীর সংখ্যায় ওপরের তালিকায় থাকা দেশগুলোর একটি তানজানিয়া।   

ইউএনএফপিএ-এর একটি হিসাব অনুযায়ী, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রতি চারজন কিশোরীর একজন ২০১৬ সালে হয় মা হয়েছে নয়তো গর্ভবতী হয়েছে। একইবছরের সরকারি এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশটির ৩৬ শতাংশ মেয়েরই ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে হয়ে যায়, ছেলেদের ক্ষেত্রে এই হার ৫ শতাংশ।   

এ বছর তানজানিয়াকে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, প্রতিবছর যে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পরে তার অর্ধেকই মেয়ে শিক্ষার্থী, এর মধ্যে ৫ হাজার ৫০০ জন মেয়ে শিক্ষার্থী স্কুল ছাড়ে গর্ভবতী হওয়ার কারণে। 
তানজানিয়া এ সমস্যা চিহ্নিত করেছে এবং শিক্ষার্থীদের যৌনতা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত শিক্ষা বিষয়ে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া ঋণের আওতায় আরও বিস্তৃত কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে। 

কিন্তু তাতে যে দেশটির সব মেয়ে শিক্ষার সুযোগ পেয়ে যাবে সে নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। 

সংস্থার একজন কর্মকর্তা গিতাও বলছেন, গর্ভবতী মেয়েরা স্কুলে গেলে অন্য মেয়েরাও এ বিষয়ে উৎসাহিত হবে, দেশটিতে বিদ্যমান এমন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত নন তিনি। তিনি মনে করেন, বরং এটা অন্য মেয়েদের অল্প বয়সে গর্ভবতী হওয়ার নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে ভাবতে শেখাবে। 

তার এই বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণও পাওয়া যায়। ১৯৯৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে গর্ভবতী মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া নয়টি আফ্রিকান দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট বলছে, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দুই বছরের মধ্যে ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সী মেয়েদের গর্ভবতী হওয়ার হার কমেছে। 

আর বিশ্লেষকরা বলছেন, মেয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া বন্ধের আর্থিক ক্ষতি কেবল ওই মেয়ে এবং তার পরিবারের মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকে না। ইউএনএফপিএ-এর এক প্রতিবেদন অনুসারে কিশোরী মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার কারণে তানজানিয়া প্রায় ৫.২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো ক্ষতি হয়। 

ইকুয়ালিটি নাও সংস্থাটি বলছে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে তারা তিন বছরেরও বেশি সময় তানজানিয়া সরকারের সাথে কাজ করছে কিন্তু  এতে তারা এখনও সফলতার মুখে দেখেনি। আফ্রিকান আদালতে দায়ের করা মামলাটি তাদের সর্বশেষ পদক্ষেপ।   

এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তবে সেখানকার মেয়েদের স্বার্থে আমার চাই একটা সমাধানে পৌঁছাতে যেন খুব বেশি সময় না লাগে। 

এনএফ