নেপালে সংকটে চীন ও ভারতের লাভ-ক্ষতির সমীকরণ
পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার প্রতিবাদে নতুন বছরের প্রথম দিনে কাঠমান্ডুর রাস্তায় বিক্ষোভ
দলের ভেতর থেকেই অনাস্থা প্রস্তাব আসতে পারে অনুমান করে গত ২০ ডিসেম্বর ২৭৫ আসনের পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচন ঘোষণা করেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি। আর এতেই দেশটির বিরোধীরা পথে নেমে বিক্ষোভ করছেন। বিকল্প জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে পারলে পার্লামেন্ট ভাঙার বিধান নেই নেপালের সংবিধানে। এই যুক্তিতে ওলির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে বেশ কয়েকটি মামলা করা হয়েছে।
এদিকে নেপালে হঠাৎ পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়ার সিদ্ধান্তের বৈধতা নির্ধারণে বুধবার (৬ জানুয়ারি) দেশটির সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে ১২টির মত আবেদন হয়েছে। আবেদনগুলোতে প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে সংশোধিত সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ধারণা করা হচ্ছে নেপালের সুপ্রিম কোর্ট হয়তো সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত দিতে পারে। কিন্তু আদালতের রায়ে কি সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে?
অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করছেন, নেপালে নতুন একটি রাজনৈতিক সঙ্কটের যে সূচনা হয়েছে, আদালতের রায়ে তার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বিজ্ঞাপন
কাঠমান্ডুতে সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কমল দেব ভট্টরাই মনে করেন, ২০১৭ সাল থেকে গত তিন বছর ধরে নেপালের সরকার এবং রাজনীতিতে বিরল যে স্থিতিশীলতা চলছিল সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার সিদ্ধান্তে তা চরম হুমকিতে পড়েছে।
তিনি বলেন,‘ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে এখনই তা বলা মুশকিল, কিন্তু নেপাল যে আবারও নতুন একটি অস্থিতিশীল রাজনীতির আবর্তে পড়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আদালত যে রায়ই দিক না কেন তাতে এই সঙ্কটের সুরাহা হবে বলে মনে হয় না।’
কমল দেব ভট্টরাই আরও বলেন, সুপ্রিম কোর্ট যদি কে পি ওলির সিদ্ধান্তের পক্ষে রায় দেয়, তাহলে তার নিজের দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বড় একটি অংশ এবং প্রধান বিরোধী দলগুলো হয়তো মধ্যবর্তী নির্বাচন বয়কট করবে। আর যদি সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়, তাহলে ওলির বিরুদ্ধে তার নিজের দলের একটি অংশই হয়তো অনাস্থা প্রস্তাব এনে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করবে।
সুতরাং রায় যেটাই হোক হোক না কেন সঙ্কট তাতে মিটবে বলে মনে করেন না তিনি।
নেপালের নতুন এই রাজনৈতিক সঙ্কটের মূলে রয়েছে ক্ষমতাসীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব। সাম্প্রতিক সময়ে এই দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে।
কমল দেব ভট্টরাই বলেন, আপনি এখন পরিষ্কার বলতে পারেন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে গেছে। মীমাংসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে সঙ্কটের আশু মীমাংসাও এখন সম্ভব নয়।
নেপালের প্রধান যে দুই মাওবাদী দল সশস্ত্র আন্দোলন করে রাজতন্ত্র উৎখাত করেছিল এবং পরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অভিন্ন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করে, তারাই এখন পরস্পরের প্রধান বৈরি হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে কে পি ওলির দল সিপিএন-ইউএমএল এবং পুস্পা প্রচন্দ কমল দাহালের সিপিএন (মাওয়িস্ট সেন্টার) একটি নির্বাচনী মোর্চা তৈরি করে।
২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে ওলির দল সবচেয়ে বেশি ১২১টি আসন জিতলে পুষ্পা দাহালের সমর্থন নিয়ে তিনি সরকার গঠন করেন। পরপরই মূলত চীনের চেষ্টায় এই দুই মাওবাদী দল একত্রিত হয়ে নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিএন) নামে অভিন্ন দল তৈরি করে।
দলে এবং সরকারে তাদের ক্ষমতা সমানভাবে ভাগাভাগি হবে তখন ওলি ও দাহালের মধ্যে চুক্তি হয়। কিন্তু ওলি তার কথা রাখেননি এবং দলে ও সরকারে একচ্ছত্র প্রাধান্য তৈরির চেষ্টা করছেন বলে বেশ কিছুদিন ধরে অভিযোগ করছেন দাহাল।
অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, দাহাল ও তার অনুগতরা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই প্রধানমন্ত্রী ওলি সংসদ ভেঙ্গে দিয়েছেন।
সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার বিরুদ্ধে গত দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানী কাঠমান্ডু ছাড়াও নেপালের অন্যত্র হাজার হাজার মানুষ করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ তোয়াক্কা না করে মিছিল, সমাবেশ করছে।
রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনা বা নেপালকে আবারও হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার পক্ষের দল এবং গোষ্ঠীগুলোও এই সুযোগে সরব হয়েছে। তারাও এখন নতুন করে বিক্ষোভ জমায়েত করছে।
চীনের উদ্বেগ
নেপালে এই অস্থিরতার দিকে নেপালিদের যতটা নজর, তাদের যতটা উদ্বেগ, প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র চীন এবং ভারতের নজর-আগ্রহ তার বেশি ছাড়া কম নয়।
কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, মূলত তিব্বতের কারণে চীনের কাছে নেপালের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। ভারতের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বৈরিতার প্রেক্ষাপটে সেই গুরুত্ব বেড়েছে।
পঞ্চাশের দশকের পর তিব্বতি বিদ্রোহীরা নেপালে আশ্রয় নিয়ে বহু বছর ধরে চীনবিরোধী তৎপরতা চালিয়েছে। চীন কোনোভাবেই চায়না নেপালের ভূমি আর কখনও চীনবিরোধী তৎপরতার জন্য ব্যবহার করা হোক।
সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন,‘গত বছরগুলোতে চীন যেভাবে নেপালে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে, কোনোভাবেই তা তারা নষ্ট করতে তারা চাইবে না। নেপালে নতুন অবকাঠামোর প্রায় সবগুলোই এখন চীনের পয়সায় হচ্ছে।’
সে কারণেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী উপমন্ত্রী গুও ইঝাও গত ২৭ ডিসেম্বর কাঠমান্ডুতে এসে কমিউনিস্ট পার্টির দুই বিরোধীপক্ষের মধ্যে মীমাংসার একটি চেষ্টা করেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এই নেতাই ২০১৭ সালে নেপালের মাওবাদী দুই দলের মধ্যে ঐক্য তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু এ দফায় বিরোধ মেটাতে কোনো সাফল্য তিনি যে পেয়েছেন তার কোনো ইঙ্গিত নেই।
কমল দেব ভট্টরাই বলেন, কমিউনিস্ট পার্টির দুই প্রধান নেতার মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে তা সহজে সমাধান হবে না।
ড. মাহমুদ আলী মনে করেন, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টিতে এই ভাঙন চীনের জন্য বড় একটি ধাক্কা।
‘চীনই দুটো মাওবাদী দলকে একত্রিত করে ক্ষমতা নিতে সাহায্য করেছিল। এটা চীনের জন্য বড় একটি রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সাফল্য ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা নেওয়ায় গত কয়েক বছরে নেপালে প্রাধান্য বিস্তারে অনেক সুবিধা চীনের হয়েছে। দলে ভাঙনে সেই সাফল্য অনেকটাই হুমকিতে পড়বে সন্দেহ নেই।’
ড. আলী বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা হারালে যে দল বা জোট পরবর্তীতে নেপালের ক্ষমতায় আসুক তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করবে চীন। চীনের সরকার এখন যতটা বাস্তববাদী ততটা আদর্শিক নয়। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় তারা যে কোনো সরকারের সঙ্গে সম্পর্কে প্রস্তুত। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও তারা সেটাই করছে।’
নেপালের নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে দিল্লিতে মোদি সরকার নিশ্চুপ, কিন্তু ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিতে ফাটলে ভারত যে খুশী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিরাপত্তা ছাড়াও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দিকে দিয়ে যে প্রতিবেশী দেশটির গুরুত্ব ভারতের কাছে অনেক, গত কয়েক বছরে তার সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই নষ্ট হয়েছে। একইসঙ্গে ভারতের বৈরি একটি দেশের সাথে নেপালের সম্পর্ক ক্রমে উষ্ণ হয়েছে।
দিল্লির জওহারলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. সঞ্জয় ভরদোয়াজ বলেন, ভারত মনে করে কে পি ওলির কমিউনিস্ট সরকারের কারণেই নেপালের সঙ্গে এই দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ওলি ২০১৫ সালে সীমান্ত অবরোধের সূত্র ধরে তখন থেকে নেপালে ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দিয়ে চলেছেন। সুতরাং ওলি ক্ষমতা হারালে এবং তার দলে ভাঙন হলে ভারত খুশি।
নেপালের নতুন যে মানচিত্র সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কে পি ওলির সরকার সেখানে ভারতনিয়ন্ত্রিত বেশ বড় একটি এলাকাকে নেপালের অংশ হিসাবে দেখানো হয়েছে। এ নিয়ে চরম নাখোশ ভারত।
ড. ভরদোয়াজ বলেন, ভারত চাইবে কমিউনিস্ট পার্টির বদলে নেপালি কংগ্রেসের মত গণতান্ত্রিক কোনো দল বা সমমনা দলগুলোর মোর্চা নেপালে ক্ষমতায় আসুক।
‘এমনকি প্রচন্দ কমিউনিস্ট হলেও ভারতের ব্যাপারে অনেক সহনশীল। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দুবার ভারত সফর করেছেন। আমি মনে করি ভারত বিশেষভাবে চায় ওলি যেন নেপালে ক্ষমতায় না থাকেন,’ তিনি বলেন।
তবে নেপালে কে পি ওলির সরকার ক্ষমতা হারালে বা কমিউনিস্ট ক্ষমতার বাইরে চলে গেলেও কি নেপাল থেকে চীনকে পাততাড়ি গোটাতে হবে?
কমল দেব ভট্টরাই বলেন, তেমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ যে এক নম্বর স্বার্থ তা নিয়ে নতুন সংবিধান তৈরির সময় থেকেই এক ধরনের ঐক্যমত্য নেপালের রাজনৈতিক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হয়েছে।
ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলেও সেই ঐক্যমত্য ভেঙ্গে পড়বে বলে তিনি মনে করেন না।
‘সে কারণেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি দল নেপালের প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলে গেছে। সন্দেহ নেই চীন নেপালের ক্ষমতায় কমিউনিস্টদের চায় এবং চাইবে, কিন্তু নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খারাপ - এ কথা বলা যাবে না। ’
কাঠমান্ডুর ক্ষমতায় এখন যারাই আসুন, চীনের লম্বা পকেট অগ্রাহ্য করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম