করেনাভাইরাসের চলমান মহামারিতে বিপর্যস্ত এশিয়ার হাঁস-মুরগি চাষীরা গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বার্ড ফ্লু প্রাদুর্ভাবের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে জাপান থেকে ভারতে; যার তীব্র প্রভাব পড়েছে হাঁস-মুরগির বাজারে। 

গত নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ২ কোটির বেশি মুরগি ধ্বংস করা হয়েছে। উচ্চ সংক্রমিত এইচ৫এন৮ ভাইরাস গত সপ্তাহে পৌঁছে গেছে জাপানেও। বিশ্বে মুরগি উৎপাদনে ৬ নম্বরে রয়েছে ভারত; দেশটির অন্তত ১০টি রাজ্যে ইতোমধ্যে বার্ড ফ্লু শনাক্ত হয়েছে। এই প্রাদুর্ভাব কমার কোনও লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না।

বছরের এই সময় পরিযায়ী পাখির অবাধ বিচরণের কারণে এশিয়ায় বার্ড ফ্লু ভাইরাসের সংক্রমণ খুবই সাধারণ। কিন্তু ভাইরাসটির নতুন একটি ধরন বন্য পাখিদের শরীরে বেশি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। পরিযায়ী পাখির অবাধ বিচরণের ফলে এই অঞ্চল বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভারতে এটিই সর্বকালের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সাবেক উপদেষ্টা এবং ভারতের প্রাণী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মহিন্দর ওবেরই

‌‘এই রোগটি প্রচুর কাঁক এবং হাসের মধ্যে রয়েছে। কাঁকের শরীরে এই রোগটির কারণে লোকজন ভীত হয়ে পড়েছে। তারা জানেন, কাঁক অনেক দূর পর্যন্ত উড়তে পারে। যে কারণে লোকজন মনে করছেন, এটি তাদের হাঁস-মুরগি এমনকি মানুষকেও আক্রান্ত করতে পারে।’

ইউরোপের দেশগুলো গত কয়েক বছর ধরে বার্ড ফ্লু ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ভুগছে; এর মাঝেই এশিয়ায় এই প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির মাঝে এশিয়ার এই প্রাদুর্ভাব চিন্তায় ফেলছে অন্যান্য অঞ্চলকেও। কিছু কিছু এলাকায় বার্ড ফ্লুর মিথ্যা খবরে হাঁস-মুরগির দাম পড়ে গেছে। এর ফলে হাঁস-মুরগির খামারিরাও চরম সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছেন।

ভারতের বাজারে ইতোমধ্যে প্রতি কেজি মুরগির দাম ৫৮ রুপিতে নেমেছে; যা উৎপাদন খরচের চেয়েও অনেক কম।

বার্ড ফ্লু ভাইরাস আতঙ্কে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় গত সপ্তাহে ভারতের বাজারে মুরগির দাম প্রায় এক তৃতীয়াংশ পড়ে যায়। আর এই চিত্র দেখা গেছে করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকে। এশিয়ায় মাংসের চাহিদার বেশিরভাগ অংশের যোগানের উৎস হাঁস-মুরগি।

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নাশিকের পোল্ট্রি কোম্পানি আনন্দ এগ্রো গ্রুপের চেয়ারম্যান উদ্ধব আহিরে বলেন, হাঁস-মুরগি খাওয়ার মাধ্যমে মানুষ বার্ড ফ্লুতে সংক্রমিত হন না। এইচ৫এন৮ ভাইরাস মানুষকে সংক্রমিত করেছে— এখন পর্যন্ত এমন কোনও ঘটনা জানা যায়নি। কিন্তু তারপরও ভোক্তারা আতঙ্কিত।  

দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের পোল্ট্রি খাতে এখনও কোনও প্রভাব দেখা যায়নি বলে দেশ দু’টির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বরং এই দুই দেশে লকডাউনের সময় বাড়িতে রান্না করা খাবারের জন্য মুরগির মাংসের তীব্র চাহিদা দামের ওপর আরও বেশি প্রভাব ফেলছে।

ভাইরাসের বিবর্তন

সাম্প্রতিক বার্ড ফ্লু ভাইরাসের দ্রুত এবং ব্যাপক ভৌগলিক বিস্তারের কারণে ২০০০ সালের গোড়ার দিকের প্রাদুর্ভাবের পর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে এশিয়া। জাপানের রাজধানী টোকিওর কাছের শহর চিবাতে বার্ড ফ্লুর প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার দুই মাস প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরের কিয়ুশি দ্বীপের মিয়াজাকিতে এই ভাইরাস পৌঁছে গেছে। সেখানে এখনও নতুন নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে।

জাপানের কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেছেন, আগামী মার্চ পর্যন্ত পরিযায়ী পাখির বিচরণের সময় থাকায় আমরা এখনই এই ভাইরাসের বিস্তারের ঝুঁকির শেষ বলতে পারছি না। এমনকি কিছু কিছু অঞ্চলে এপ্রিল পর্যন্ত পরিযায়ী পাখির বিচরণ থাকে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এমারজেন্সি সেন্টার ফর ট্রান্সবাউন্ডারি এনিম্যাল ডিজিজেসের (ইসিটিএডি) প্রধান ফিলিপ ক্লায়েস বলেন, ২০১৯ সালে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের সঙ্গে এবারে জাপান এবং কোরিয়ায় শনাক্ত হওয়া এইচ৫এন৮ ভাইরাসের খুব মিল রয়েছে; যা ২০১৪ সালে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাস থেকে রূপ বদল করেছিল।

২০২০ সালের শেষের দিকে ইউরোপে এই ভাইরাসের নতুন একটি ধরন ছড়িয়ে পড়লে তা মারাত্মক ক্ষতি করে। ব্রিটেনের পিরব্রাইট ইনস্টিটিউটের ইনফ্লুয়েঞ্জা বিশেষজ্ঞ হলি শেল্টন বলেন, বার্ড ফ্লুর নতুন ধরনগুলো বেশি ক্ষতিকর। বন্য পাখির ক্ষেত্রে এগুলো আরও বেশি আগ্রাসী।

তিনি বলেন, এটা বেশ পরিষ্কার যে, বন্য পাখিকূলের মাঝে এই ভাইরাসটি জেঁকে বসেছে। আর এ কারণে এই ভাইরাস এখন পোল্ট্রি শিল্পে ছড়িয়ে পড়ার বড় শঙ্কা রয়েছে।

অন্য কোনও ভাইরাস প্রতিস্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত এই ভাইরাসের বিস্তার অব্যাহত থাকবে।

ব্রিটেনের পিরব্রাইট ইনস্টিটিউটের ইনফ্লুয়েঞ্জা বিশেষজ্ঞ হলি শেল্টন

চীনে পোল্ট্রি শিল্পে বাধ্যতামূলক টিকাদানের কড়াকড়ি থাকায় এই অঞ্চলের শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশটি এখনও বার্ড ফ্লু থেকে সুরক্ষিত আছে। তবে দেশটিতে বার্ড ফ্লুতে বুনো হাঁসের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

ইন্দোনেশিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রাণী স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ফাদজার সাম্পিং জাতুর রাসসা বলেছেন, এশিয়ায় হাঁস-মুরগি উৎপাদনে দ্বিতীয় এই দেশটির বন্য পাখির জন্য একটি অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্ট রয়েছে। যে কারণে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বের যেসব দেশে ইতোমধ্যে এইচ৫এন৮ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে; সেসব দেশ থেকে জীবন্ত হাঁস-মুরগি ও পাখি আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ইন্দোনেশিয়া। ভাইরাস আগাম শনাক্তের জন্য নজরদারি ব্যবস্থা বসানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

পরিযায়ী পাখির বিচরণের প্রধান কোনও পথ না থাকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যেমন- ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি। কিন্তু মানুষ ও পণ্যের অবাধ চলাচল-পরিবহনে এসব দেশও ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

সূত্র : রয়টার্স।

এসএস