পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ার তাইগ্রে অঞ্চলে নারীদের প্রতি সেনাবাহিনীর সদস্যরা বর্বর নিপীড়ন চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অঞ্চলের চলমান সংঘাতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নারীদের ধরে নিয়ে স্বজনদের দিয়ে ধর্ষণ, হত্যা এমনকি নিজেরাও ধর্ষণ করছেন বলে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

ইথিওপিয়ার সরকারকে নারীদের প্রতি সেনাবাহিনীর এমন যৌন-সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। তাইগ্রে অঞ্চলের এক তরুণী কফি বিক্রেতা কীভাবে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, তার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তেজেকে নদীর ধারে পথ চলার সময় পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের থেকে তাকে আলাদা করে ফেলেন সেনাবাহিনীর এক সদস্য। 

ইথিওপিয়ার তাইগ্রে অঞ্চলের সংঘাত থেকে সুদানের হামদায়েত শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া ২৫ বছরের এই তরুণী বলেন, ‌‘সেনাসদস্য বলেন, আমি তোমাকে হত্যা অথবা ধর্ষণ করব। এর যেকোনও একটি বেছে নাও।’

গত বছরের ডিসেম্বরে সুদানের আশ্রয় শিবিরে পৌঁছানো ওই তরুণীকে সেবা দেয়া চিকিৎসক তেওয়াদ্রোস তেফেরা লিমিহ রয়টার্সকে বলেছেন, গর্ভধারণ এবং যৌন রোগ ঠেকাতে পিল দেন তিনি। একই সঙ্গে একজন মানসিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তাকে।

ওই তরুণী সুদানের রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছসেবী চিকিৎসক লিমিহকে বলেন, সেনাবাহিনীর ওই সদস্য অস্ত্রের মুখে তাকে ধর্ষণ করেন। ওই তরুণী সেনাসদস্যের কাছে কনডম আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, কনডমের দরকার কেন?

ইথিওপিয়ার এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থার পাঁচজন কর্মী বলেছেন, তাইগ্রে অঞ্চলে তারা একই ধরনের আরও বেশ কিছু নিপীড়নের অভিযোগ পেয়েছেন। চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘ এই অঞ্চলে নারীদের ওপর যৌন-সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের যৌন সহিংসতাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধির কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, যৌন সহিংসতার যেসব বীভৎস অভিযোগ পাওয়া গেছে তার মধ্যে পরিবারের সদস্যদের ধর্ষণে অথবা মৌলিক পণ্য-সামগ্রীর বিনিময়ে যৌনতায় লিপ্ত হতে বাধ্য করার অনেক ঘটনাও আছে।

ধর্ষণের এসব অভিযোগের ব্যাপারে রয়টার্স প্রশ্ন করলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনও জবাব দেয়নি দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের সরকার এবং সামরিক বাহিনী। তবে ইথিওপিয়া কর্তৃপক্ষ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করে ওই অঞ্চলের বিদ্রোহীগোষ্ঠী তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) দিকে আঙুল তুলেছে। ওই অঞ্চলের সাবেক ক্ষমতাসীন এই দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ উঠেছে। 

বিবৃতিতে জাতিসংঘের বিশেষ দূত গেরালডাইন বোয়েজিও বলেন, তাইগ্রে অঞ্চলের অস্থিতিশীলতায় জড়িত সব পক্ষকে যৌন সহিংসতার অপরাধের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। ইথিওপিয়ার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া নারী এবং কিশোরীদের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। 

দেশটির মেডিক্যাল সেন্টারগুলো অকাল গর্ভধারণ ও যৌন রোগের সংক্রমণ রোধের চিকিৎসা দিতে গিয়ে প্রচণ্ড চাপের মুখোমুখি হচ্ছে। 

তবে রয়টার্স ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে পারেনি। তাইগ্রে অঞ্চলে গণমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ। দাতা সংস্থাগুলো সেখানে পৌঁছানোর লড়াই করছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ওই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে।  

সামরিক পোষাকে নিপীড়ক 

রয়টার্সকে ২৫ বছর বয়সী ওই তরুণী বলেছেন, তাকে যিনি নিপীড়ন চালিয়েছেন; তিনি ইথিওপিয়ার ফেডারেল আর্মির ইউনিফর্ম পরিহিত ছিলেন। দাতব্য কর্মীরা বলেছেন, অন্যান্য নারীরা তাদের ওপর নিপীড়ন চালানোদের ইথিওপিয়ার আমহারা অঞ্চলের মিলিশিয়া যোদ্ধা এবং ইরিত্রিয়ার সৈন্য বলে দাবি করেছেন; এই দুই গোষ্ঠীই দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের সামরিক বাহিনীর মিত্র।

ধর্ষণের অভিযোগের ব্যাপারে আবির মুখপাত্র, তাইগ্রের অন্তর্বর্তী গভর্নর এবং আঞ্চলিক রাজধানী মেকেলের মেয়র, ইরিত্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীর মন্তব্য জানতে পারেনি রয়টার্স। বিদ্রোহীগোষ্ঠী তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেনি ব্রিটিশ এই বার্তাসংস্থা। 

আমহারার আঞ্চলিক মুখপাত্র গিজাচু মুলুনেহ টেলিফোনে রয়টার্সকে বলেছেন, ‌‘এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনও তথ্য নেই।’ ইথিওপিয়া এবং ইরিত্রিয়া কর্তৃপক্ষ তাইগ্রে অঞ্চলে ইরিত্রিয়ার সেনাবাহিনীর উপস্থিতির অভিযোগ অস্বীকার করেছে; যা কয়েক ডজন প্রত্যক্ষদর্শী, কূটনীতিক এবং ইথিওপিয়ার সাধারণ জনগণের স্বীকারোক্তির বিপরীত। 

কেন ধর্ষণ?

চলতি মাসের শুরুর দিকে ইথিওপিয়ার সরকারি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত মেকেলেতে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বৈঠকে দেশটির এক সেনা সদস্য শহরটির নিয়ন্ত্রণ ফেডারেল সৈন্যরা নেয়ার পরও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে বলে জানান।

ওই সৈন্য বলেন, ‌‘আমি গতকালও ক্ষুব্ধ ছিলাম। মেকেলে শহরে কেন একজন নারী ধর্ষিত হবে। যুদ্ধের সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকতো না। কিন্তু শহরজুড়ে স্থানীয় এবং ফেডারেল পুলিশ থাকার পরও এখনও নারীরা ধর্ষিত হচ্ছেন।’

ধর্ষণের ঘটনায় সৈন্যরা তদন্ত কিংবা বিচারের মুখোমুখি হবেন কিনা সেব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করেনি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।

শরণার্থী শিবিরের চিকিৎসক তেওয়াদ্রোস অন্য দু’টি ধর্ষণের ঘটনায় চিকিৎসা দিয়েছেন। তাকে একজন চিকিৎসক বলেছেন, তিনি তাইগ্রের রাওইয়ান শহর থেকে পালিয়েছেন। তিনি তিনজন নারীকে আমহারার বিশেষ বাহিনীর সদস্য বলে শনাক্ত করেছেন। ওই নারী বলেছেন, এক সেনাসদস্য দরজায় কড়া নাড়েন। অস্বীকৃতি জানালে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তার ওপর নিপীড়ন চালান।

সেনাসদস্যরা কীভাবে স্বামীকে হাঁটু গেঁড়ে বসে স্ত্রীকে ধর্ষিত হতে দেখেছেন সেবিষয়ে উকরো শহরের এক দাতব্য কর্মীকে বীভৎস অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। ওই নারীরা সেনাসদস্যদের ইরিত্রিয়ার বলে শনাক্ত করেছেন।

আদিগরাতের এক মেডিক্যাল কর্মী বলেছেন, একদল সৈন্যের হাতে ধর্ষণের শিকার ছয়জন নারীকে চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি। ধর্ষণের পর অন্য কারও কাছে সহায়তা না চাওয়ার নির্দেশ দেন ওই সৈন্যরা। 

এমনকি ধর্ষিত হওয়ার কয়েকদিন পর এই নারীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু তাদের চিকিৎসার জন্য কোনও ওষুধ ছিল না।

ওই মেডিক্যাল কর্মী বলছেন, ১৯ বছরের এক তরুণীকে ধর্ষণ বন্ধের অনুরোধ করায় এক ব্যক্তিকে বেধড়ক মারধর করেন সৈন্যরা। পরে দু’জনকে চিকিৎসা দেন আদিগরাতের এই মেডিক্যাল কর্মী। মেকেলের দাতব্যসংস্থা এলশাদাই বলেছে, ভূক্তভোগী ধর্ষিতদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ৫০ শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে।

এসএস