‘এক রাতে উল্টে গেল আমাদের পৃথিবী’
মিয়ানমারের জনগণ সোমবার সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই যে সংবাদটি শোনে, তা হলো- সামরিক বাহিনী দেশের ক্ষমতা দখল করেছে। রয়টার্সের সাবেক সাংবাদিক অ্যায় মিন থান্ট স্থানীয় সময় সকাল ৭ টায় এক টুইটবার্তায় লেখেন, ‘অভ্যুত্থান পরিস্থিতির মধ্যে এই টুইট করছি। এখন পর্যন্ত কোনও রক্তপাতের খবর পাওয়া না গেলেও দেশের মানুষদের মধ্যে একধরণের ভীতি কাজ করছে - এটা মোটামুটি স্পষ্ট। ভোর ৬ টা থেকে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনরা ক্রমাগত আমাকে ফোন করছেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ইন্টারনেট অনিয়মিত, অর্থাৎ আসা-যাওয়া করছে। আমার সিমকার্ডটিও কাজ করছে না।’
রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সোমবার ভোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে এক লিখিত বিবৃতিতে দেশবাসীকে এই সংবাদ জানায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সংবাদে বলা হয়, শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং অং সান সু চিসহ তার দল লীগ ফর ডেমোক্রেসির অন্যান্য সদস্যদের বন্দি করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
মিয়ানমারের প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের ২৫ বছর বয়স্ক এক নারী জানান, সোমবার ভোরবেলা তিনি যখন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, এক বন্ধুর কাছে সু চির বন্দি হওয়ার সংবাদ পান। এরপরই এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢোকেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই তরুণী বিবিসিকে বলেন, ‘এক রাতের মধ্যে দেশের শাসনব্যবস্থা উল্টে যাওয়া মিয়ানমারের জনগণের জন্য নতুন কিছু নয়, তবে কয়েকবছর আগে আমরা যে পর্যায় বা পরিস্থিতি ফেলে এসেছি, একরাতের মধ্যে আবার সেখানে ফিরে যাওয়া….এমনটা হবে হতে পারে তা সত্যিই আমাদের কল্পনায় আসেনি।’
বিজ্ঞাপন
‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকেই যে বিষয়টি আমার নজরে পড়ল, তারা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীদেরও গ্রেফতার করেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝে গেলাম- শুধু সু চি নয়, প্রাথমিকভাবে যাদেরকেই বিপক্ষের লোক বলে মনে করেছে সেনাবাহিনী, তাদের সবাইকে গণহারে বন্দি করা হচ্ছে।’
প্রাদেশিক আইনসভা সদস্য পা পা হানকে যখন গ্রেফতার করা হলো, তখন তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করেন তার স্বামী। রাজনৈতিক কর্মীদের, এমনটি চলচ্চিত্রকার মিন হিতিন কো কো গাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক বন্দিদের সহযোগিতাকারী সংগঠন এএপিপি বিবিসিকে জানিয়েছে, সোমবার সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতাকর্মীসহ সরকারের ৪২ কর্মকর্তা এবং ১৬ সমাজকর্মীকে আটক করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
এদিকে সোমবার মধ্যরাতের পর থেকেই মিয়ানমারের বিশাল এলাকাজুড়ে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে বিপর্যয় দেখা যায়।
রাজধানী নেপিদোর এক এনএলডি কর্মী বিবিসিকে বলেন, ‘সোমবার ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই যে সংবাদটি আমরা পাই- সেনাবাহিনী দেশের ক্ষমতা দখল করেছে এবং আমাদের বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধাকে বন্দি করেছে। তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য আমি লাগাতার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন বিচ্ছিন্ন থাকায় তা সম্ভব হয়নি। বাড়ির বাইরে বের হব সে উপায়ও ছিল না…. সড়কে, গলি-উপগলিতে সেনাবাহিনীর গাড়ি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল।’
রাজধানী নেপিদোতে ভোর ৪ টা থেকে বেলা ১১ টা পর্যন্ত ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ ছিল উল্লেখ করে নেপিদোর স্থানীয় সাংবাদিক কেপ ডায়মন্ড পরে এক টুইটারে টুইট করেন, ‘ফোন নেই, ওয়াইফাইও নেই।’
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমারের প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় সোমবার দিবাগত রাত ৩ টা থেকে সকাল ৮ টা পর্যন্ত ইন্টারনেটের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতার তুলনায় ৫০ শতাংশ নেমে গিয়েছিল নেটওয়ার্ক পরিস্থিতি। দুপুরের দিকে তা ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়।
২০১৩ সালে প্রণয়ন করা মিয়ানমারের সংবিধানের ৭৭ নম্বর ধারায় অবশ্য বলা হয়েছে, জাতীয় প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার এক্তিয়ার রাখে, তবে এই ধারাকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ বিষয়ক কালাকানুন বলে বহুবার সমালোচনা করেছেন মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনকর্মীরা।
ভীতির পরিবেশ মিয়ানমার জুড়ে
দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি,দমনপীড়ণ, অপুষ্টি, আঞ্চলিক নৃতাত্ত্বিক সংঘাতে ধুঁকতে থাকা মিয়ানমারে সোমাবারের সেনা অভ্যুত্থানে এখন পর্যন্ত রক্তপাতের কোনো তথ্য সামনে না এলেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশ ভীতির মধ্যে আছেন মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ।
ইয়াঙ্গুনের ব্যবসায়ী মা নান, ‘ আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে, এ পরিস্থিতে সামনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার মেয়েকে নিয়ে, তার স্কুলের পড়াশোনার পাট এখনও শেষ হয় নি। আমি দুশ্চিন্তিত মহামারি নিয়েও।’
ইয়াঙ্গুনের এক গৃহবধু থ্যান থ্যান নাইয়ুন্টও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বিবিসিকে বলেন, ‘ এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। মানুষ প্রতিবাদ করবেই। আমাদের আশা, সরকার সু চি এবং তার দলের সদস্যদের দ্রুত মুক্তি দেবে।’
ইয়াঙ্গুনের ২৫ বছর বয়সী ওই তরুণী বিবিসি কে বলেন, ‘ আমি এই বলে নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছি, যে আমরা অনেক বাজে সময় এর আগে অতিক্রম করে এসেছি, এবারও পারব…কিন্তু পাশাপাশি এটাও বারবার মনে উঁকি দিচ্ছে- কেন এমন দিন দেখতে হচ্ছে আমাদের।’
ব্রিটিশ নাগরিক মাইকেল গিলেনজেন তার বার্মিজ স্ত্রীর সঙ্গে ইয়াঙ্গুনে থাকেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘ আমার স্বপ্ন ছিল, একদিন গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের মানুষ সড়কে আনন্দমিছিল করবে, যেখানে অংশগ্রহণ করবে সেনা সদস্যরাও; কিন্তু মনে হচ্ছে, সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে; কোনও দিন পূরণ হবে না।’
এসএমডব্লিউ