মিয়ানমারের আধুনিক ইতিহাসে অং সান সু চি সব চেয়ে দৃশ্যমান ও একইসঙ্গে বিভাজনকারী একজন রাজনীতিক। তিনি একদিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, মানবাধিকার রক্ষার অক্লান্ত সৈনিক এবং গণতন্ত্রপন্থী বলে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আবার সেই সু চি-কেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সমর্থক হিসাবে দেখা গেছে। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও হত্যার সময়ও তিনি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন।

নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে স্থানীয় সময় সোমবার ভোরে সামরিক অভ্যুত্থান করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এরপর স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি’র সরকারকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। স্টেট কাউন্সিলারের পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, অং সান সু চিসহ আটক করা হয় অনেক শীর্ষ নেতাকে। এছাড়া একযোগে ২৪ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকেও অপসারণ করে অভ্যুত্থানকারীরা। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সামান্য আগে ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন সু চি-র জন্ম। বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক অং সানের মেয়ে তিনি। অং সানকে মিয়ানমারে জাতির পিতা বলা হয় এবং তিনি সামরিক বাহিনী তাতমাডোরও প্রতিষ্ঠাতা। সু চি-র যখন দুই বছর বয়স তখন তার বাবাকে হত্যা করা হয়। ১৯৪৭ সালে এই হত্যাকাণ্ডের পরের বছর, ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হয়।

সু চি বরাবর বলে এসেছেন, দেশের মানুষকে সেবা করা তার কর্তব্য। কিন্তু ১৯৮৮ সালে ৪৩ বছর বয়সে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। ততদিন তিনি শিক্ষাবিদ হিসাবে কাজ করেছেন, তার দুই ছেলেকে বড় করেছেন।

১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে সু চি-র রাজনৈতিক উত্থানের শুরু। সে সময় দেশে একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন চলছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে এমন কেউ ছিলেন না, যিনি সরকারবিরোধী সব পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ করে শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবেন। ছাত্ররা তখন নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সু চি-কে অনুরোধ করে এবং তিনিও বিনা দ্বিধায় রাজি হয়ে যান। এরপর ইয়াঙ্গুনে বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দির শ্বেডগন প্যাগোডার সামনে পাঁচ লাখ মানুষের সমাবেশে বক্তৃতা দিয়ে শুরু হয় সু চির রাজনৈতিক জীবন। সু চি তার বাবার উত্তরাধিকার নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সেই সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, এই আন্দোলন হলো দেশের স্বাধীনতার জন্য দ্বিতীয় সংগ্রাম।

এই বক্তৃতাই সু চি-কে বর্মার সব চেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতায় পরিণত করল। তবে এই আশার কিরণ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একমাসের মধ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেই আন্দোলন দমন করে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা নতুন করে নির্বাচন এবং বহুদলীয় শাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই আন্দোলনে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে সামরিক সরকার দেশের নাম বদল করে রাখে ‘মিয়ানমার’।

১৫ বছর ধরে গৃহবন্দি সু চি
সামরিক অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) প্রতিষ্ঠা করেন অং সান সু চি। ১৯৮৯ সালে ক্ষমতা দখলের সময় সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুতি ছিল পরের বছর অর্থ্যাৎ ১৯৯০ সালে নির্বাচন হবে। যথাসময়ে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সু চি-র দল পার্লামেন্টের পাঁচ ভাগের মধ্যে চার ভাগ আসনে জয়লাভ করে। দেশের অনেক মানুষ তখন মনে করেছিলেন, সু চি-র মধ্যে বুদ্ধের নৈতিক ধারণা ও আধ্যাত্মিকতার মিশেল রয়েছে। এটাই এনএলডি’র ওই বিপুল জয়ের অন্যতম কারণ ছিল।

তবে সেনা-শাসকরা নির্বাচনের ওই ফলাফল মেনে নেননি। নির্বাচিত সরবকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে সু চি-কে গৃহবন্দি করে তারা। ১৯৮৯ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ইয়াঙ্গুনে নিজের বাড়িতেই বন্দি অবস্থায় ছিলেন অং সান সু চি।

নোবেল শান্তি পুরস্কার
১৯৯০ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পান সু চি। তার পক্ষে তার ছেলেরা সেই পুরস্কার গ্রহণ করেন। তিনি সেই পুরস্কারের পুরো অর্থ (১৩ লাখ ডলার) মিয়ানমারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য দান করেন সু চি।

নোবেল পাওয়ার ফলে অং সান সু চি ও মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সু চি হয়ে উঠলেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতীক। গৃহবন্দি থাকার সময়ও মহাত্মা গান্ধীর অহিংস দর্শনে বিশ্বাস রেখেছেন সু চি। তিনি ভয়ের থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার কথা বলে গিয়েছেন। তারপরই তাকে নিয়ে বই লেখা হয়েছে, গান ও সিনেমা হয়েছে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ‘আইকন’।

কিন্তু এই সেলিব্রিটি স্ট্যাটাসের জন্য তার ক্ষতিও হয়েছে। তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছে সেনা শাসকরা। তার স্বামী মাইকেল অ্যারিস যখন ক্যান্সারে মৃতপ্রায়, তখন সামরিক শাসকরা সু চি-কে জানান, তিনি লন্ডন যেতে পারেন, কিন্তু আর মিয়ানমারে ফিরতে পারবেন না। সু চি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানতেন, একবার দেশের বাইরে গেলে তিনি সত্যিই আর ফিরতে পারবেন না। তাই তিনি দেশে থেকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন।

সংস্কার ও গণতন্ত্র ফিরে আসা
বহু বছর ধরে সু চি ও সেনার মধ্যে আলোচনা এগোয়নি। তিনি তার জনপ্রিয়তা ও নৈতিক মূলধনকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় রূপান্তরিত করতে পারেননি। আর সেনা-শাসকরাও তাদের ভাবমূর্তি বদলাতে পারেনি। শুরু থেকেই ক্ষমতালোভী একনায়ক হিসাবে দেখা হচ্ছিল সেনা শাসকদের।

২০১০ সালের নির্বাচনের পর সাবেক জেনারেল থেইন সেইন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হন এবং সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি মিয়ানমারের দরজাও বাইরের বিশ্বের জন্য খুলে দেন। এসময় সু চি মুক্তি পান। তার সামনে তখন বিকল্প ছিল, হয় সেনা যেটুকু রাজনৈতিক কাজ করার অনুমতি দিয়েছে, তা মেনে নিয়ে রাজনীতি করা অথবা অন্য পথে হাঁটা। তিনি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যারা সেনার বিরুদ্ধে লড়ছিলেন, এই সিদ্ধান্ত ছিল তাদের নীতির বিরুদ্ধে।

তার সমালোচকরা অবাক হয়ে গেছিলেন। সু চি তাদের বললেন, ‘মানুষ যখন মনে করে, আমি সবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছি, তখন আমিই অবাক হয়ে যাই। আমি রাজনীতি করতে এসেছি, মানবাধিকারের রক্ষক বা মানবাধিকারকর্মী হতে নয়।’

২০১৫ সালে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি বিপুলভাবে জয়ী হয়। সু চি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কারণ, তার স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ। সংবিধান অনুসারে তাই সু চির পক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি স্টেট কাউন্সিলার হন। এই পদটি বিশেষভাবে তার জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং এটা ছিল প্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদার।

সারা বিশ্ব জুড়ে মিডিয়া লিখল, অবশেষে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জয় হলো।

রোহিঙ্গা গণহত্যা ও সু চি-র ভাবমূর্তিতে ধাক্কা
তবে বিশ্বব্যাপী মিডিয়ার সেই উচ্ছ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মিয়ানমারে শুরু হয় জাতিগত বিরোধ ও উত্তেজনা। ২০১৬ সালের অক্টোবরে এবং ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে পশ্চিম রাখাইনে রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি তাতমাডো বাহিনীকে আক্রমণ করে। এরপরই রোহিঙ্গাদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। তারপরই রিপোর্ট আসে, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের একের পর এক গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে এবং তাদের হত্যা করেছে। জাতিসংঘের মতে, এটা হলো এথনিক ক্লিনসিং (জাতিগত নিধনযজ্ঞ)-এর টেক্সটবুক উদাহরণ।

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে সু চি-র প্রতিক্রিয়া আসে অনেক দেরিতে এবং সেটা ছিল বেশ সংযত প্রতিক্রিয়া। তার অনেক সমর্থক ও ভক্তরা এতে নিরাশ হন। কারণ, তিনি সেনাবাহিনীর অন্যায় ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের সরাসরি কোনো নিন্দা করেননি। বরং অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের পাশেই সু চি-কে থাকতে দেখা গেছে।

এরপর তাকে দেওয়া অনেক সম্মান ফিরিয়ে নেওয়ার হিড়িক পড়ে। ইতোপূর্বে সু চি-কে দেওয়া মানবাধিকারের পুরস্কারও ফিরিয়ে নেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

আর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যা সংক্রান্ত শুনানিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করে আবারও বিশ্বকে অবাক করে দেন অং সান সু চি। সেখানে তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের পুরো বা আংশিকভাবে মুছে ফেলার কোনো ইচ্ছে সেনাবাহিনীর ছিল না।

এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার ভাবমূর্তিতে বিশাল ধাক্কা লাগে। কিন্তু মিয়ানমারে উল্টো ফল হলো। অনেকে ‘মাদার সু’ ও সেনাবাহিনীর পাশে এসে দাঁড়ান।

২০২০ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি ও সু চি বিপুল জয় পান। ভোটে হেরে সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি অভিযোগ করে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। তারপরই সোমবার সেনা অভ্যুত্থান হয় দেশটিতে।

রাজনীতিতে সু চি-র জীবন বৈপরীত্যে ভরা। মাঝেমধ্যেই তাতে অবাক করা মোড় এসেছে, তিনি প্রত্যাশার উল্টো কাজ করেছেন। এটা বলাই যায়, যে প্রধান ঘটনা তার জীবন গড়ে দিয়েছে, তার ওপর সু চি-র কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সোমবারের সেনা অভ্যুত্থানের পরেও ভবিষ্যতে সু চি কী ভূমিকা পালন করবেন, সেটাও সম্ভবত তার হাতে নেই।

সূত্র: ডয়চে ভেলে

টিএম