চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তৈরি বন্দিশিবিরে সংখ্যালঘু উইঘুরসহ অন্যান্য মুসলিম নারীরা পরিকল্পিতভাবে গণধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নির্যাতনের শিকার ওইসব নারীদের একজন তুরসুনে জিয়াউদুন। বিবিসিকে তিনি তার নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।

তুরসুনে জিয়াউদুন বলেন, ‘তখন কোনো মহামারি চলছিল না। কিন্তু ওই লোকগুলো সবসময়ই মুখোশ পরে থাকতো। তারা স্যুট পরতো, পুলিশের পোশাক নয়। কখনও কখনও তারা আসতো মধ্যরাতের পরে। সেলের মধ্যে এসে তারা ইচ্ছেমত কোনো একজন নারীকে বেছে নিতো। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো করিডোরের আরেক মাথায় ‘কালো ঘর’ বলে একটি কক্ষে। ওই ঘরটিতে নজরদারির জন্য কোনো ক্যামেরা ছিল না।’

জিয়াউদুন বলেন, বেশ কয়েক রাতে তাকে এভাবেই নিয়ে গিয়েছিল ওরা। তিনি বলেন, ‘এটি আমার জীবনে এমন এক কলঙ্ক- যা আমি কখনও ভুলতে পারবো না। এসব কথা আমার মুখ দিয়ে বের হোক - এটাও আমি কখনও চাইনি।’

জিনজিয়াং প্রদেশে চীনের গোপন বন্দীশিবিরগুলোর একটিতে তুরসুনে জিয়াউদুন বাস করেছেন মোট ৯ মাস। তিনি বলছেন, ওই সেলগুলো থেকে প্রতিরাতে নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, তার পর মুখোশ পরা এক বা একাধিক চীনা পুরুষ তাদের ধর্ষণ করতো। তিনি নিজেও তিনবার গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। প্রতিবারই দুই বা তিন জন লোক মিলে এ কাজ করতো।

‘কোন দয়া-মায়া দেখানো চলবে না’

এসব বন্দীশিবিরে কোনো কোনো অনুমান অনুযায়ী ১০ লাখেরও বেশি নারী-পুরুষকে রাখা হয়েছে। চীনের বক্তব্য, উইঘুর ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের পুনঃশিক্ষণের জন্যই এসব বন্দীশিবির তৈরি করা হয়েছে। উত্তর পশ্চিম চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের তুর্কিক মুসলিম সংখ্যালঘু উইঘুরদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, চীনা সরকার উইঘুরদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতাসহ অন্য অধিকারগুলো ক্রমে ক্রমে হরণ করেছে এবং গণ-নজরদারি, বন্দীত্ব, মগজ ধোলাই এবং জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ পর্যন্ত করার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মূলত এই নীতির উদ্যোক্তা। ২০১৪ সালে উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চালানো এক সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি জিনজিয়াং সফর করেছিলেন। এর পরপরই - মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের পাওয়া গোপন দলিল অনুযায়ী - তিনি স্থানীয় কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এর জবাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় ‘কোনো রকম দয়া-মায়া দেখানো চলবে না’।

মার্কিন সরকার গত মাসে বলেছে, জিনজিয়াংয়ে চীনের এসব কর্মকাণ্ড গণহত্যার শামিল। চীন অবশ্য একে ‘মিথ্যা ও উদ্ভট অভিযোগ’ বলে দাবি করেছে।

এসব বন্দীশিবিরের ভেতর থেকে বাসিন্দাদের কারও বক্তব্য পাওয়া খুবই দুর্লভ। তবে সাবেক বন্দী ও প্রহরীদের বেশ কয়েকজন বিবিসিকে বলেছেন, তারা পরিকল্পিত গণধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন বা এর প্রমাণ পেয়েছেন।

তুরসুনে জিয়াউদুন এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। জিনজিয়াং থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রথম কিছুকাল তিনি ছিলেন কাজাখস্তানে। সেখানে তিনি সার্বক্ষণিক ভয়ের মধ্যে ছিলেন যে তাকে বোধহয় আবারও চীনে ফেরত পাঠানো হবে। তার মনে হতো, তিনি বন্দীশিবিরে যে পরিমাণ যৌন নির্যাতন দেখেছেন ও তার শিকার হয়েছেন - সে কাহিনী সংবাদমাধ্যমকে বললে তাকে জিনজিয়াং ফেরত পাঠানোর পর আরও নির্যাতনের শিকার হতে হতো। তার ওপর এসব ঘটনা বর্ণনা করাও ছিল একটা লজ্জার বিষয়।

অবশ্য জিয়াউদুনের বক্তব্য পুরোপুরি যাচাই করা অসম্ভব, কারণ চীনে সংবাদদাতাদের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তবে তার বর্ণনার খুঁটিনাটির সঙ্গে জিনজিয়াং বন্দীশিবির সম্পর্কে বিবিসির হাতে থাকা অন্যান্য তথ্য ও বর্ণনা মিলে যায়।

কাজাখ নারী গুলজিরা

জিনজিয়াংয়ের বন্দী শিবিরে ১৮ মাস ছিলেন কাজাখ নারী গুলজিরা আউয়েলখান। উইঘুর নারীদের কাপড় খুলে উলঙ্গ করতে এবং তারপর তাদের হাতকড়া লাগাতে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল। তারপর তিনি ওই নারীদের একটি ঘরে রেখে যেতেন। সেখানে কয়েকজন চীনা পুরুষ থাকতো। পরে, তার কাজ ছিল ঘরটা পরিষ্কার করা।

গুলজিরা আউয়েলখান বলেন, ‘আমার কাজ ছিল ওই মেয়েদের কোমর পর্যন্ত কাপড়-চোপড় খোলা এবং এমনভাবে হাতকড়া লাগানো যাতে তারা নড়তে না পারে। পরে তাদের ঘরে রেখে আমি বেরিয়ে যেতাম। তারপর সেই ঘরে একজন পুরুষ ঢুকতো। সাধারণত বাইরে থেকে আসা কোন চীনা লোক বা পুলিশ। আমি দরজার পাশে নীরবে বসে থাকতাম। লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমি ওই নারীটিকে গোসল করাতে নিয়ে যেতাম।’

গুলজিরা বলছিলেন, ‘বন্দীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ও কমবয়স্ক মেয়েদের কাছে পাওয়ার জন্য চীনা পুরুষরা টাকাপয়সা দিতো।’

এতে বাধা দেওয়া বা হস্তক্ষেপ করার কোনো ক্ষমতা তার ছিল না। কিছু সাবেক বন্দীকেও বাধ্য করা হতো প্রহরীদের সাহায্য করতে। সেখানে পরিকল্পিত ধর্ষণের ব্যবস্থা ছিল কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে গুলজিরা আওয়েলখান বলেন, ‘হ্যাঁ, ধর্ষণ।’

জিয়াউদুন বলেন, সেল থেকে তুলে সিয়ে যাওয়ার পর কয়েকজন মেয়ে আর ফিরে আসেনি। যারা ফিরে এসেছিল তাদেরও হুমকি দেওয়া হয়েছিল তাদের সঙ্গে হওয়া এই ঘটনা যেন কাউকে না বলে।

এ্যাড্রিয়ান জেঞ্জ বলছিলেন, এই রিপোর্টের জন্য যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ তারা পেয়েছেন তা ভয়াবহ এবং তারা আগে যা ভেবেছিলেন - তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর।

জিয়াউদুনের কাহিনী
জিনজিয়াং প্রদেশের ওই এলাকাটি কাজাখাস্তান সীমান্তের পাশেই এবং সেখানে জাতিগতভাবে বহু কাজাখ লোকও বাস করে। জিয়াউদুনের বয়স ৪২। তার স্বামীও একজন কাজাখ। ২০১৬ সালে তারা কাজাখস্তানে পাঁচ বছর থাকার পর জিনজিয়াং ফিরে গেলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। কয়েকমাস পরে তাদেরকে উইঘুর ও কাজাখদের একটি সভায় যোগ দিতে হবে বলে জানায় পুলিশ। সেখানেই তাদের গ্রেপ্তার ও বন্দী করা হয়।

প্রথম দিকে তাদের বন্দী অবস্থায় ভালো খাবার দেওয়া হতো, ফোনও দেওয়া হতো। এক মাস পরে তার পেটে আলসার ধরা পড়লে জিয়াউদুন ও তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার স্বামীর পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হলে তিনি কাজাখস্তানে ফিরে যান, কিন্তু জিয়াউদুনের পাসপোর্টটি দেওয়া হয়নি।

ফলে তিনি জিনজিয়াংয়ে আটকা পড়েন। এ অবস্থায় ২০১৮ সালের মার্চ মাসে তাকে একটি থানায় রিপোর্ট করতে বলা হয়। সেখানে গেলে পুলিশ তাকে জানায়, তার আরও ‘শিক্ষা’ দরকার।

জিয়াউদুন জানান, এরপর তাকে কুনেস কাউন্টিতে সেই একই বন্দীশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বলেন, ততদিনে কেন্দ্রটি আরও উন্নত করা হয়েছে এবং তার সামনে নতুন বন্দী নামানোর জন্য সব সময় বাসের ভিড় লেগে থাকতো। বন্দীশিবিরে আনার পর তাদের অলংকার খুলে ফেলা হয়। জিয়াউদুনের কানের দুল ছিঁড়ে নেওয়া হলে তার কান দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে।

একজন বয়স্ক নারীর মাথার হিজাব টেনে খুলে নেওয়া হয়। জিয়াউদুন বলেন, ‘সেই বয়স্ক নারীর অন্তর্বাস ছাড়া আর সব কাপড় খুলে নেওয়া হয়। ওই নারী দু’হাত দিয়ে তার লজ্জা ঢাকা চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন, আর তার অবস্থা দেখে আমিও কাঁদছিলাম।’

বন্দী অবস্থায় কয়েক মাস ধরে তাদের বিভিন্ন প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান দেখানো হতো। তাদের চুলও কেটে ছোট করে দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউদুনকে তার স্বামী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতো পুলিশ। বাধা দিলে তাকে একবার এমনভাবে পেটে লাথি মেরেছিল যে তার রক্তপাত হতে থাকে। অন্য বন্দীরা প্রহরীদের ব্যাপারটা জানালে তারা বলেছিল, ‘মেয়েদের এরকম রক্তপাত স্বাভাবিক ব্যাপার।’

বাংকবেড-বিশিষ্ট একেকটি কারাকক্ষে ১৪ জন নারীকে রাখা হতো। তাতে ছিল একটি বেসিন ও একটি টয়লেট। প্রথম দিকে যখন রাতে মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো তখন জিয়াউদুন ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো এই মেয়েদের অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে ২০১৮ সালের মে মাসের কোন এক দিন, জিয়াউদুন এবং আরেকটি মেয়েকে তুলে নিয়ে একজন মুখোশপরা চীনা পুরুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। দুজনকে নেওয়া হয় দুটি আলাদা ঘরে।

যে নারী তাদেরকে সেল থেকে নিয়ে এসেছিল- সে ওই লোকদের জানায়- সম্প্রতি জিয়াউদুনের রক্তপাত হয়েছে। একথা বলার পর একজন চীনা লোক তাকে গালাগালি করে। মুখোশ পরা লোকটি বলে- ‘ওকে অন্ধকার ঘরে নিয়ে যাও।’

জিয়াউদুন বলেন, ‘মহিলাটি আমাকে সেই অন্ধকার ঘরে নিয়ে যায়। তাদের হাতে একটা ইলেকট্রিক লাঠির মত ছিল - সেটা কি জিনিস আমি জানি না। সেটা আমার যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, আমাকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হলো। সেই মহিলাটি তখন আমার শারীরিক অবস্থার কথা বলে বাধা দেওয়ায় নির্যাতন বন্ধ করা হয়, আমাকে সেলে ফেরত পাঠানো হলো। ঘন্টাখানেক পর দ্বিতীয় মেয়েটিকেও সেলে ফিরিয়ে আনা হলো। তারপর থেকে মেয়েটি একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়। সে কারও সঙ্গে কথা বলতো না। এক একা বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। ওই সেলের অনেকেই এমন হয়ে গিয়েছিলেন।’

শিক্ষাদানের স্কুল

সেলের পাশাপাশি বন্দীশিবিরগুলোর আরেকটা অংশ ছিল স্কুলের শ্রেণিকক্ষ। এখানে শিক্ষক এনে বন্দীদের ‘নতুন করে শিক্ষাদান’ করা হতো - অধিকারকর্মীদের মতে- যার লক্ষ্য ছিল উইঘুর ও অন্য সংখ্যালঘুদের তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্ম ভুলিয়ে দিয়ে চীনা সংস্কৃতির মূলধারায় দীক্ষিত করা।

বন্দীদের চীনা ভাষা শিক্ষা দিতে বাধ্য করা হতো কেলবিনুর সেদিককে। তিনি জিনজিয়াংয়ের বাসিন্দা এবং জাতিগতভাবে উজবেক নারী। কেলবিনুর সেদিক পরে চীন থেকে পালিয়ে যান এবং তার অভিজ্ঞতা প্রকাশ্যে বর্ণনা করেন।

বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘নারীদের ক্যাম্পগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও তিনি ধর্ষণের কথা শুনতে পেতেন, এর আভাসও পেতেন। একদিন পরিচিত একজন চীনা মহিলা পুলিশকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন যে ব্যাপারটা সত্যি কিনা। সেই মহিলা পুলিশটি তাকে জানায়- হ্যাঁ, গণধর্ষণ এখানকার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। চীনা পুলিশ শুধু যে ধর্ষণ করে তাই নয়, মেয়েদের ইলেকট্রিক শক দেয়, ভয়াবহ সব নির্যাতন করে।’

সেই রাতে সেদিক ঘুমাতে পারেননি, শুধু কেঁদেছেন।

উইঘুর হিউম্যান রাইটস প্রজেক্টের সামনে দেওয়া জবানবন্দীতে সেদিক বলেন, তিনি মেয়েদের নির্যাতনের জন্য ইলেকট্রিক স্টিক নামে একটা জিনিসের কথা শুনেছেন - যা মেয়েদের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। ঠিক যেমনটা জিয়াউদুন বর্ণনা করেছেন।

সেদিক জানান, ‘চার রকম করে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো। চেয়ার, দস্তানা, হেলমেট - আর পায়ুপথে স্টিক দিয়ে ধর্ষণ। পুরো ভবন জুড়ে মেয়েদের আর্তনাদের প্রতিধ্বনি শোনা যেতো। আমি দুপুরের খাবারের সময়, বা কখনও কখনও ক্লাস থেকেও তা শুনতে পেতাম।’

ক্যাম্পে শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হওয়া আরেক নারী সায়রাগুল সাউৎবে বিবিসিকে বলেন, ধর্ষণ ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। রক্ষীরা যাকে চাইতো, তাকেই তুলে নিয়ে যেতো।

তিনি বলেন, তিনি একটি ভয়াবহ ও প্রকাশ্য গণধর্ষণের ঘটনা দেখেছেন। ২০-২১ বছরের একটি মেয়েকে ১০০ জন বন্দীর সামনে নিয়ে আসা হয়, তাদের বাধ্য করা হয় স্বীকারোক্তি দিতে। এবং তারপর পুলিশ পালাক্রমে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে সবার সামনে। সে সময় তারা অন্য বন্দীদের ওপর নজর রাখছিল। তাদের কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে, চোখ বন্ধ করলে, অন্যদিকে তাকালে, বা হাতের মুঠি শক্ত করলেই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শাস্তি দেওয়ার জন্য।’

সায়রাগুল বলেন, ‘মেয়েটির চিৎকার শুনে আমার মনে হচ্ছিল যেন আমি মরে যাচ্ছি।’

জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ
জিয়াউদুন সেই বন্দীশিবিরে ছিলেন মাসের পর মাস। বন্দীদের সেখানে চুল কেটে দেওয়া হতো। তারা ক্লাসে যেতো, তাদের এমন সব ডাক্তারি পরীক্ষা করা হতো যার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যেত না, তাদের ওষুধ খেতে হতো, প্রতি ১৫ দিনে একবার করে ‘টিকা’ দেওয়া হতো - যার ফলে তাদের বমি বমি লাগতো, শরীর অসাড় হয়ে যেত। কোনো কোনো নারীর দেহে জোর করে জন্মনিরোধক আইইউডি লাগিয়ে দেওয়া হতো, কাউকে বা বন্ধ্যাকরণ করানো হতো।

এ নিয়ে বার্তা সংস্থা এপি একটি অনুসন্ধান চালানোর পর চীনা সরকার বিবিসির কাছে একে ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ বলে আখ্যায়িত করে।

বন্দীদের চীনা দেশপ্রেমের গান গাইতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দেখতে হতো শি জিনপিংকে নিয়ে তৈরি দেশপ্রেমমূলক টিভি অনুষ্ঠান। শি জিনপিং সংক্রান্ত বইয়ের অনুচ্ছেদও মুখস্ত করতে হতো তাদের। মুখস্থ বলতে না পারলে খাবার দেওয়া হতো না।

জিয়াউদুন বলছিলেন, ‘ক্যাম্পের বাইরের জীবনের কথা ভাবতে ভুলে যাবেন আপনি। এটা কি মগজ ধোলাইয়ের জন্য নাকি ইনজেকশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া - তা আমি জানি না। কিন্তু পেট ভরে খাবার ইচ্ছে ছাড়া আর কিছুই আপনি চিন্তা করতে পারবেন না। না খাইয়ে রাখাটা এতই ভয়াবহ।’

বই মুখস্থ করার পরীক্ষায় ফেল করলে বিভিন্ন রঙের কাপড় পরিয়ে আলাদা করা হতো বন্দীদের, তারপর চলতো মারধর এবং অনাহারে রাখা। বন্দীশিবিরের একজন সাবেক রক্ষী চীনের বাইরের একটি দেশ থেকে ভিডিও লিংকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন। তার এসব বক্তব্য যাচাই করা যায়নি, তবে তার বর্ণনা অন্য একটি ক্যাম্প থেকে পাওয়া দলিলপত্রের সাথে মিলে যায়।

এই রক্ষীটি বলেন, তিনি বন্দীশিবিরে ধর্ষণ সম্পর্কে কিছু জানেন না, তবে বন্দীদের বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো বলে স্বীকার করেন।

চীনে কাজ করা একজন সাবেক ব্রিটিশ কূটনীতিক চার্লস পার্টন বলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে শি জিনপিংয়ের নীতি অনুযায়ীই এগুলো করা হচ্ছে। শি অথবা অন্য শীর্ষ কমকর্তারা কি ধর্ষণ ও নির্যাতনের নির্দেশ বা অনুমোদন দিয়েছেন? এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘তারা নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে অবহিত’।

‘তারা সারা শরীরে কামড়াতো’

জিয়াউদুন বলেন, ‘নির্যাতনকারীরা শুধু ধর্ষণই করতো না, সারা শরীরে কামড়াতো। আপনি বুঝবেন না যে, তারা মানুষ না পশু। শরীরের কোন অংশই তারা বাকি রাখতো না, সবখানে কামড়াতো আর তাতে বীভৎস সব দাগ হয়ে যেতো।’

জিয়াউদুন বলেন, ‘তিনবার আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে।’

তার সেলে থাকা আরেকটি মেয়ে জিয়াউদুনকে বলেছিল, তাকে আটক করা হয়েছিল বেশি বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে। এই মেয়েটিকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তিনদিন বাদে সেলে ফিরে আসার পর দেখা যায় - তার শরীরেও একই রকম কামড়ের দাগ।

‘সে কোনো কথা বলতে পারছিল না, আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদছিল’ - বলেন জিয়াউদুন।

চীনা সরকারের প্রতিক্রিয়া

চীনা সরকার ধর্ষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে বিবিসির প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয়নি। একজন মুখপাত্র বিবৃতিতে বলেন, ‘এগুলো বন্দীশিবির নয় বরং বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। চীনা সরকার সকল জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকার সমানভাবে রক্ষা করে এবং নারী অধিকারকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়।’

বন্দীশিবিরের পর জিয়াউদুনের জীবন
জিয়াউদুন মুক্তি পান ২০১৮ সালে। তার পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয় এবং তিনি কাজাখস্তানে পালিয়ে যান। পরে উইঘুর মানবাধিকার প্রকল্পের সহায়তায় তিনি আমেরিকায় যান এবং সেখানেই থাকার পরিকল্পনা করছেন। তার স্বামী এখনও কাজাখস্তানে আছেন। তার ওপর চালানো নির্যাতনের চিকিৎসার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরই তার জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়।

জিয়াউদুন বলেন, ‘আমি মা হওয়ার সুযোগ হারিয়েছি।’

কিছু স্বাধীন গবেষণায় দেখা গেছে, জিনজিয়াং প্রদেশে গত কয়েক বছরে জন্মহার অনেকটা কমে গেছে। বিশ্লেষকদের অনেকে একে ‘জনসংখ্যাগত গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। উইঘুর জনগোষ্ঠীর অনেকে মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।

জিয়াউদুন বলেন, ‘তারা বলে, লোকজনকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি বলবো, যারা ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাচ্ছে তারা আসলে শেষ হয়ে গেছে। আসলে পরিকল্পনা ছিল এটাই। নজরদারি, বন্দীত্ব, বিমানবিকীকরণ, বন্ধ্যাকরণ, নির্যাতন ও ধর্ষণ। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে সবাইকে ধ্বংস করা। আর সবাই সেটা জানে।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিএম