এক বছর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন ৩৪ বছর বয়সী চীনা চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং। মৃত্যুর আগে সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। চীনে করোনা সংক্রমণের খবর দিয়েছিলেন তিনিই প্রথম। এর ফলে ‘গুজব’ ছড়ানোর অপরাধে চীনা সরকারের হাতে তাকে হতে হয়েছিল তিরস্কৃত। তবে মৃত্যুর পরে তাকেই ‘চীনের হিরো’ বলে স্বীকৃতি দেয় দেশবাসী। এর ঠিক এক বছর পর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তাকে স্মরণ করছেন চীনারা।

তবে করোনা মহামারির কারণে বিধিনিষেধ থাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই মূলত ডা. লি ওয়েনলিয়াংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানান মানুষ। চীনে বাক-স্বাধীনতা সীমিত। এমনকি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও মানুষের করা বিভিন্ন মন্তব্য কঠোরভাবে মনিটরিং করে চীনা সরকার। এরপরও চীনা টুইটার হিসেবে পরিচিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ওয়েইবো’-তে ডা. লি ওয়েনলিয়াংয়ের ব্যক্তিগত পেইজে নিজেদের বক্তব্য লিখে শ্রদ্ধা জানান মানুষ।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, স্থানীয় সময় ৭ ফেব্রুয়ারির আগে থেকেই ডা. লি ওয়েনলিয়াংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ‘বিরল জায়গায়’ পরিণত হয় পেইজটি। মৃত্যুর আগে ওয়েইবো-তে করা ডা. লি-র করোনায় অসুস্থ হওয়ার স্ট্যাটাসে লাখ লাখ মানুষ মন্তব্য লিখে তাদের শ্রদ্ধা জানান।

ডা. লি ওয়েনলিয়াংয়ের সর্বশেষ ওই স্ট্যাটাসে একজন লিখেছেন, ‘ডা. লি, ইতিহাস এবং মানুষ আপনাকে কখনোই ভুলবে না!’

আরেকজনের ভাষায়, ‘ভেবেছিলাম, মৃত্যুর এক বছর পর আপনাকে হয়তো সবাই ভুলে গেছে। কিন্তু (আমার ধারণা) ভুল। আপনি চীনাদের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।

চীনা সামাজিক মাধ্যম ওয়েইবো-তে লি ওয়েনলিয়াংয়ের সর্বশেষ স্ট্যাটাস। এতে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে
অসুস্থতার কথা জানিয়েছিলেন। মানুষ এখানেই মন্তব্য লিখে তাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন

করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান। উহান সেন্ট্রাল হসপিটালে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলেন লি। এই হাসপাতালেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন তিনি।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে লি ওয়েনলিয়াং তার সহকর্মীদের একটি সতর্কবার্তা পাঠান। ওই বার্তায় তিনি সার্সের (প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতি) মতো একটি ভাইরাসের কথা জানান। কিন্তু এ জন্য উল্টো তাকে হেনস্তার শিকার হতে হয়। চীনের জননিরাপত্তা ব্যুরো তাকে ডেকে ‘গুজব না ছড়ানোর’ জন্য সতর্ক করে এবং একটি চিঠিতে সই করতে বাধ্য করে, যেখানে তিনি মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ করা হয়।

তবে যেখানে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন লি, সেই উহানের মানুষও তাকে স্মরণ করছেন শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়। লি-এর কর্মক্ষেত্র উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের পাশেই লি প্যান নামে এক ব্যক্তি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের ব্যাপারে তিনিই প্রথম আমাদের জানিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন- মানুষকে এভাবে সতর্ক করলে (চীনা সরকারের দমন-পীড়নের কারণে) তিনি হয়তো বিপদের মুখে পড়তে পারেন। কিন্তু তিনি তারপরও মানুষকে সতর্ক করেছেন। এটা খুব বড় সাহসিকতার কাজ।’

পেশায় ডিজাইনার জি পেনঘুই নামে উহানের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘লি-র সতর্কবার্তা শুনে মাস্ক মজুত করতে থাকি। তখনও সরকার থেকে কিছু ঘোষণা করা হয়নি।’

তিনি আরও বলন, ‘দেশবাসী লি-কে শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রেখেছে। সরকারের উচিত আনুষ্ঠানিক ভাবে ওকে সম্মান জানানো।’

ডা. লি ওয়েনলিয়াংয়ের দেওয়া সতর্কবার্তা যে গুজব ছিল না, তার প্রমাণ তো বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর ঘটনা। করোনাভাইরাস শনাক্তের প্রথম পর্যায়ে এত বড় একটি ঝুঁকিকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং শুরুতে এটিকে গোপন রাখার চেষ্টা করার অভিযোগ উঠেছে চীনা সরকারের বিরুদ্ধে। সারা বিশ্বের মানুষ, বড় বড় গণমাধ্যমের পাশাপাশি এই অভিযোগ তুলেছেন খোদ দেশটির নাগরিকেরাই।

এদিকে করোনাভাইরাসের উৎস নির্ধারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তদন্তকারী দল এখন উহানে। শহরের বিতর্কিত সেই মাংসের বাজার, গবেষণাগারসহ সম্ভাব্য সকল স্থানই খতিয়ে দেখছেন তারা। অবশ্য চীনের দাবি, করোনাভাইরাস উহানে প্রথম শনাক্ত করা হলেও এই ভাইরাসের উৎস চীন নয়। অন্যদিকে আমেরিকা আর ইউরোপের দেশগুলোর দাবি, উহানের গবেষণাগার থেকেই ভাইরাস ছড়িয়েছে। তবে ভাইরাস যেখান থেকেই ছড়াক না কেন, চীনাদের দাবি, তাদের দেশের ‘হিরো’ ডা. লি ওয়েনলিয়াং।

সূত্র: বিবিসি, এপি

টিএম