শিগগিরই ভাসানচর যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দল
প্রথম ধাপে ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গারা/ ফাইল ছবি
কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দলকে নোয়াখালীর ভাসানচরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দিনক্ষণ চূড়ান্ত না হলেও আশা করা হচ্ছে, কয়েকদিনের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় তাদের সেখানে নেয়া হবে।
রোববার (২৭ ডিসেম্বর) প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কূটনৈতিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বিজ্ঞাপন
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে প্রত্যাবাসনের সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, প্রায় হাজারখানেকের মতো রোহিঙ্গাকে কয়েকদিনের মধ্যে ভাসানচরে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি হচ্ছে, কেবল তাদেরই সেখানে নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দলকে ভাসানচরে নেওয়ার বিষয়ে আমি বলতে পারব না। এটা বলতে পারবেন শরণার্থী, ত্রাণ প্রত্যাবাসন যারা দেখছেন, উই ডোন্ট ডু ইট (আমরা এটা করি না)। তবে এটা বলতে পারি লজিস্টিকের ওপর নির্ভর করছে তারা কখন নিতে পারবে।’
বিজ্ঞাপন
এদিকে রোববার আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যে এক হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হচ্ছে। তবে এবারও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে ‘না জানিয়ে’ রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দলকে সেখানে পাঠানো হচ্ছে।
তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে বলেন, ‘প্রথমে তাদের চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে, তারপর সেখান থেকে ভাসানচরে। বঙ্গোপসাগরের অবস্থার কথা বিবেচনা করে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’
যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে চান, কেবল তাদেরকেই স্থানান্তর করা হবে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো শরণার্থীকেই সেখানে নেয়া হবে না।
শরণার্থীদের স্থানান্তরের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামসুদ্দোজা
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বাস্তুচ্যুত হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে এক লাখকে নিরাপদ আশ্রয় দিতেই দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয় করে ভাসানচরে আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করে সরকার। পরিকল্পিতভাবে আবাসন গড়ে তোলা এই দ্বীপে অনেক আগ থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের চিন্তা-ভাবনা করছিল সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের চাপে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না।
অবশেষে গত ৪ ডিসেম্বর প্রথম ধাপে উখিয়ার কয়েকটি ক্যাম্প থেকে বাসে ও জাহাজে করে দুদিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গার একটি দলটি সেখানে পাঠায় সরকার।
এদিকে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়া যখন শুরু করে বাংলাদেশ সরকার সেসময় থেকে এ প্রসঙ্গে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে জাতিসংঘ।
ভাসানচরকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যাপ্রবণ’ দ্বীপ হিসেবে উল্লেখ করে গত ২ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ার প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমে, অথবা শরণার্থীদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। স্থানান্তরের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই।
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়ার যে পরিকল্পনা সরকার চূড়ান্ত করেছে, এর সঙ্গে জাতিসংঘের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।
এর জবাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনমান উন্নয়নের ‘আন্তরিক প্রচেষ্টাকে’ ‘ভুল ব্যাখ্যা’ না দিতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানায় বাংলাদেশ সরকার। যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে প্রস্তুত, কেবল তাদেরকেই সেখানে স্থানান্তর করা হচ্ছে উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং অবশ্যই তাদের সে দেশে ফেরাতে হবে। অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের এই নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ তার সর্বোচ্চটা করছে।
বিবৃতিতে ভাসান চরের প্রসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ধাপে ধাপে সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এখানে সারা বছর বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, মনোরম লেক এবং টেকসই স্থাপনা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ, কৃষি জমি, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, দুটি হাসপাতাল, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ, গুদাম, টেলিযোগাযোগ সেবা, থানা, বিনোদন ও শিক্ষা কেন্দ্র, খেলার মাঠ ইত্যাদি রয়েছে।
জাতিসংঘের উদ্বেগের প্রসঙ্গে চলতি মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল মোমেন রয়টার্সকে বলেছিলেন, ‘ভাসানচর নিয়ে উদ্বেগের পরিবর্তে জাতিসংঘের উচিৎ শান্তিপূর্ণভাবে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে এই শরণার্থীরা যেন ফিরতে পারেন, সে বিষয়ে বাস্তবসম্মত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া।’
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। আগে থেকে অবস্থান করছেন আরও চার লাখের মতো। বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি করলেও মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে এই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। পরপর দুবার প্রত্যাবাসনের খুব কাছাকাছি গিয়েও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে পাঠানো যায়নি দেশটির সরকারের মানসিকতার কারণে।
এনআই/এসএমডব্লিউ/এফআর