মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি টঙ্গী স্টেশনে থামেনি। থেমেছিল ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে। এর আগে ট্রেনটির স্টপেজ ছিল গফরগাঁও ও ময়মনসিংহ জংশনে। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছাতে সময়ের হিসাবে দূরত্ব ১৮ মিনিটের। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনটিতে আগুন দেখা যায়নি। কিন্তু তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছার আগে টের পাওয়া যায় ট্রেনে আগুন লেগেছে।

ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হওয়ার পর সৈনিক ক্লাবের আগে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সৈনিক ক্লাব পর্যন্ত দুই শতাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের পর এটি নিশ্চিত করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্য মতে, মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি বগিতে আগুন দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। সকাল পৌনে ৭টার দিকে আগুন নির্বাপণ হয়। পরে একটি বগি থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার ফাইটাররা।

তাদের মধ্যে একজন শিশু, একজন নারী ও দুজন পুরুষ ছিলেন। এর মধ্যে দুজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন– নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার তিন বছরের শিশুসন্তান ইয়াসিন।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন এবং চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) রাতেই ঢাকা রেলওয়ে থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে ও হত্যার পৃথক ধারায় একটি মামলা (মামলা নং- ৭) হয়েছে। মামলার আসামিরা অজ্ঞাত। বাদী ক্ষতিগ্রস্ত ট্রেনটির পরিচালক (গার্ড) খালেদ মোশাররফ।

ঘটনার পর ছায়াতদন্ত শুরু করেছে র‍্যাব, থানা পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা জেলার এসপি আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রেলওয়ে পুলিশ ঘটনাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। যদিও আমরা এখন পর্যন্ত জড়িত কাউকে শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করতে পারিনি।’

যোগাযোগ করা হলে তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা কাজ করছি। উত্তরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তরা, গুলশান ও তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করছে। আমরা এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন কাউকে শনাক্ত করতে পারিনি, চেষ্টা চলছে।’

তবে, গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা প্রথমত ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু করে সম্ভাব্য সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত আমাদের অবজারভেশন, মিডিয়াতে যেভাবে আসছে তা সঠিক মনে হয়নি। আমরা এর প্রমাণও পেয়েছি। অর্থাৎ আগুন কোন এলাকায় লাগানো হয়েছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে সিসিটিভি ফুটেজে।’

সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যন্ত আমরা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে কোনো আগুন বা ধোঁয়ার আলামত পাইনি। তবে, ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হওয়ার পর সৈনিক ক্লাব এলাকার সিসিটিভি ফুটেজে আগুনের আলামত স্পষ্ট দেখা গেছে।’

বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের পর আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা

ডিবি গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘সৈনিক ক্লাব এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের পর এটি স্পষ্ট মনে হয়েছে যে, বিমানবন্দর স্টেশন থেকে উঠে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হওয়ার পর আগুন দেওয়া হয় ট্রেনটিতে।’

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সৈনিক ক্লাবের আগের কোনো সিসিটিভিতে আমরা ট্রেনটিতে আগুন কিংবা ধোঁয়ার আলামত দেখতে পাইনি। এ ছাড়া, ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরই ট্রেনটি স্টেশন ত্যাগ করে।’

বিমানবন্দর থেকে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনটিতে আগুন লাগানো হয়নি— উল্লেখ করে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খবর এসেছে যে, বিমানবন্দরে দুজন নেমে যাওয়ার পরপরই আগুন দেখা যায়। তার মানে, তারা আগুন দিয়ে বিমানবন্দরে নেমে গেছেন। এটি আসলে সঠিক নয়। কারণ, বিমানবন্দর থেকে মহাখালী বা তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছার দূরত্ব ১৮ মিনিট। আগুন ১৮ মিনিট আগে লাগলে পুরো ট্রেন পুড়ে ছাই হয়ে যেত।’

‘ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের আগে ট্রেনটির যাত্রাবিরতির স্টেশন ছিল গফরগাঁও ও ময়মনসিংহ জংশনে। টঙ্গীতেও ট্রেনটি থামেনি। আর বাইরে থেকে দেখার সুযোগও নেই যে কেউ আগুন লাগাচ্ছে কি না। আমাদের ধারণা স্পষ্ট, আগুন বিমানবন্দর স্টেশনে দেওয়া হয়নি। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের পর আগুন দেওয়া হয়। আমরা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের মাস্টার, লাইনম্যান, সিগন্যালম্যানের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারা ক্লিয়ার পাস দিয়েছেন। তারাও তখন আগুন দেখেননি। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হওয়ার পর আগুন ভিজিবল (দৃশ্যমান) হয়েছে।’

অন্যদিকে, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় এখনও কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা মেট্রো-দক্ষিণের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে স্পষ্ট যে, এটি নাশকতামূলক কাজ। আমরা সম্ভাব্য চার স্টেশন নিয়ে কাজ করছি। গফরগাঁও, এয়ারপোর্ট, ক্যান্টনমেন্ট ও তেজগাঁও স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি। এখন পর্যন্ত কাউকে আমরা শনাক্ত করতে পারিনি।’

তবে তিনি বলেন, ‘আগুন দ্রুত ট্রেনে ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ, পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে উঠে ট্রেনের নির্দিষ্ট বগিতে আগুন দিয়ে অন্য বগিতে চলে যেতে পারে দুর্বৃত্তরা।’

গতকাল মঙ্গলবার রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিসংযোগ ও চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পুরো ঘটনা তদন্ত না করে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সম্প্রতি রেল দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, নাশকতাকারীরা যাত্রী হয়ে ট্রেনে উঠলে রেলযাত্রা নিরাপদ করা তো সম্ভব না। বিএনপি-জামায়াত ২০১৩-১৪ সালেও একই ঘটনা ঘটিয়েছে। এখন বাসের বদলে ট্রেনকে তারা হাতিয়ার বানিয়েছে।

জেইউ/এসএসএইচ